মন্তেভিদিওতে প্রথম বিশ্বকাপের ফাইনালে হারের ৪৮ বছর পর, অবশেষে নিজেদের ঘরের মাঠ বুয়েনস আইরেসে বিশ্বজয়ের স্বাদ পেয়েছিল আর্জেন্টিনা। এটি ছিল একাদশ বিশ্বকাপ, যার মধ্যে পাঁচবার শিরোপা জিতেছিল আয়োজক দেশ।
আর্জেন্টিনাকে এই টুর্নামেন্টের আয়োজক স্বত্ব দেওয়া হয়েছিল ১২ বছর আগে, কিন্তু এর মধ্যে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। জেনারেল হোর্হে রাফায়েল ভিদেলার নেতৃত্বে সামরিক জান্তা দেশের ক্ষমতা দখল করে। আর্জেন্টিনায় তখন চলছিল চরম সহিংসতার এক অন্ধকার যুগ। এমনকি বিশ্বকাপের আয়োজক কমিটির প্রধান জেনারেল ওমর অ্যাকটিসকেও হত্যা করা হয়।
মাঠের দিকে তাকালে, আর্জেন্টিনার সেই দলটি অসাধারণ প্রতিভাবান খেলোয়াড়ে ঠাসা ছিল না, কিন্তু ঘরের মাঠে তারাই ছিল টুর্নামেন্টের অন্যতম দাবিদার। দলের প্রতিটি বিভাগে ছিলেন একজন করে তারকা: রক্ষণে অধিনায়ক দানিয়েল পাসারেলা, মাঝমাঠে ওসভালদো আরদিলেস এবং আক্রমণে গোলমেশিন মারিও কেম্পেস। এই ত্রিভুজকে কেন্দ্র করেই আর্জেন্টিনা স্মরণীয় ফাইনালে নেদারল্যান্ডসকে অতিরিক্ত সময়ে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বসেরার মুকুট পরে।
‘এল ফ্লাকো’ মেনোত্তি: দর্শনের জাদুকর
লম্বা, পাতলা গড়নের এবং দীর্ঘ চুলের কোচ সিজার লুইস মেনোত্তির বয়স ছিল মাত্র ৩৯। টুর্নামেন্টজুড়ে অবিরাম ধূমপান করে যাওয়া এই মানুষটি ছিলেন এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। ডানপন্থী সামরিক স্বৈরাচারের অধীনে থেকেও তিনি ছিলেন একজন কট্টর বামপন্থী দার্শনিক। তিনি ক্ষমতা থেকে দূরত্ব বজায় রাখলেও জানতেন, টিকে থাকতে হলে শাসকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা জরুরি।
মেনোত্তি আর্জেন্টিনার রক্ষণাত্মক ফুটবল দর্শনকে ঘৃণা করতেন। তিনি এমন একটি দল গড়তে চেয়েছিলেন, যা দেশের মানুষের সাথে একাত্ম হতে পারবে। কেম্পেসের ভাষায়, ‘তার সবচেয়ে বড় গুণ ছিল খেলোয়াড়দের স্বাধীনতা দেওয়া। তিনি তিন-চারটি কাজ বুঝিয়ে দিতেন, কিন্তু তার বাইরে খেলোয়াড়রা ক্লাবের মতো করেই খেলার পূর্ণ স্বাধীনতা পেত। ’
মেনোত্তি বিশ্বকাপের আগে দীর্ঘ প্রশিক্ষণ শিবির করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল বর্ষপঞ্জির ভিন্নতার কারণে তারকাদের পাওয়া কঠিন ছিল। তাই তিনি ২৫ বছরের কম বয়সী খেলোয়াড়দের বিদেশে খেলায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন এবং শেষ পর্যন্ত স্কোয়াডে দেশের বাইরে খেলা একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে মারিও কেম্পেসকে বেছে নেন। এই সিদ্ধান্তই শেষ পর্যন্ত সফল প্রমাণিত হয়েছিল।
নায়ক ‘এল মাতাদোর’ কেম্পেস
টুর্নামেন্টের আগে স্পেনের ঘরোয়া লিগে টানা দুই মৌসুম সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ায় মারিও কেম্পেসই যে তারকা হবেন, তা প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু ১৯৭৪ বিশ্বকাপে গোল করতে না পারা কেম্পেস এই টুর্নামেন্টেও ধীরগতিতে শুরু করেন। কিংবদন্তি আলফ্রেদো দি স্তেফানো এক সাক্ষাৎকারে তার সমালোচনাও করেছিলেন।
কিন্তু দ্বিতীয় গ্রুপ পর্বে জ্বলে ওঠেন কেম্পেস। পোল্যান্ড ও পেরুর বিপক্ষে দুটি করে গোল করার পর ফাইনালেও করেন জোড়া গোল। তিনি টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে ‘গোল্ডেন বুট’ এবং সেরা খেলোয়াড় হিসেবে ‘গোল্ডেন বল’ জেতেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, মাত্র ২৩ বছর বয়সে ফাইনালে করা গোলগুলোই ছিল আর্জেন্টিনার জার্সিতে তার শেষ গোল।
