ঢাকা, শুক্রবার, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ মে ২০২৪, ০১ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

পথের ধারে অসংখ্য মরদেহ, মুমূর্ষু বৃদ্ধ-শিশু

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৭
পথের ধারে অসংখ্য মরদেহ, মুমূর্ষু বৃদ্ধ-শিশু মাকে বয়ে আনছে ছেলেরা। ছবি: দীপু মালাকার

পালংখালি, উখিয়া, কক্সবাজার: আসার পথের এক ভয়াবহ বর্ণনা শোনা যাচ্ছে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কাছ থেকে। বিশেষ করে এখন যারা বাংলাদেশে পৌঁছুচ্ছেন বা এখনো আসার পথে রয়েছেন তাদের অভিজ্ঞতা খুবই করুণ ও মর্মান্তিক। ১৫ থেকে ২০ দিন ধরে খাড়া পাহাড় আর গভীর জঙ্গল ধরে এক টানা হেটেঁ এরা পৌঁছুচ্ছেন বাংলাদেশ সীমান্তে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের দুর্গম দূরাঞ্চল থেকে আসার পথে রাস্তার দুপাশে এরা দেখে এসেছেন অসংখ্য মৃতদেহ, অর্ধমৃত ও পরিত্যক্ত মুমূর্ষু অসংখ্য শিশু ও বৃদ্ধকে। যারা এখনো জীবিত থাকলেও দ্রুতই প্রতিকুল পরিবেশে খাদ্য, পানি ও আচ্ছাদনের অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন।

মুমূর্ষু বৃদ্ধ।  ছবি: দীপু মালাকার বুথেডং এলাকার চেকনাই নারায়ণ শ্রং এলাকা থেকে ১৬ দিন হেঁটে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার পালংখালি ইউনিয়নের আঞ্জুমান পাড়ায় এসেছেন হাফিজা খাতুন। বাংলানিউজকে তিনি বলছিলেন, সোজা পথে আসার কোন উপায় নেই। সবাইকেই ঘুর পথে গভীর জঙ্গল ও দুর্গম পাহাড় পেরুতে হয়েছে। হাজার হাজার মানুষের এই কাফেলা থেকে সহসাই ছিটকে যাচ্ছে শিশুরা। কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে, হাত ফসকে বেরিয়ে যাওয়া শিশু খুঁজে নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। যে যার মতো করে প্রাণ নিয়ে সামনের দিকে ছুটছেন।
 
বুথেডং এর টমপাড়া এলাকা থেকে আসা নুরুল ইসলাম বলছিলেন, রাস্তায় প্রচুর মরদেহ পড়ে আছে। অনেকগুলোই শেয়ালে খেয়ে ফেলেছে। কিছুতে পচন ধরে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এদের মধ্যে বেশির ভাগই বৃদ্ধ। অনেকেই শারীরিকভাবে চলতে না পারা অক্ষমদের পথেই ছেড়ে আসছেন। খাড়া পাহাড় এদেরকে নিয়ে পার হওয়া কঠিন বলেই, সামান্য কিছু খাদ্য সামগ্রী ও পানি দিয়ে গভীর জঙ্গল ও পাহাড়ে ফেলে আসছেন।

বাবাকে বয়ে আনার ক্ষত ছেলের কাঁধে।  ছবি: দীপু মালাকার আঞ্জুমানপাড়ার অস্থায়ী ক্যাম্পে স্থান নিয়েছেন আবুল হাসিম। ৬০ পেরুনো আবুল হাসিম বাংলাদেশে এসেছেন দুই ছেলে মাহমুদ হাসান ও মঞ্জুরুল হাসানের কাঁধে করে। দীর্ঘ পথ বাপকে কাঁধে করে আনতে গিয়ে ছেলেদের কাঁধেও ক্ষত তৈরি হয়েছে। আবুল হাসিম কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, আমি ছেলেদের কাছে কৃতজ্ঞ। তারা আমাকে ভারায় করে বয়ে নিয়ে এসেছে। তা না হলে, আমাকেও জঙ্গলের শেয়ালে খেতো।

তিনি বলেন, রাস্তায় আমার মতো অসংখ্য বুড়োকে জঙ্গলে পড়ে থাকতে দেখেছি। যারা তখনো জীবিত ছিলো। অসংখ্য মুমূর্ষু শিশুও রয়েছে জঙ্গলে। আসার পথে রোহিঙ্গারা তাদের সামান্য খাবার ও পানি দিয়ে আসছেন। এতে আর কয়দিনই বাঁচবেন তারা। কিন্তু দুর্গম খাড়া পাহাড়ি পথ হওয়ায় তাদের সঙ্গে করে নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি।

নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমারে বিস্ফোরণ।  ছবি: দীপু মালাকার বালুখালি নতুন ক্যাম্পের ঢালে দেখা হয় মংডুর দুম্বার বিল এলাকার সৈয়দ আহমেদের সঙ্গে। তিনি জানান, সেনাবাহিনী গ্রামে হামলা করার পর তিনি তার পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। আসার পথে গভীর জঙ্গলে তার তিন সন্তান কালাম, হাসান ও মমিনুল হারিয়ে যায়। বাংলাদেশে আসার পর পালংখালিতে কালামকে খুজেঁ পেলেও হাসান ও মমিনুল এখনো নিখোঁজ রয়েছে। তারা বাংলাদেশে আসতে পেরেছে, না জঙ্গলেই রয়ে গেছে তা তিনি বলতে পারছেন না।

একই ধরনের ঘটনা জানালেন, বলিবাজার এলাকার ডিয়লতলি এলাকার কবির আহমদ। বাংলাদেশে আসার পথে তিনিও তার চার সন্তারকে হারিয়ে ফেলেন। এখানে আসার পথে একজনকে টেকনাফের উচি প্রুং, একজনকে উখিয়ার পালংখালি ও একজনকে কুতুপালং এলাকায় খুজেঁ পেলেও অন্য সন্তান জাফরকে এখনো খুজেঁ পাওয়া যায়নি। তার কোন সন্ধানও কেউ দিতে পারছে না।

আরও পড়ুন
** মিনারাকে নিয়েই যতো আতংক
** গুলিতে ঝাঁঝরা, শরীরে পচন সাব্বিরের
** জন্মের অভ্যর্থনা যেখানে গম্ভীর, নিরুৎসব, বিষণ্ন
** শৃঙ্খলাহীন ত্রাণ বিতরণ
** শেইম লেস লেডি অ্যান্ড ফেইস অব বুড্ডিস্ট টেররের গল্প
** বোকা বানানো হয় রোহিঙ্গাদের: বিশেষ সাক্ষাৎকারে ইদ্রিস
** স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা
** আজও জ্বলছে সীমান্তের ওপারের রোহিঙ্গা গ্রাম!
** ‘সেপ্টেম্বর অন টেকনাফ রোড’
** সব হারানোর কষ্ট
** আঞ্জুমান পাড়ায় ঘেরের আইলে শরণার্থী জীবন
** বাংলাদেশমুখী আরো ৫ লাখ রোহিঙ্গা
** রোহিঙ্গা পার করে রাতারাতি কোটিপতি শাহপরীর নৌকা মালিকরা
** প্রাণে বাঁচার আনন্দ, ধন্যবাদ বাংলাদেশ 
** রোহিঙ্গাময় টেকনাফ, ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই’ আর!
** ওপারে জ্বলছে আগুন, এপারে মানবিকতা
** এর নাম কি মানব জনম!

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৭
আরএম/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।