ঢাকা, বুধবার, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ মে ২০২৪, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

বোকা বানানো হয় রোহিঙ্গাদের: বিশেষ সাক্ষাৎকারে ইদ্রিস

রহমান মাসুদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৭
বোকা বানানো হয় রোহিঙ্গাদের: বিশেষ সাক্ষাৎকারে ইদ্রিস পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থী মোহাম্মদ ইদ্রিস। ছবি: দীপু মালাকার

মোহাম্মদ ইদ্রিস। বাড়ি পোয়াখালি (বালুখালি), মংডু। পরিবার পরিজন নিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন ২ সেপ্টেম্বর, ঈদুল আজহার দিন। শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে আসার সময় নৌকা ডুবে মারা গেছে তার বড় বোনের পরিবারের সাত সদস্য। এরা হলো- বোন ফয়জুন, দুলা ভাই সৈয়দ উল্লাহ, নাতি ফাতিমা, মিনারা, আয়শা, আয়ুব, ইসমাইল। মিয়ানমানের পাড় থেকে নৌকায় আসার সময়, সেদেশের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) বোট নিয়ে ধাওয়া করে। এসময় বোট উল্টে ওই পারিবারের সবাই মারা যায়।

রোহিঙ্গাদের ইতিহাস ও রাজনীতি সচেতন মোহাম্মদ ইদ্রিস ১০ম শ্রেণি পাশ একজন রোহিঙ্গা যুবক। তিনি প্রথমে মংডুর একটি স্থানীয় হাসপাতালে সহকারীর কাজ করতেন।

এরপর কাজ নেন ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম পুলিশের দফাদারের (সিংগাম)। কাজ ছিলো সরকারকে সহায়তা করা ও চেয়ারম্যানের কার্যালয়ের দাফতরিক দায়িত্ব। সে হিসেবে স্থানীয় প্রশাসনের সব আদেশ, নিষেধ প্রতিপালন এবং সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়ন ও দেখভাল করতেন তিনি।

রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামে সরকারি জুলুম ও ঘোষণা বাস্তবায়ন দেখেছেন বছরের পর বছর। রোহিঙ্গাদের জাতিগত ইতিহাস ও বঞ্চনার প্রেক্ষাপটও তার নখ দর্পনে। এবার আমরা তার মুখেই শুনবো মিয়ানমারের আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলিমদের করুণ জীবনের গল্প।

বোকা বানানো হয়েছে রোহিঙ্গাদের
ইদ্রিস বলছিলেন, ২৪ আগস্ট রাতে সেনা চৌকি এবং পুলিশ ফাঁড়িতে হামলার পর অনেকটা বোকা বানানো হয় রোহিঙ্গা মুসলিমদের। প্রথমে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সিংগামদের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে খবর পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, প্রশাসনের পক্ষ থেকে গ্রামের মুরুব্বিদের সঙ্গে বৈঠক করা হবে। বৈঠকে যেনো গ্রামের সব মুরুব্বি ও যুবক ছেলেরা উপস্থিত থাকেন।

অসহায় রোহিঙ্গা।  ছবি: দীপু মালাকার সেনাবাহিনীর কথা মতো মুরুব্বিরা সকল যুবককে নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে যান মাগরিবের পর। এমনিতেই আমাদের মুরুব্বিরা সেনা চৌকিতে আক্রমণের কথা শুনে চিন্তিত ছিলেন। তারা সেনাবাহিনীর ডাক পেয়ে খুশি হয়েছিলেন, শান্তি স্থাপন হবে ভেবে।

কিন্তু সেনাবাহিনী মুরুব্বিদের কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই, সবাইকে সেনা চৌকিতে হামলার জন্য দায়ী করে এবং উপস্থিত সব মৌলভী ও যুবকদের আটক করে ফেলে। তারা মুরুব্বিদের অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে এবং রাতের মধ্যেই জঙ্গি সংগঠন আলেকিন বা আরসা (আরাকান সলভেশন আর্মি) সদস্যদের তালিকা দিয়ে ধরিয়ে দিতে বলে। মুরুব্বিরা এ বিষয়ে কিছু জানি না বলার পর তাদেরকেই আরসা বা আলেকিন সদস্য হিসেবে দায়ী করা হয়।