মাঠের কৌশল ও খেলার ধরন
মেনোত্তির দল খেলত আক্রমণাত্মক ও ছন্দময় ফুটবল, যা ছিল সত্তরের দশকের ব্রাজিল বা ডাচ ফুটবলের মতো। আর্জেন্টিনার চিরাচরিত আগ্রাসী ও রক্ষণাত্মক খেলার ধরনের বদলে তাদের খেলার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল আপেক্ষিক কোমলতা। দলের ডিফেন্ডাররা প্রতিপক্ষকে আটকানোর চেয়ে আক্রমণে যাওয়াই বেশি পছন্দ করতেন।
ফাইনাল
আর্জেন্টিনায় এই টুর্নামেন্ট আয়োজনের অন্যতম কঠোর সমালোচক ছিল ডাচরা এবং তারা বিশ্বকাপ পুরোপুরি বয়কট করার কথাও ভেবেছিল। সম্ভবত ফাইনালের আগে আর্জেন্টিনার কূটচালের পেছনে এটি একটি কারণ ছিল: নেদারল্যান্ডসের সাথে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণ দেখিয়ে তারা ইসরায়েলি রেফারিকে পরিবর্তনের দাবি জানায়, ডাচদের টিম বাসকে অপ্রয়োজনীয় দীর্ঘ পথ ঘুরিয়ে এস্তাদিও মনুমেন্তাল স্টেডিয়ামে নিয়ে আসে, মাঠে নামার পর প্রচণ্ড হর্ষধ্বনির মধ্যে আর্জেন্টাইনদের জন্য ডাচদের পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করায় এবং সবশেষে, রেনে ফন ডি কারখফের হাতে থাকা হালকা একটি আবরণ নিয়েও আপত্তি জানায়, যা তিনি পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই পরেছিলেন।
মাঠ থেকে বেশিরভাগ কাগুজে ফিতা পরিষ্কার করার পর যখন খেলা অবশেষে শুরু হলো, তখন মনে হচ্ছিল এই সব ঘটনায় নেদারল্যান্ডস কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে। তারা অস্বাভাবিকরকম শারীরিক ফুটবল খেলতে শুরু করে, যা সম্ভবত স্পেনের বিপক্ষে তাদের কুখ্যাত ২০১০ সালের ফাইনালের একটি পূর্বাভাস ছিল।
কৌশলগতভাবে, ফাইনালের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল দুই গোলরক্ষককে নিয়মিত অদ্ভুত অবস্থানে খুঁজে পাওয়া। তারা প্রায়শই মাঠের প্রান্তের দিকে থাকা আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের আটকাতে ছুটে যাচ্ছিলেন। গোলপোস্ট নিয়মিত অরক্ষিত থেকে যাচ্ছিল, কারণ গোলরক্ষকরা এমন খেলোয়াড়দের কোণ ছোট করার বিষয়ে অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন ছিলেন, যারা আধুনিক ফুটবলের পরিভাষায় কেবল ‘কাট-ব্যাক’ করার মতো অবস্থানে ছিলেন। কিন্তু যখন দুজন গোলরক্ষক পাঁচ এবং আট নম্বর জার্সি পরেছিলেন, তখন হয়তো এটাই প্রত্যাশিত ছিল।
কেম্পেস এগিয়ে আসা গোলরক্ষক ইয়ান ইয়ংব্লাডকে পাশ কাটিয়ে একটি চতুর স্লাইডিং ফিনিশিংয়ে গোল করে আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দেন। এরপর ডিক নানিঙ্গার হেডে করা সমতাসূচক গোলের সময় আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক ফিওল অনেক বেশি প্রান্তের দিকে ছিলেন। একইভাবে, খেলার শেষ মুহূর্তে ডাচ ফরোয়ার্ড রব রেনসেনব্রিঙ্কের শট যখন পোস্টে লাগে, তখনও তিনি গোলপোস্ট থেকে বেশ দূরে ছিলেন।
১৯৭৪ সালের ডাচ দলের ফাইনালের কাছাকাছি যাওয়ার কথা যতটা বলা হয়, তার চেয়েও বেশি কাছাকাছি গিয়েছিল ১৯৭৮ সালের দলটি। যদিও এই দলটি ততটা আকর্ষণীয় ছিল না।
বিতর্কিত মুহূর্ত
আসলে দুটি বিতর্কিত মুহূর্ত ছিল। অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধের শেষ মুহূর্তে কেম্পেস তার দ্বিতীয় গোলটি করেন। তিনি দুজন ডাচ ডিফেন্ডার এবং গোলরক্ষক ইয়ংব্লাডকে পাশ কাটিয়ে অগোছালোভাবে একটি শট নেন, যা ভিম সুরবিয়ারের পায়ে লেগে জালে জড়ায়। প্রযুক্তিগতভাবে এটি একটি আত্মঘাতী গোল ছিল, যদিও কেম্পেসের কাছ থেকে গোলটি কেড়ে নেওয়াটা সঠিক মনে হয়নি।
