ঢাকা, বুধবার, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ মে ২০২৪, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

এর নাম কি মানব জনম!

রহমান মাসুদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৯, ২০১৭
এর নাম কি মানব জনম! অস্থায়ী আশ্রয়স্থলে গাদাগাদি করে ঘুমিয়ে আছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা; ছবি- দিপু মালাকার

টেকনাফ, কক্সবাজার থেকে: রাত তখন  পৌনে ১২ টা। কক্সবাজার লিংক রোড থেকে শেষ ট্রিপের বাস ধরে টেকনাফের কাছাকাছি জাদি পাড়ায় পৌঁছেছি। আর হয়তো ১৫ মিনিট পরেই পৌঁছুবো টেকনাফ সদরে।

রাস্তায় চিৎকার আর হুড়োহুড়ির শব্দে সারাদিনের ভ্রমণ ক্লান্তিতে লেগে আসা চোখের পাতা খুলে গেলো। বিরক্তি আর ক্লান্ত চাহনিতে সামনে তাকিয়েই শুনতে পেলাম বাসের হেল্পার বলছেন, নেয়া যাবে না।

জায়গা নেই। তবে বাসযাত্রীদের অনুরোধে নরম হলো হেল্পারের মন। সারা শরীরে কাদামাটি মাখানো একদল মানুষ উঠে আসলো বাসের ভেতর।  

এ দলের নেতা ৬০ বছরের সেলিনা খাতুন। তার কোলে বছর তিনেকের এক শিশু ও হাতে উল্টো করে ধরা ছাতা আর পলিথিনে ভরা কয়েকটি বনরুটি। সঙ্গে দুই কিশোর নুরুল আর হাসিব, হাসিনা খাতুন নামে এক কিশোরী ও বছর আটেকের কালাম।  সবার হাতেই বিস্কুট অথবা রুটির প্যাকেট। কেবল সবার বড় হাসিবের হাতে একটি লাল বালতি আর হাসিনার হাতে পানির বোতল। সবার চোখেই রাজ্যের ক্লান্তি। চোখে ভয় আর অসহায় চাহনি। অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের পাহারা দিচ্ছেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা ; ছবি- দিপু মালাকার

সেলিনা বেগম কাঁপতে কাঁপতে এসে আমার পাশেই দাড়ালেন। ছোটরা পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। জানতে চাওয়ায় জানালো, মায়ানমারের মংডু  জেলা থেকে মাত্র এসে জাদিপাড়া ঘাটে নেমেছেন। যাবেন মুচনি বাজারে। সেখানে পরিবারের অন্য সবাই আছেন। সারাদিন জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলেন। সেখান থেকে পাশের গ্রাম জ্বলতে  দেখেছেন। সন্ধ্যার পর নদীর ঘাটে এসে এক মাছ ধরা নৌকায় নদী পার হয়েছেন। নৌকো ভাড়ায় যে কিয়েট (মায়ানমারের মুদ্রা) ব্যবহার করেছেন বাংলাদেশি টাকায় তার মূল্য ছয় হাজার টাকা। এরই মধ্যে বাস মুচনি বাজারে যখন পৌঁছুলো রাত তখন ১২টা পেরিয়েছে। নেমে গেলেন সেলিনা বেগম সদলবলে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বাজারের প্রতিটা ঘরের বারান্দা আর গলিতে শতশত শরণার্থী শুয়ে আছে। নারী, পুরুষ, শিশু। পুরুষের মধ্যে বৃদ্ধ আর কিশোরের সংখ্যাটাই বেশি। এ দৃশ্য দেখে ঈদের ছুটি কাটিয়ে রংপুর থেকে ফেরা টেকনাফ মডেল থানার পুলিশ কনস্টেবল আব্দুর রউফ বলে উঠলেন, এর নাম কি মানব জনম! বনের পশুর জীবনও এর চেয়ে নিরাপদ।

এর নাম কি মানব জনম/ছবি:দীপুরাত সাড়ে বারোটা। হোটেলে ব্যাগ রেখে ছুটলাম রাতের খাবারের খোঁজে। টেকনাফ তখন গভীর ঘুমে। কোনো রেস্টুরেন্ট খোলা পাওয়া গেলো না। হোটেলে ফেরার পথে একটি চালা ঘরে চুলা জ্বলতে দেখা গেলো। এগিয়ে গিয়ে দেখি পরোটা ভাজছেন তিনজন। লোডশেডিংয়ের অন্ধকার ঠেলে কাছে যেতেই বলা হলো কোন খাবার নেই। যে পরোটা বানানো হচ্ছে তা নতুন আসা রোহিঙ্গাদের সকালের নাস্তা। অর্ডার দিয়েছেন বিশেষ কেউ। যদিও বিশেষ অনুরোধে বিশেষ মূল্যে মিললো দুজনের জন্য দুই ডিম আর চার পরোটা।

অস্থায়ী আশ্রয়স্থলে সারি সারি ঘুমিয়ে আছে রোহিঙ্গা নারী-শিশু-বৃদ্ধরা ; ছবি- দিপু মালাকার পানি কিনতে ছুটলাম মসজিদের পাশে খোলা এক পান দোকানে। সেখানে লাঠি হাতে দাঁড়ানো কয়েকজন। মসজিদের বারান্দায় কয়েকজন নারী ও শিশু ঘুমিয়ে আছেন। আমরা তাদের অসহায়ত্বের দৃশ্য দেখছি। আমাদের ওপর কড়া নজর লাঠি হাতের পাহারাদারদের। এদের একজনের কাছে জানতে চাইলাম এরা কারা। তিনি জানালেন, রোহিঙ্গারা আজ এসেছে। আমরা পাহারা দিচ্ছি। মসজিদ কমিটি, তাবলীগ জামাতের পক্ষ থেকে তাদের খাওয়া ও কাপড়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সকালেই তাদের ক্যাম্পে পাঠানো হবে।  

ছবি তুলতে গেলেই বাধে বিপত্তি। অবশেষে মসজিদ থেকে বের হলেন এক মুরুব্বি। তিনি নিজেকে সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে পরিচয় দিলেন। আমাদের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে আশ্রিতদের ছবি তোলার অনুমতিও দিলেন। জানালেন, আল্লাহই অসহায়দের ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা করছেন! এবার তিনি নিয়ে গেলেন মসজিদের পেছনে মার্কেটের মধ্যে। মার্কেটের বারান্দায় ঠাসাঠাসি শতশত নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। পুরুষের সংখ্যা সেখানেও সামান্য।

বাংলাদেশ সময়: ০৫১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০,২০১৭
আরএম/আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।