এরপরই রাত থেকে গ্রামের পর গ্রাম সেনা অভিযান চলে। এ সময় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়, স্থানান্তরিত বৌদ্ধ বা নাটালা এবং স্থানীয় গ্রামের বৌদ্ধরা। সেনা বাহিনী ব্রাস ফায়ার চালাতে চালাতে গ্রামে প্রবেশ করে এবং রকেট লঞ্চার দিয়ে বাড়ি পোড়াতে থাকে ও মানুষ মারতে থাকে। অন্য দিকে নাটালা রাখাইন এবং স্থানীয় গ্রামের মগরা বাড়ি লুটপাট করে। পরে তারাও ঘরে আগুন দিতে থাকে। এক পর্যায়ে মগরা সেনা বাহিনীর গুলিতে আহত রোহিঙ্গাদের মৃত্যু নিশ্চিত করতে জবাই শুরু করে এবং পেট্রোল ঢেলে মৃতদেহ পোড়াতে শুরু করে। যা এখনো অব্যাহত আছে।

রোহিঙ্গাদের জন্য নতুন জেল সিটুওয়েতে
ইদ্রিস বলছিলেন, রোহিঙ্গা যুবক ও পুরুষদের বেশির ভাগই রয়েছে জেলে। গত কয়েক বছর ধরে তাদের কারাবন্দি করার কাজ চলছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ১০ হাজার যুবক ও পুরুষ রোহিঙ্গা সদস্যকে আটক করে জেলে রাখা হয়েছে। এবারের হামলার পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত সাড়ে তিন হাজার যুবককে হত্যা করা হয়েছে। অনেকেই জীবন বাঁচাতে এরইমধ্যে বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, পূর্ব তিমুর, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, সৌদি আরব ও ইউরোপের দেশগুলোতে পালিয়ে গেছেন।

ট্রাকে করে শরণার্থী ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রোহিঙ্গাদের।  ছবি: দীপু মালাকার তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য দক্ষিণ আরাকানে আকিয়াবের সিটুওয়ের কাছে এ্যাং এলাকায় নতুন জেল বানানো হয়েছে। আকিয়াবের পুরাতন জেল, মংডু, বুচিডং বা রাচিডংয়ের জেলখানায় আর জায়গা নেই। নতুন জেলখানাতেও আর সুঁচ ঢোকানেরা জায়গা নেই। তাই রোহিঙ্গা যুবকরা সবাই যুদ্ধে গেছে বা আরসা কিংবা আলেকিনে যোগ দিয়েছে বলে যে কথা ছড়ানো হচ্ছে তা সঠিক নয়।

ইদ্রিস বলেন, হ্যাঁ আলেকিন বা আরসার অস্তিত্ব মিয়ানমারের আরাকানে আছে। তবে তাদের সংখ্যা সামান্য। শ’তিনেক হতে পারে বলে শুনেছি। কেবল অশিক্ষিত ও মুর্খদের তারা প্রথমে তাদের দলে নিতে পেরেছিলো। তবে এখন তারা অনেকেরই সমর্থন পাচ্ছে। ওপারে থাকতে এদের নাম এতো শুনিনি, এখানে এসে যতোটা শুনছি।

আমরা বর্মাইয়া রোহিঙ্গা, ওটাই আমাদের গর্বের পরিচয়
আমরা মনে প্রাণে বর্মাইয়া। আমাদের দেশ আরাকান। আমরা রোহান গোষ্ঠীর অধিবাসী এবং রোহিঙ্গা। এটাই আমাদের পরিচয়। কোন শর্তেই আমরা এ পরিচয় হারাতে চাই না। আমাদের পূর্ব পুরুষেরা শতশত বছর ধরে সেখানে বসবাস করছেন। বাংলাদেশে আমাদের শতকারা ৯৯ জনেরই এখন আর কোন আত্মীয় নেই। কারো হয়তো কোন কালেই ছিলো না। ১৯৮২ সালের পর থেকেই মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে কেবল আমাদের বাঙালি বলা হচ্ছে- বলছিলেন ইদ্রিস। এ সময় তিনি আবেগে থরথর করে কাঁপছিলেন।

