ঢাকা, বুধবার, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ মে ২০২৪, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

প্রাণে বাঁচার আনন্দ, ধন্যবাদ বাংলাদেশ 

রহমান মাসুদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৭
প্রাণে বাঁচার আনন্দ, ধন্যবাদ বাংলাদেশ  এভাবেই পরিবার-পরিজন নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা। ছবি: দীপু মালাকার

টেকনাফ (কক্সবাজার) থেকে: সম্ভবত ক্লাস সিক্সে র‌্যাপিড ইংলিশ স্টোরি’তে একটি রুশ গল্প পড়েছিলাম। শিরোনাম ছিলো, ‘মানুষ কী নিয়ে বাঁচে’। এই গল্পে ঈশ্বর তার অভিশপ্ত দূতকে অপরাধের শাস্তি স্বরূপ পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন এটা জানতে যে, মানুষ  কি নিয়ে বাঁচে! 

গল্পের সেই দূত পৃথিবীতে এসে দেখেছিলেন, মানুষ আসলে সততা ও সরলতা, অহেতুক লোভ-লালসা নিয়েই বাচেঁ। স্বর্গের ওই দূত পৃথিবীতে পাওয়া এই শিক্ষা আর অভিজ্ঞতার কথা ঈশ্বরকে জানালে, ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করে দেন।

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে মিয়ানমার থেকে আসা লাখ লাখ মানুষের জীবন হাতে করে পালিয়ে আসার গল্প, অভিজ্ঞতার ভয়াবহ বর্ণনা শুনলে এবং কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে নিঃশ্ব অবস্থায় তাদের বাংলাদেশে আসার আনন্দ দেখলে যে কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ‘মানুষ আসলে কী নিয়ে বাচেঁ’!

দুইদিন হলো টেকনাফে এসে মিয়ানমার থেকে আসা লাখ লাখ মানুষের (রোহিঙ্গা মুসলিম) যে কয়জনের সঙ্গে কথা হয়েছে, তাদের সবার মুখেই একই ধরনের গল্প; যাতে ছিল তাদের ফেলে আসা ভয়াবহ নৃশংসতার গল্পও।  
তাদের কণ্ঠে যেমন স্বজন হারানোর কাতরতা দেখেছি। তেমনি দেখেছি সব হারিয়ে নিঃশ্ব হয়ে ফের ঘুরে দাড়াঁনোর কথা বলতেও। ক্ষুধা মেটাতে ত্রাণের গাড়ির দিকে ছুটে যেতে।

বালুখালী ক্যাম্পে চলছে রোহিঙ্গা শরাণার্থীদের নিবন্ধন।  ছবি: দীপু মালাকার আবার ক্যাম্পে গিয়ে নাম নিবন্ধনের (সাক্রাইন) মানুষ খুঁজতে, ঝুপড়ি তোলার স্থান সংস্থানের চেষ্টা করতে এবং স্থান পেলে বাঁশ, আর পলিথিন দিয়ে ঘর বানাতে। এদের মধ্যেই কেউবা পাহাড় কেটে জমি ঠিক (সমতল) করছেন। সবারই চেষ্টা কোনো মতে বেঁচে থাকা।  

বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ স্ত্রী-স্বজনসহ পরিবারের সবাইকে হারিয়েও তিন মাসের বাচ্চা নিয়ে ক্যাম্পে এসে আশ্রয় খুঁজছেন। আর বলছেন, ‘এই আমার জীবন, কেবল এর জন্যই চারদিন হেঁটে এতো দূরে এসেছি!’

টেকনাফের পালংখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে পাঁচ কিলোমিটার এগোলেই আঞ্জুমানপাড়া গ্রাম। এই গ্রামের শেষপ্রান্ত থেকে নাফ নদীর পাড় পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটারের বেশি এলাকায় স্থানীয় লোকজনের মাছের ঘের।  

এখানে নাফ নদীর প্রশস্ততা একটি বড় খালের সমান। নদীর দিকে তাকালে চোখে পড়ে নাফের ওপার থকে ঘেরের পাড় ধরে সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে আসা শতশত রোহিঙ্গা নর-নারীর ঢল।  

এরই মধ্যে ঘেরের অন্তত ১০ কিলোমিটার পাড়ে অস্থায়ী ছাউনি তুলে অবস্থান নিয়েছেন কমপক্ষে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি সদস্যরা তাদের ঘেরের পাড়ে বসিয়েছেন।  

বিজিবির পাহারা ও টহলের মধ্যেই তাদের ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের কর্মীরা। ঘেরের পাড়ে দাঁড়িয়ে কথা হয় মোহাম্মদ ফাইজুল্লাহর সঙ্গে। যিনি রাখাইনে সৈন্য বাহিনীর নির্যাতনের ভয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।  

বুচিডং টাউনশিপের টং বাজার এলাকা থেকে মাত্রই নদী সাঁতরে এপারে এসেছেন ফাইজুল্লাহ। এখনও তার ভেজা লুঙ্গি শুকায়নি।  

