ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৪ আশ্বিন ১৪৩২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭ রবিউস সানি ১৪৪৭

সারাদেশ

দুর্ভোগের কারণ যখন ১৮ কোটি টাকার সেতু

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪:০৩, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৫
দুর্ভোগের কারণ যখন ১৮ কোটি টাকার সেতু কুষ্টিয়ার মিরপুর-দৌলতপুর সড়কের জিকে প্রকল্পের ওপর ব্রিজ নির্মাণের কাজ চলছে ধীরগতিতে। পাশে বাঁশের সাঁকো করে ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হচ্ছেন মানুষ

কুষ্টিয়া: মিরপুর-দৌলতপুর সড়কের জিকে ক্যানেলের ওপর নির্মাণাধীন ব্রিজটি বর্তমানে কুষ্টিয়ার দুই উপজেলার মানুষের দুর্ভোগের কারণ হয়ে উঠেছে। ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্রিজটি নির্মাণ শুরুর পর শেষ করার নির্ধারিত সময় ইতিমধ্যে অতিবাহিত হয়েছে।

বর্ধিত সময়ের মধ্যেও ব্রিজটি নির্মাণ হবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন আছে এলাকাবাসীর।  

পরিকল্পনায় ত্রুটি, ব্রিজের নিকটবর্তী স্থানে ব্যক্তিগত বহুতল ভবন নির্মাণ এবং মাত্রাতিরিক্তি উচ্চতা-সব মিলিয়ে স্থানীয়দের মনে হচ্ছে ব্রিজটি নির্মাণের কারণে সুবিধার থেকে অসুবিধাই বেশি হবে। যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে, নির্মাণের পর এর সুফল পাবেন মানুষ।

জেলার অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা কুষ্টিয়ার মিরপুর বাজার। জেলার দীর্ঘতম মিরপুর পৌর পশুহাট, উপজেলা পরিষদ, মিরপুর-দৌলতপুর সড়কের জন্য একমাত্র সংযোগস্থলে জিকে ক্যানেলের ওপরে রয়েছে একটি ব্রিজ। দৌলতপুর ও মিরপুর উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ প্রতিদিন এই ব্রিজ পারাপার হয়।  

উপজেলা পরিষদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতালসহ প্রায় সকল কাজে উপজেলা দুটোর একমাত্র অবলম্বন এই ব্রিজটি। পূর্বে এই স্থানে ব্রিজ থাকলেও প্রয়োজনে সেখানে নতুন করে ব্রিজ নির্মাণ করছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এ ব্রিজ নির্মাণে কাজ চলছে দীর্ঘদিন। কাজ যেন শেষই হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে বাঁশের সাঁকোতে পারাপার হতে হচ্ছে এলাকাবাসীকে।

নানা জটিলতায় প্রকল্পের কাজ কচ্ছপ গতিতে চলছে। ইতিমধ্যে আবার নির্মাণ প্রকল্পের কাজের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে কাজ সমাপ্ত হবে এমন আশা করছে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। তবে, কাজের যে গতি তাতে অনির্দিষ্টকালের জন্য কপালে ‘দুর্ভোগ’ রয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।

ইতিমধ্যে ব্রিজটি দৃশ্যত হলেও তা ব্যবহারে সাধারণ মানুষ সুফল পাবে না বলে দাবি এলাকাবাসীর। অস্বাভাবিক উচ্চতা, রাস্তা এবং ব্রিজের সামনে নতুন করে দালান গড়ে উঠায় স্থানীয়রা আশঙ্কা করছেন ব্রিজটি শুধুমাত্র দেখার জন্যই তৈরি হচ্ছে।

কুষ্টিয়া সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, খুলনা সড়ক জোনের আওতাধীন মহাসড়কে বিদ্যমান সরু ও ঝুঁকিপূর্ণ পুরাতন কংক্রিট সেতু/বেইলি সেতুর স্থলে কংক্রিট সেতু নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে কুষ্টিয়া সড়ক বিভাগের অধীন কুষ্টিয়া (ত্রিমোহনী-মেহেরপুর সড়কের ৮ মাইল হতে মিরপুর থানা সংযোগ জেড-৭৪৫১) সড়কের সরু ও ঝুঁকিপূর্ণ পুরাতন কংক্রিট মেতু/বেইলি সেতুর স্থলে ব্রিজ নির্মাণ কাজ শুরু হয়।

এটি নির্মিত হচ্ছে আরসিসি/পিসিগার্ডার ব্রিজ নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় (৫৭.০৯৮ মিঃ ী ২.২০০ মিঃ ী ৩০.৪৮৮ মিঃ)। এর কাজ শুরু হয় ২০২৩ সালের ৮ নভেম্বর। শেষ হওয়ার মেয়াদ ছিল চলতি ২০২৫ সালের ৭ মে।  