তিনি বলে চলেন, আমরা মোটেও বাঙালি না। কিন্তু ওদেশের সরকার আমাদের বাঙালি বলছে। তারা বলছে, আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি। কিন্তু আমরা রোহান ভাষায় কথা বলি। এটা বাংলা নয়। প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় চট্টগ্রাম বা কক্সবাজারের ভাষার সঙ্গে আমাদের কিছু মিল আছে। তাই বলে আমাদের ভাষা বাংলা নয়। রোহিঙ্গা।  ছবি:দীপু মালাকার

আমরা এখন নেতা শূন্য, অভিভাবকহীন
ব্রিটিশদের কাছ থেকে দেশ স্বাধীনের সময় আমাদের নেতা ছিলেন ওং ছোয়েমন বা বীর আব্দুর রাজ্জাক। তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি আরাকানি মুসলিম ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রাণ পুরুষ ছিলেন। পুরো বার্মা তার অঙ্গুলি হেলনে চলতো। অং সান সুচির বাবা অং সান তার নেতা ও সেকেন্ড ম্যান ছিলেন। তারা দুজন মিলেই ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেটিক পার্টি বা এলডিপি গঠন করেছিলেন। অং সান এর সঙ্গে তাকেও সেনাবাহিনী হত্যা করে। সেই থেকে রোহিঙ্গাদের খারাপ সময় শুরু হয়। সর্বশেষ নেতা ছিলেন বিখ্যাত আর্ন্তজাতিক আইনজীবী এবং সুচির প্রধান আইন উপদেষ্টা উ কু নি। গতবছর তাকেও হত্যা করা হয়। তিনি ছিলেন রোহিঙ্গাদের শেষ প্রতিনিধি। যিনি রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সুচিকে প্রভাবিত করতে পারতেন। এভাবেই শিক্ষিত লোক যা ছিলো তাদের সবাইকেই শেষ করে দেয়া হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক বঞ্চনার ইতিহাস
১৯৮২ সালের আগে থেকেই তাহলে বলতে হবে। রোহিঙ্গা নেতাদের অনেকেই, ব্রিটিশরা ভারত ছাড়ার ঘোষণা দেওয়ার পরই ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্টি হতে যাওয়া নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে চান। এজন্য তারা ব্রিটিশ সরকার এবং মুসলিম নেতা কায়েদা আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গেও দেখা করেন। কিন্তু অং সাং এর বিরোধিতা করেছিলেন এবং জিন্নাহর কাছে আরাকান ভিক্ষা চেয়েছিলেন। জিন্নাহ হয়তো বুঝতে পারেন নি বলে আরাকানকে পাকিস্তানে নিতে আগ্রহী হননি। কিন্তু তার এ সিদ্ধান্তে লাখ লাখ মুসলমানের কপাল পুড়তে থাকে। আরাকানি মুসলমানরা বার্মাইয়া মগদের কাছে গাদ্দার বা বেইমান উপাধি পায়।

১৯৫৪ সাল থেকে আমাদের অধিকার ও মর্যাদা কেড়ে নিতে থাকে সরকার। যদিও পৃথিবীর সব দেশেই স্বাধীনতার পর মানুষের মর্যাদা বাড়তে থাকে। এর পর আরাকানকে এ কে আকিয়াব, এম ডি ডব্লিউ বা মংডু এবং বি ডি টি বা বুচিডং এ ভাগ করা হয়। তখন এই তিন অঞ্চলের মুসলিমদেরই আলাদা আলাদা পরিচয় পত্র দেওয়া হয়। সে পরিচয় পত্র বা কার্ডে আমাদের জাতীয়তা, ধর্মীয় পরিচয় এবং অরজিন উল্লেখ ছিলো না। তবে তখন সেই কার্ড নিয়ে আমরা সব স্থানেই যেতে পারতাম।

১৯৬২ সালে এসে আমাদের পুরোপুরি নাগরিকত্ব দেওয়া হবে বলে আগের পরিচয় পত্র কেড়ে নেওয়া হয়। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে একটি নতুন নাগরিকত্ব আইন করা হয়। ১৯৯০/৯১ সালে গিয়ে আমাদের এআইই (ক্যাপরা) সাদা কার্ড দেওয়া হয়। ওই কার্ডেই প্রথম আমাদের বাঙালি হিসেবে দেখানো হয়। আকিয়াবে থাকা রোহিঙ্গারা ওই কার্ড প্রত্যাখ্যান করলেও মংডু ও বুচিডং এর রোহিঙ্গারা সেই কার্ড নেয়।

