তবে এখন যারা আসছেন তাদের প্রায় সবাই আসছেন সীমান্ত থেকে দূরের টাউনশিপগুলো ও গ্রাম থেকে। রাখাইন পাহাড়ের ওপারে অবস্থিত ভারতের মিজোরাম সীমান্ত থেকেও মানুষ আসছে বাংলাদেশের দিকে।
আরো সপ্তাহ খানেক আগেই অনেকে বাংলাদেশের দিকে রওনা দিয়েছেন। বাকিরাও আসছেন। এদের সংখ্যা তিন থেকে পাঁচ লাখ হতে পারে বলে ধারণা ওই অঞ্চল থেকে বাংলাদেশে আসা মানুষের।
বিভিন্ন অসমর্থিত সূত্র, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা ও স্থানীয়রা আরো তিনদিন আগের থেকেই বলছেন বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়িয়েছে। গত তিনদিনে এসেছেন আরো অন্তত দেড় লাখ। মিয়ানমারে বর্তমানে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর যে জাতিগত নিধন চলছে, তা অব্যাহত থাকলে আরো অন্তত ৫ লাখ শরণার্থী বাংলাদেশে আসবে। ফলে এবার বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। তবে রোহিঙ্গাদের ধারণা এ সংখ্যা হবে কম করে হলেও ১২ লাখ!বুচিডং এর টংবাজার এলাকার বাসিন্দা ফাইজুল্লাহ বলছিলেন, এরই মধ্যে বুচিডং, রাশিডং ও মংডুর সব গ্রাম প্রায় রোহিঙ্গা শূন্য হয়ে পড়েছে। কেবলমাত্র অবস্থা সম্পন্ন রোহিঙ্গা পরিবারগুলো সেখানে ছিলো। এদের সামাজিক মর্যাদা থাকায় গত ৫০ বছরে যে দাঙ্গা হাঙ্গামা বা নির্যাতনের ঘটনা হয়েছে, তাতে মোট রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পাঁচ ভাগের এক ভাগ এই ধনিক শ্রেণীর ওপর কখনো আঘাত আসেনি। এবারও সেই আশায় অভিজাত এই রোহিঙ্গা শ্রেণী মিয়ানমার থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সর্বশেষ আক্রমণ হচ্ছে তাদের ওপর। সেনা সদস্যরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে বলছে, তোমরা বাংলাদেশি। তোমরা ধান কাটতে এসেছিলে। তোমরা এদেশে থাকতে পারবে না। বাংলাদেশে ফিরে যাও। এখানকার কোন সম্পদই তোমাদের না।
টংবাজারে বড় একটি দোকান ছিলো ফাইজুল্লাহর। বাংলাদেশি টাকায় প্রায় কোটি টাকার মালামাল ছিলো তার। মাঠে ছিলো ১৬ কানি জমি। পুকুর ছিলো ১০ কানির। বছরে প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশি টাকার মাছ হতো সেখানে। মুসলিম, বৌদ্ধ, হিন্দু সবাই সম্মান করতো সবাইকে সহযোগিতা করার জন্য। তাই তিনি সব ফেলে আসতে চাননি। শেষ পর্যন্ত স্থানীয় মগ ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হলো ‘জীবন নিয়ে বাঁচতে হলে বের হয়ে যাও’। তার সামনেই দোকান পুড়িয়ে দিয়ে বাড়িতে আগুন দেয়া হলো। কোন রকম জীবন বাঁচিয়ে পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন তিনি।
মিজোরাম সীমান্তের বউগলি থেকে সপ্তাহ খানেক আগেই বাংলাদেশের দিকে রওনা দিয়েছিলেন তার বোনের পরিবার। গভীর জঙ্গল আর পাহাড় পেরিয়ে বাংলাদেশে পৌঁছুতে তাদের আরো এক সপ্তাহ লাগবে বলে জানান ফাইজুল্লাহ। তারই এক প্রতিবেশী সৈয়দ কামাল। ১০ম শ্রেণী পাশ কামাল বলছিলেন, মংডু, বুচি ডং, রাশিডং এর পর এখন অত্যাচার ও নিপীড়ন শুরু হয়েছে বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে দূরের বউগলি, বাদে ফাঞ্চি, কিনঞ্জি, পাতিয়া, কিয়ান্দম, ফাঁসি, বাদে সুয়াম্পা, বুবি, যিদং, মানামা, গ্রাং সং, টংবাজার, বাদে চাঙ্গানা, বুগা বিচং, মিজং চোয়ে, ছ প্রুং, রং পাড়া, জব্বার পাড়ার মতো এলাকায়। এসব এলাকার মানুষ এখন আসতে শুরু করেছে। আর এক সপ্তাহের মধ্যেই বার্মা রোহিঙ্গা শূন্য হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, এখন এলাকা ভাগ করে বাড়ি ঘরে আগুন জ্বালাচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং তাদের সঙ্গে থাকা মগরা। প্রথমে সেনাবাহিনীর সদস্যরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে বাড়িতে প্রবেশ করছে। এরপর ঘরের মধ্যে গ্যাস বোমা ও গ্রেনেড ছুড়ে দিচ্ছে। সঙ্গে থাকা কালো কাপড়ে মুখ বাঁধা রাখাইনরা পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে।
একই ধরনের করুণ কাহিনী বলছিলেন, মংডুর দুম্বার বলি বাজার এলাকার সৈয়দ আহমেদ। তিনি একজন সচ্ছল কৃষক ছিলেন। ১৬ কানি জমি ছিলো তার (এক কানি সমান ৪০ শতাংশ)। ঘরে ছিলো ৬০০ হাড়ি ধান ও ৬০ হাড়ি চাল। (এক হাড়ি সমান ১৪ কেজি)। ছিলো ৩০ মন শুকনো মরিচ। গরু ছিলো ১৫টি। এখন তার কিছুই নেই।
সৈয়দ আহমদ বলছিলেন, গত সেপ্টেম্বরে নির্যাতনের পর সেনা বাহিনী তার ৫ কানি জমি কেড়ে নিয়ে নাটালাদের (বাংলাদেশ ও ভারত থেকে পুনর্বাসিত মগ) দিয়ে দেয়। আর এবার গরু ছাগল নিয়ে গিয়ে পুরো বাড়ি পুড়িয়ে দিলো। তিন কানি জমিতে ধান পাকতে আর বাকি নেই। অথচ এখানে আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, পেটে ভাত নেই।
*রোহিঙ্গা পার করে রাতারাতি কোটিপতি শাহপরীর নৌকামালিকরা
*প্রাণে বাঁচার আনন্দ, ধন্যবাদ বাংলাদেশ
*রাখাইনের ১৫০ গ্রাম রোহিঙ্গা শূন্য, পালিয়ে এসেছেন ৫ লাখ
*ওপারে জ্বলছে আগুন, এপারে মানবিকতা
*রোহিঙ্গাময় টেকনাফ, ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই আর
বাংলাদেশ সময়:১৬০৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৭
আরএম/আরআই