গত সেপ্টেম্বরের শেষে যখন উসমান দেম্বেলে ২০২৩ সালের ব্যালন ডি'অর উঁচিয়ে ধরছেন, তখন নেইমার হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে বছরের তৃতীয় চোটের চিকিৎসা নিচ্ছিলেন এবং একইসঙ্গে একটি অনলাইন পোকার টুর্নামেন্টে অংশ নিচ্ছিলেন। সেই টুর্নামেন্টে ৩৩ বছর বয়সী এই ব্রাজিলিয়ান তারকা দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে প্রায় ৭৩ হাজার ৮০০ পাউন্ড প্রাইজমানি জেতেন।
একসময় বার্সেলোনায় যার জায়গায় খেলতে এসেছিলেন, সেই দেম্বেলেকে স্বপ্নের ট্রফি জিততে দেখার দিনে এই অর্থ ছিল নেইমারের জন্য এক ছোট সান্ত্বনা মাত্র।
জানুয়ারিতে শৈশবের ক্লাব সান্তোসে ফেরার পর থেকে নেইমার প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন। ফুটবলের চেয়ে মাঠের বাইরের নানা কর্মকাণ্ডের জন্যই তিনি বেশি মনোযোগ কেড়েছেন। ১২ মৌসুম পর তার ঘরে ফেরাটা পিএসজি এবং সৌদি আরবের আল হিলালে হতাশাজনক অধ্যায় শেষে খেলায় মনোযোগ ও হারানো ফর্ম ফিরে পাওয়ার একটি সুযোগ হিসেবে দেখা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা সব পক্ষের জন্যই চরম হতাশায় পর্যবসিত হয়েছে।
ব্রাজিলে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, নেইমার কি ২০২৬ বিশ্বকাপে খেলতে পারবেন? তার হাতে সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।
১৯৭০ বিশ্বকাপজয়ী কিংবদন্তি তোস্তাও তার কলামে লিখেছেন, ‘তারকাদেরও প্রমাণ করতে হয় যে তারা ফিট। তার জন্য সময় ফুরিয়ে আসছে। ’
বুধবার ব্রাজিল কোচ কার্লো আনচেলত্তি দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের বিপক্ষে ম্যাচের জন্য দল ঘোষণা করেছেন এবং সেখানে আবারও নেইমারের নাম নেই। সান্তোসে তাকে ‘প্রিন্স’ বা ‘যুবরাজ’ নামে বরণ করে নেওয়া হয়েছিল, যা ছিল ‘রাজা’ পেলের প্রতি সম্মান। কিন্তু সেই ‘প্রিন্স’ এখনও আনচেলত্তির অধীনে একটি ম্যাচও খেলেননি। গত দুই বছর ধরে তিনি সেলেসাওদের হয়ে মাঠের বাইরে। ব্রাজিলের জার্সিতে তার শেষ ম্যাচ ছিল ২০২৩ সালের অক্টোবরে উরুগুয়ের বিপক্ষে, যেখানে দল ২-০ গোলে হেরেছিল।
নভেম্বরের ম্যাচগুলোতেও তার খেলা নিয়ে রয়েছে গুরুতর সংশয়। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে, বিশ্বকাপের চূড়ান্ত দল ঘোষণার আগে নিজেকে প্রমাণের জন্য তিনি কেবল ২০২৬ সালের মার্চে দুটি প্রীতি ম্যাচ সময় পাবেন।
নেইমারকে নিয়ে ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি কাফু বলেন, ‘১৫ বছর ধরে নেইমার ব্রাজিলের মূল তারকা ছিলেন, যিনি একাই প্রত্যাশা আর দায়িত্বের বোঝা বয়ে বেড়িয়েছেন। কিন্তু কেউ একা বিশ্বকাপ জেতে না। এই মুহূর্তে তার ওপর সব আশা রাখা কঠিন, কারণ সে পরপর তিনটি ম্যাচ খেলতেও সংগ্রাম করছে। ’
সান্তোসে ফেরার পর নেইমার কেবল বারবার চোটে পড়েননি, যখনই মাঠে নেমেছেন, তাকে তার সেরা ফর্মের ছায়ামাত্র মনে হয়েছে। এই মৌসুমে তিনি দলের ৪৭ শতাংশ ম্যাচ খেলতে পারেননি। এখন পর্যন্ত ৯টি গোলে অবদান রেখেছেন, যার মধ্যে ৫টিই ব্রাজিলের শীর্ষ লিগের নিচের সারির দলের বিপক্ষে।
সোফাস্কোরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ম্যাচে সফল ড্রিবলের হিসাবে তিনি লিগে ৫০তম স্থানে রয়েছেন, যা তার নামের সঙ্গে একেবারেই বেমানান।
তা সত্ত্বেও, আনচেলত্তি জোর দিয়ে বলেছেন যে নেইমারের সামনে বিশ্বকাপে প্রস্তুত হওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় আছে। তবে গত মাসে কোচের একটি মন্তব্য ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়। আনচেলত্তি প্রথমে দাবি করেন, ফিটনেসজনিত উদ্বেগের কারণে নেইমারকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু নেইমার নিজেই তা অস্বীকার করে বলেন, ‘আমাকে প্রযুক্তিগত কারণে বাদ দেওয়া হয়েছে, আমার শারীরিক অবস্থার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। ’ পরে আনচেলত্তি স্বীকার করেন যে এটি একটি ‘প্রযুক্তিগত সিদ্ধান্ত’ ছিল।
এই ঘটনা নেইমারের ভাবমূর্তিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কাফুর মতে, ‘বিশ্বকাপ জেতানোর জন্য আমরা যার ওপর সব আশা রেখেছি, তাকে যদি প্রযুক্তিগত কারণে বাদ দেওয়া হয়, তবে পরিষ্কারভাবে কিছু একটা গড়বড় আছে। ’
ব্রাজিলের শীর্ষস্থানীয় পোলিং ইনস্টিটিউট ডেটাফোলহার এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, নেইমারকে চতুর্থ বিশ্বকাপে দলে ডাকা উচিত কিনা তা নিয়ে ব্রাজিলিয়ানরা বিভক্ত। ৪৮ শতাংশ পক্ষে থাকলেও ৪১ শতাংশ এর বিপক্ষে।
মাঠেও নেইমারের আচরণ আগের চেয়ে খিটখিটে মনে হচ্ছে। জুলাই মাসে টানা তিনটি ম্যাচে তিনি সমর্থকদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়েছেন। পরের মাসে, ভাস্কো দা গামার কাছে ৬-০ গোলে হারের পর তাকে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায়, যা ছিল তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় পরাজয়।
তবে এখনও একটি ক্ষীণ আশা বেঁচে আছে। ২০০২ সালে কিংবদন্তি রোনালদো ‘ফেনোমেনন’ যেভাবে সব সমালোচনা ও চোটকে পেছনে ফেলে ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন, নেইমারও কি সেভাবে ফিরে আসতে পারবেন?
রোনালদো নিজে অবশ্য নেইমারের পাশেই আছেন। তিনি বলেন, ‘সে ব্রাজিলের জন্য একজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। নেইমারের মতো আর কেউ নেই। যারা মনে করে সে তার শারীরিক পুনরুদ্ধারে অবহেলা করছে, তারা সংখ্যালঘু এবং এটা একটা অতিরঞ্জন। সে সঠিক পথেই আছে। ’
আগামী কয়েক মাস নেইমারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের মধ্যেই তাকে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি সিংহাসন ত্যাগ করা সেই ‘যুবরাজ’ নন।
এমএইচএম