সাংবাদিককে ঘিরে উৎসুক রোহিঙ্গারা।  ছবি: দীপু মালাকার ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনেও আমাদের ভোটাধিকার ছিলো। সে সময় আমাদের ৫ জন রোহিঙ্গা এমপিও নির্বাচিত হন। যেমন নাগপুরা এলাকা থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন, জহির আহমেদ ওরফে অং জু আং, বুচিডং এলাকা থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রখ্যাত হাবি দারোগার ছেলে ছোয়ে মং ওরফে আব্দুর রাজ্জাক।

২০১৫ সালে এসে আগে দেওয়া সাদা কার্ড বা ক্যাপরা কার্ড আবার আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হলো। এ সময় আমাদের দেওয়া একটি সাদা কাগজে কেবল রিসিট শব্দটি বার্মাইয়া ভাষায় লেখা ছিলো। জাতীয় নির্বাচনের সময় এসে বলা হলো, আমরা আর ভোট দিতেও পারবো না, নিতেও পারবো না।

নেতারা গৃহবন্দি ও পলাতক
২০০৮ সালের নির্বাচনে ৫ জন রোহিঙ্গা নেতা সেনা সমর্থিত রাজনৈতিক দল ক্যাং কারে থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরা হলেন, মাস্টার জাহাঙ্গীর, জাহিদুর রহমান, ডাক্তার বসির, জহির আহমেদ ও আব্দুর রাজ্জাক। এর মধ্যে আব্দুর রাজ্জাক ওরফে ছোয়ে মং সেনা সরকারের ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে এমপি থাকা অবস্থাতেই আমেরিকা পালিয়ে যান। অন্যরা সবাই রেঙ্গুনে গৃহবন্দি অবস্থায় আছেন। এমপি থাকা অবস্থাতেই তাদের গৃহবন্দি করা হয়। ২০১৫ সালের জাতীয় নির্বাচনে এরা প্রার্থী হতে পারেন নি।

সেনাবাহিনী জানতো রোহিঙ্গারা সুচিকে পছন্দ করে এবং সুচিকেই ভোট দেবে। তাই ষড়যন্ত্র করেই রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয় এবং প্রার্থী না হতে পারার আইন করা হয়।

জন্ম-মৃত্যু-শিক্ষা-বিয়ে ও জীবন যাপন
রোহিঙ্গাদের তিনটি সন্তান নেওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু এই তিন সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করাতে সরকারকে টাকা দিতে হয়। তবে নিবন্ধনের সময় মাকে তার বুকের দুধ সন্তানকে খাইয়ে দেখাতে হয় সরকারি কর্মকর্তাদের। সন্তান ওই মায়ের দুধ খেলেই কেবল নিবন্ধন করা হয়। সন্তান তিনের অধিক হলে কোনমতেই নিবন্ধিত করার সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে টাকাও কাজ করেনা। তবে বিকল্প ব্যবস্থা আছে। সরকারের পক্ষ থেকে পারিবারিক যে ছবি তোলা হয়, সেখানে সেইসব অনিবন্ধিত সন্তানের থাকার সুযোগ আছে মোটা টাকার বিনিময়ে।

রোহিঙ্গারোহিঙ্গা শিশুরা ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পারে। এর বেশি পড়ার সুযোগ নেই। আগে আমরা রেঙ্গুন পর্যন্ত যেতে পারতাম। সব ধরনের পড়াশোনা করা যেতো। এরপর আকিয়াব পর্যন্ত নির্ধারণ করা হলো। তারপর বুচিডং করা হলো। এখন মংডুর বাইরে যাওয়া যায় না। মংডুর যে কলেজ আছে, সেখানে রোহিঙ্গারা ভর্তি হতে পারে না। তাই রোহিঙ্গারা যতো মেধাবী হোকনা কেনো, ১০ ক্লাস পড়ার পর সবাইকে খিলি পানই বিক্রি করতে হয়।