বাংলানিউজকে তিনি জানান, এ পর্যন্ত আসতে চারদিন ধরে ছোট বড় ১০টি পাহাড় পেরুতে হয়েছে তাকে। এরমধ্যে বড় দুইটি খাড়া পাহাড় পার হতেই লেগেছে দুইদিন। টংবাজার গ্রামে বসবাসরত ৪৫০টি রোহিঙ্গা মুসলিম পরিবারের মধ্যে তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থাই সবচেয়ে ভালো ছিল।  

আঞ্জুমানপাড়া এলাকায় রোহিঙ্গাদের অবস্থান।  ছবি: দীপু মালাকার ‘১৬ কানি ( ৪০ শতক=এক কানি) কৃষি জমি ও বড় একটি দোকান ছিল তার। দোকানে প্রায় দুই হাজার লাখ কিয়াট বা ৭০ লাখ টাকার মালামাল ছিলো। বাড়ি ও দোকান সেনা সহায়তায় মগরা পুড়িয়ে দিয়েছে। ’

ফাইজুল্লাহ বলেন, প্রথমে ৪০০ পরিবার জীবন বাচাঁতে বাংলাদেশে আসলেও আমরাসহ অপেক্ষাকৃত অবস্থা সম্পন্ন প্রায় ৫০টি পরিবার থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। এরপর সেনাবাহিনী মগদের সঙ্গে এসে বলে ‘জান বাঁচাতে চাস, না সম্পত্তি পাহারা দিতে চাস। তোরা বাঙালি, এদেশে তোদের কোনো সম্পত্তি থাকতে পারবে না! এরপরই তারা আমার বাড়িটা ও দোকানটায় আগুন ধরিয়ে দেয়।  বালুখালী শরণার্থী ক্যাম্প।  ছবি: দীপু মালাকার কান্নাজড়িত কণ্ঠে রাখাইন থেকে বিতাড়িত এই অধিবাসী বলেন, এরপরই আমি আমার ছয় সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে পালিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিই। আসার পথে প্রায় সবখানেই ছিল মরার ভয়। কিন্তু নাফ পাড়ি দিয়ে এপার আসার পর মনে হয়েছে, বেঁচে গেছি। আর এ আনন্দ বর্ণনা করা কঠিন। আমাদের জায়গা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ।  বালুখালী ক্যাম্প সংলগ্ন সড়কে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণ দেওয়া হয়।  ছবি: দীপু মালাকার তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি মানুষ না খেয়ে মরে না। আমিও মরবো না। যদি ঘর তোলার জমি না পাই, আমাকে পানিতে শোয়ায়ে দিলেও আমি পানিতে ঘুমাতে পারবো। আমার মনে হয়, মানুষের কেবল পিঠ রাখার জমিনটাই দরকার।

এদিকে সোমবার দুপুরে উখিয়ার বালুখালঅ নতুন ক্যাম্পের পাশের কক্সবাজার-টেকনাফ সড়য়ে হেঁটে আসার সময় এগিয়ে এলেন আব্দুর রহমান। কোলে তিনমাসের কন্যা নূর আফসা।  

এই জগতে আর কেউ স্বজন নেই মংডুর হাওয়ার বিল এলাকার এই বাবা-মেয়ের।  
পালানোর সময় সৈন্য বাহিনীর গুলিতে মারা যায় মংডুর হাওয়ার বিলের আব্দুর রহমানের স্ত্রী, পরে তিন মাসের শিশুকে নিয়েই পালিয়ে আসেন বাংলাদেশে।  ছবি: দীপু মালাকার
আব্দুর রহমান জানান, গত শুক্রবার তাদের গ্রামে যখন সেনাবাহিনী ও রাখাইন বৌদ্ধ পুরুষরা হামলা চালায়, তখন তিনি ও তার স্ত্রী সখিনা এবং কন্যা হাফসাকে নিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে পালান। তখন পেছন থেকে গুলি লাগে সখিনার পিঠে। গুলি সখিনার বুক দিয়ে বেরিয়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে স্ত্রী। প্রাণ বাঁচাতে কন্যাকে নিয়ে তিনি বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। কিন্তু দাফন করতে পারেননি স্ত্রীর।  

‘কেবল এই কন্যার জন্যই বাংলাদেশে এসেছি। এর জন্যই বেচেঁ থাকবো,’ বলেন রহমান।  

আরও পড়ুন
**
ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদছে শিশু
**রোহিঙ্গাঢলে হুমকির মুখে পর্যটন শিল্প
**কত রোহিঙ্গা এসেছে, সঠিক হিসেব নেই কারো কাছে
**
সক্রিয় দালালচক্র, পুঁজি রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ
**রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ৪ চেকপোস্ট
**‘ওপারে বাদশা ছিলাম, এপারে ফকির হলাম’
**পাহাড়-বন দখল করে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের বসতি
**‘ওপারে বাদশা ছিলাম, এপারে ফকির হলাম’
**মঙ্গলবারের মধ্যেই রোহিঙ্গাদের মায়ানমার ছাড়ার আলটিমেটাম
**স্ত্রীদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে স্বামীরা
**গাড়ি দেখলেই রোহিঙ্গাদের আর্তি ‘খাবার দিন’
**মাকে কাঁধে নিয়ে ২৯ মাইল হেঁটে এপারে সাইফুল্লাহ

বাংলাদেশ সময়: ০২৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৭
আরএম/এমএ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।