ডাচরা যখন গোল শোধ করতে মরিয়া, তখন আর্জেন্টিনার প্রধান শক্তি সামনে এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতা। যা প্রতি-আক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণিত হয় এবং তারা খেলা শেষ করার কয়েকটি সুযোগ পায়। অবশেষে, তারা আরও একটি অগোছালো গোলের মাধ্যমে জয় নিশ্চিত করে। বার্তোনি মাঝমাঠে কেম্পেসকে বল দেন, তিনি ড্রিবল করে এগিয়ে যান এবং তার ফিরতি পাস প্রথমে বার্তোনির হাঁটুতে, তারপর কেম্পেসের বুকে এবং আবার বার্তোনির গায়ে লেগে তার কাছেই ফিরে আসে এবং তিনি বলটি জালে জড়িয়ে দেন। এই পিনবলের মতো মুভমেন্টে ইয়ংব্লাড বিভ্রান্ত হতেই পারেন, কিন্তু এবারও তিনি একটি অদ্ভুত অবস্থানে ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, ফাইনালের চারটি গোলের ক্ষেত্রেই গোলরক্ষকদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে।
‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’-এর অ্যালেক্স ইয়ানিস এই দৃশ্য দেখে খুব একটা মুগ্ধ হননি। তিনি লিখেছিলেন, ‘আর্জেন্টাইনরা অতিরিক্ত সময়ের বেশিরভাগ সময় মাটিতে শুয়ে কাটিয়েছে, দাবি করেছে যে তাদের ফাউল করা হয়েছে এবং ইতালীয় রেফারির কাছে ফাউলের জন্য আবেদন করেছে। তারা সম্ভবত মূল বিষয়টি ভুলে গিয়েছিল যে, এটি একটি ফুটবল ম্যাচ, যা বিশ্বজুড়ে প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ দেখছিল। ’
আর্জেন্টিনা কি আসলেই সেরা দল ছিল?
এটা সাধারণত স্বীকার করা হয় যে, এটি এমন একটি বিশ্বকাপ ছিল যেখানে সত্যিকারের কোনো অসাধারণ দল ছিল না; যেমনটা ১৯৭০ সালের ব্রাজিল এবং ১৯৭৪ সালের নেদারল্যান্ডস তাদের আক্রমণাত্মক ফুটবল দিয়ে বিশ্বের কল্পনাকে নাড়া দিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, এমন একটি অনুভূতি ছিল যে বিশ্ব ফুটবলে কেবল সেরা দলেরই নয়, সেরা খেলোয়াড়েরও অভাব ছিল। সেই সময়ে ব্যালন ডি'অর-এর (যা কেবল ইউরোপীয় খেলোয়াড়দের জন্য উন্মুক্ত ছিল) ধারক ছিলেন ডেনমার্কের অ্যালান সিমোনসেন, যিনি সম্ভবত এই পুরস্কারের সবচেয়ে স্বল্প পরিচিত বিজয়ী।
এটিও উল্লেখ্য যে, আর্জেন্টিনা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভাগ্যক্রমে সুবিধা পেয়েছিল: আয়োজক হওয়া, ফ্রান্সের বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের জয়ে কিছু অনুকূল রেফারির সিদ্ধান্ত এবং দ্বিতীয় রাউন্ডের শেষ ম্যাচে তাদের কী ফলাফল প্রয়োজন তা আগে থেকেই জানা, কারণ ব্রাজিল দিনের শুরুতে খেলেছিল। পেরুর বিপক্ষে সেই ৬-০ গোলের জয়টি নিয়ে পরবর্তীতে ‘দ্য সানডে টাইমস’-এ প্রকাশিত একটি বিস্তারিত তদন্তে ম্যাচটি পাতানো হয়েছিল বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়।
কিন্তু আর কেই বা ছিল? ব্রাজিল তাদের পূর্ববর্তী সাফল্যের সেই ছন্দ হারিয়েছিল। ডাচরা ইয়োহান ক্রুইফকে ছাড়া খেলছিল এবং চার বছর আগের চেয়ে বেশি যান্ত্রিক ছিল। ফ্রান্সকে দেখতে ভালো লাগলেও তারা দুর্ভাগ্যবশত প্রথম গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছিল।
‘ওয়ার্ল্ড সকার’ পত্রিকার এরিক ব্যাটি লিখেছিলেন, ‘আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতেছিল কারণ তারা এর যোগ্য ছিল। তারা দেখিয়েছে খেলাটা কীভাবে খেলা উচিত, যেখানে বুদ্ধিমান খেলোয়াড়রা প্রতিপক্ষের তারকাদের আটকানোর কথা না ভেবে সবসময় আক্রমণে যায়। ’
এমএইচএম