বিয়ে করতে হলে আগে গ্রামের মেম্বারের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া যেতো। নতুন আইন অনুযায়ী চেয়ারম্যানের কাছে যেতে হয়। গরীবদের বিয়ে করতে সরকারকে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা দিতে হয়। অপেক্ষাকৃত ভালোদের ক্ষেত্রে তা দুই লাখ ৬০ হাজার। টাকা দিতে না পারলে বিয়ে শাদির সুযোগ নেই।

আগে রোহিঙ্গারাই চেয়ারম্যান হতে পারতো। এখন নতুন আইন অনুযায়ী নাটালা মগ বা বাইরে থেকে এনে বসানো মগরা চেয়ারম্যান হন। রোহিঙ্গারা মেম্বার হতে পারেন। তবে ব্যালটে ভোট হওয়ার কোন সুযোগ নেই। লোক দেখানো হাত তোলার ব্যবস্থা থাকলেও মূলত যে বেশি টাকা দিতে পারে, সেই মেম্বার হয়।

হাটে-বাজারে গেলে মগ হাট কর্তৃপক্ষ, বিক্রি করতে যে পণ্য নেওয়া হয় তার থেকে ভালোটা নিয়ে নেয়।

স্বাধীনতা নয়, চাই নাগরিকত্ব ও স্বাধীন ধর্মপালনের অধিকার
আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিমরা আরাকানের স্বাধীনতা চায় না। তারা চায় নাগরিকত্ব ও স্বাধীন ধর্ম পালনের অধিকার। এই দুই শর্তেই কেবল আমরা আরাকানে ফিরে যাবো। আমাদের পরিচয়পত্রে মংডুর পোয়াখালি লেখা থাকলেও মংডু যেতে পাঁচটি চেক পোস্টে আমাদের টাকা দিতে হয়। টাকা দিতে না চেয়ে কার্ডে মংডু লেখা আছে বললে বলে, তোমরা বাঙালি, তোমরা মুসলমান। তোমাদের টাকা দিতে হবে। এখানে বসবাস করলেও টাকা দিয়ে বসবাস করতে হবে।

আমরা স্বাধীনভাবে মসজিদে যেতে পারি না। মসজিদের জন্য প্রতি মাসে সরকারকে টাকা দিতে হয়। রমজান মাসে ভোর পাঁচটার আগে আলো জ্বালানো যায় না। আমরা সন্ধ্যারাতেই দেরি করে রান্না করে খেয়ে একবারে ঘুমাই। মংডুর বাইরে যাওয়ার অনুমতি না থাকায় আমরা হজ্ব করতেও পারি না। ২০১২ সাল পর্যন্ত কোরবানি দেওয়ার সুযোগ ছিলো। তখন দফাদারদের মাধ্যমে কারা কারা কোরবানি করবে তার তালিকা তৈরি করা হতো। সেই তালিকা অনুযায়ী আগে সরকারকে টাকা দিতে হতো। কোরবানি শেষে কোরবানির পশুর চামড়াটাও দিতে হতো। কিন্তু ২০১২ সালের পর থেকে আর কোরবানির সুযোগ পায়নি রোহিঙ্গারা। এ বছর ঈদের নামাজ পড়ারও অনুমতি মেলেনি।

সেনাবাহিনীর পুতুল জেনেও সুচিকেই পছন্দ রোহিঙ্গাদের
নামেই ক্ষমতায় আছেন। তার আসলে কিছুই করার নেই। জানতে পেরেছি তাকে জাতিসংঘে না যেতে বলেছে সেনাবাহিনী। তিনি সেনাবাহিনীর হাতের পুতুল। তার সরকারও একটা পুতুল সরকার। তার আসলে কোন ক্ষমতাই নেই। সে কিচ্ছু করতে পারবে না বলেই মনে করে রোহিঙ্গারা। কিন্তু আমাদের সম্পর্কে সুচি যা বলছেন, তা তার মনের কথা নয়। সেনাবাহিনী তাকে দিয়ে এইসব কথা বলাচ্ছে। কারণ তারা জানে আমরা সব কিছুর পরও সুচিকেই পছন্দ করবো। কারণ আমরা বিশ্বাস করি, তিনি আমাদের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন বলেই আনান কমিশন গঠন করেছিলেন। কিন্তু তা থামোনোর জন্যই আজ আরাকানে এই অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এ জন্যই  তার আইন উপদেষ্টাকে এক বছর আগে রেঙ্গুনে হত্যা করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৭১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।