সিনিয়র সাংবাদিক রাজীব নূর অবশ্য এরই মধ্যে অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ এর আদলে এই রাস্তার জনস্রোতের নাম দিয়েছেন, ‘সেপ্টেম্বর অন টেকনাফ রোড’।
কেবল সড়কই বলছি কেন? রোহিঙ্গারা ঢুকে পড়েছে এই সড়কের দুইপাশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে।
কিন্তু তাদেরও সামর্থ্য সীমিত। তারা এখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। সহযোগিতা অব্যাহত রাখলেও সক্ষমতা তেমন নেই বলে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করেছেন অনেকেই।
সেই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের অব্যাহত ঢলে এরই মধ্যে স্থানীয়দের তুলনায় রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ছাড়িয়ে যাওয়ায় নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন তারা।
অনেকেই এখন রোহিঙ্গাদের বাড়িতে আশ্রয় দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন, আবার বাড়িতে রান্না করে প্রতিদিন শতশত রোহিঙ্গাদের খাবারও যোগাচ্ছেন তারাই।
স্থানীয়রা বলছেন,মানবিক দিক বিবেচনা করে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে আসা লাখ লাখ জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেয়া আর সহানুভতি দেখিয়ে খাবার দেয়ার মধ্যেই সব সমস্যার শেষ নয়। সহানুভূতি দেখানোর পাশাপাশি টেকনাফ শহর ও নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে তাদের মনের মধ্যে এখন আতংক ও ক্ষোভও সৃষ্টি হয়েছে।
টেকনাফ, হোয়াইক্ষ্যং, হৃীলা, কুতুপালং, বালুখালি, সাবরাং, শামলাপুর, নয়াপাড়া এলাকায়, যাত্রীবাহী বাস, চায়ের দোকান, রেস্টুরেন্ট ও বিভিন্ন জটলায় ঢু মেরে এবং কথা বলে বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের এই অভিব্যক্তি জানা গেছে।
এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের ফলে টেকনাফে স্থানীয় পর্যায়ে পরিবহন সংকট দেখা দিয়েছে। বাজারে চাল ও আলুসহ সবজির দাম বেড়েছে। রোহিঙ্গাদের কারণে ভবিষ্যতে স্থানীয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান কমে বেকারত্ব আরো প্রকট হবে বলেই তারা আশঙ্কা করছেন।
হোয়াইক্ষ্যং ইউনিয়নের রইক্ষ্যং এলাকার কৃষক মাহমুদ নিজামউদ্দিন জানান, উনচি প্রাং এলাকায় তার জমি রয়েছে। প্রায় ১ লাখ নতুন রোহিঙ্গা আসার পর তার তিন কানি জমিতে নতুন বসতি স্থাপন করেছে। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। এই বিশাল এলাকায় স্থান সংকুলান হচ্ছে না। এরপর কিছুদিন আগে লাগানো ফসলের ক্ষেতের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। ফসলের জমিতেই রোহিঙ্গারা পরিবার পরিজন নিয়ে বসে পড়েছে। এতে তার এক লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। সমস্ত শীতকালীন সবজি নষ্ট হয়ে গেছে।
স্থানীয়দের মতে, রোহিঙ্গারা যে বাঙ্গালিদের কতটা অবজ্ঞার চেখে দেখে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। বিদেশে এমন নজির অনেক। সৌদি আরবে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিকদের চেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে আছে। তারা বাঙ্গালিদের নানাভাবে ক্ষতি করে। সব সময় বাঙ্গালিদের বিরুদ্ধে কাজ করে। বাঙ্গালিদের গালি দেয়। বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়েই তারা সৌদি আরবে গিয়েছে। অথচ সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে বেঈমানি করতে প্রস্তুত।
রোহিঙ্গাদের এ ধরনের আচরণ নিয়ে তৈরি রিপোর্ট সরকারকে এর আগেও দেয়া হয়েছে বলে জানান ওই এলাকার এক বাসিন্দা। টেকনাফের ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন বলেন, রাখাইন প্রদেশের মংডু ও আকিয়াবের অনেক ব্যবসায়ীর সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে। ব্যবসায়িক লেনদেন আছে। তারা ধর্মীয় দিক থেকে আমাদের স্বজাতি। অনেক বছর ধরে তাদের সঙ্গে ব্যবসা চলছে।
স্থানীয়দের মতে, ইতিপূর্বে যেসব রোহিঙ্গা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে এসেছে, তাদের একটি বড় অংশ স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে গেছে। এখন অনেকেই টেকনাফের ব্যবসায়ী। নিজেদের রোহিঙ্গা বলে পরিচয় দেন না। কিন্তু মনেপ্রাণে এখনো তারা মিয়ানমারের প্রতি দুর্বল। তারা বাংলাদেশে বসবাস করলেও এদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি অনুগত নয়। এই রোহিঙ্গারাই বাংলাদেশে ইয়াবা ট্যাবলেটের মতো একটি ধ্বংসাত্মক নেশা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে। ইয়াবা আমাদের জাতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এখন যারা এসেছে তাদের একই ভূমিকায় থাকাও অসম্ভব না।
স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষোভ থাকলেও নিজেদের সামর্থে্যর সর্বোচ্চটুকু দিয়ে এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন স্থানীয়রা। স্থানীয়রা পাশে এসে না দাঁড়ালে আরও কঠিন মানবিক বিপর্যয়ের শিকার হতেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা, টেকনাফে সরেজমিনে ঘুরে বিষয়টি স্পষ্ট। তবে স্থানীয়দের মতে, তাদের সামর্থ্য সীমিত। এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাসস্থান ও তাদের অন্যান্য মৌলিক প্রয়োজনের চাহিদা মেটানোর ব্যাপারে সরকারকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর সাহায্য নিতে হবে। পাশাপাশি জাতিসংঘ সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামে রোহিঙ্গাদের সমস্যার ব্যাপারে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। সিরিয়া ও ইরাকের থেকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পরিস্থিতি কোনো অংশে কম সঙ্কটময় নয়। সেখানে যেভাবে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো ত্রাণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশেও রোহিঙ্গাদের জন্য তাদের সেভাবে কার্যক্রম চালাতে হবে।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে সাথে নিয়ে এখনই রোহিঙ্গাদের নির্দিষ্ট আশ্রয় শিবিরে পুনর্বাসনের জন্য সরকারের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন স্থানীয়রা।
তাদের মতে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া এই রোহিঙ্গাদের জন্য নির্দিষ্ট এলাকায় শরণার্থী শিবির খোলার পাশাপাশি সেখানে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য, চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় সব মৌলিক সেবার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে স্থানীয় জনগণের উপর চেপে বসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এই বোঝা হালকা হবে।
পাশাপাশি মিয়ানমার যেন দ্রুত এই শরণার্থীদের নিজেদের দেশে ফেরত নেয় সে ব্যাপারেও সরকারকে তৎপর হওয়ার তাগিদ দেন স্থানীয়রা।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৭
আরএম/আরআই