কাজের বরাদ্ধ ছিল ১৮ কোটি ৬৭ লাখ ১৭ হাজার টাকা। কংক্রিট অ্যান্ড স্টিল টেকনোলজিস লি., রানা বিল্ডার্স (প্রা.) লি. কাজটি পায়। প্রকল্প মেয়াদ শেষ হওয়ায় এক বছর বৃদ্ধি করে আগামী ৩০ জুন ২০২৬ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, একবার প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও ৫০ শতাংশ কাজও শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। সেতু নির্মাণে ধীরগতি এবং কাজের মাণ নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করছেন স্থানীয়রা। তাদের দাবি প্রতিদিন ২-৩ জন শ্রমিক নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। তাও সকালে করলে বিকালে করে না, আবার বিকালে করলে সকালে করে না।  

এভাবে সেতু নির্মাণ করার কারণে বছরের পর বছর পার হয়ে যাচ্ছে। আবার পারাপারে দুর্ভোগ সৃষ্টি হলেও বাঁশের সাঁকো দিয়ে দিয়েছে, যাতে ভোগান্তি আরো বেশি।

ব্রিজটির ১৫ ফুট সামনের দোকানি গোলাম হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘ব্রিজের কাজ করে, না-কি করে তা ওরাই জানে। এক বছর ধরে দেখি একজন/দুইজন করে মাঝে মাঝে কাজ করে। এখানে আমরা কি বলবো। আমার মনে হয় এখনো এক থেকে দেড় বছর লাগবে ব্রিজ বানাতে।  

আবার ব্রিজ থেকে নামার রাস্তার সামনেই বাজারের নেতা পাঁচতলা বিল্ডিং করছেন। ইঞ্জিয়াররা আসছেন, বলছে ব্রিজ বেশি উঁচু হলেও সমস্যা হবে না, সব নাকি ঠিকঠাক করে দিবে। আমরা তো আর নেতা না যে আমাদের কথা কেউ শুনবে। ’

ভ্যানচালক আব্দুল আজিজ বাংলানিউজকে বলেন, ‘একতে ব্রিজ হচ্ছে মেলা উচা, তার ওপরে উঠার কোন রাস্তা থাকবে না। এতে তো সমস্যা হবে, ব্রিজে উঠা যাবে না। সমস্যা হলে আর কি করা, বুলবে কে?’

তিনি বলেন, ‘ব্রিজে উঠার রাস্তা এমন বাঁকা হলে আমরা ছোটখাটো গাড়ি নিয়ে উঠতে পারবো না। সোজা হলে ভালো হতো। ব্রিজের সামনেই ঘরবাড়ি তৈরি হচ্ছে, এগুলো না সরালে তো সমস্যা হবেই। ’

স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, যারা ব্রিজ করছে তারাই ভালো জানে কি কারণে এমন ব্রিজ করছে। তাদের মাথায় বুদ্ধি থাকলে এমন ব্রিজ করে না।

স্থানীয় বাসিন্দা হুমায়ূন কবীর হিমু বাংলানিউজকে বলেন, ‘দেড় বছর ধরে এ ব্রিজের কাজ চলছে। মানুষের দুর্ভোগ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যা সীমাহীন বললেও কম হবে। বিকল্পভাবে চলাচলের কোন রাস্তা নেই। যার কারণে ১০ টাকার ভাড়া ৬০ টাকা দিতে হচ্ছে। তাও কোন ভ্যান, রিকশা, অটো যায় না।  

একমাত্র উপায় হলো বাঁশের চরাটের উপর দিয়ে হেঁটে। তাও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। ব্রিজটি যে উচ্চতা হচ্ছে, যা নিচ দিয়ে জাহাজ চলার মতো, এমন স্থানে এমন ব্রিজ করা মানে মানুষের ভোগান্তি আরো বৃদ্ধি করা। ’

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘কাজের প্রতি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের অনিহার কারণে এমন দায়সারা কাজ হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। ’

ব্রিজ নির্মাণকারী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাইট ম্যানেজার আলিফ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘এটি হচ্ছে ৫৭ মিটারের একটি ব্রিজ। এখানে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ৩০০ ফিট ডাইভেশন রাস্তা নির্মাণ হবে’।  

তিনি বলেন, এখানে দোকানপাট এবং নতুন করে স্থাপনা তৈরির কারণে ব্রিজের সামনে রাস্তা করা সম্ভব না। রাস্তা হলেও তা ব্রিজের সাথে সোজা হবে না, ব্রিজ থেকে অ্যাপ্রোসটি বাঁকা হবে। যার কারণে ব্রিজটি সুন্দর হওয়ার কথা থাকলে হবে না।  

রেলের জায়গা সংক্রান্ত বিষয়, বৈদ্যুতিক লাইন, পুরাতন ব্রিজের পাইল উঠানোর কারণে কাজ বিলম্বিত হচ্ছে বলে জানান তিনি।

আলিফ হোসেন আরো বলেন, ‘ব্রিজটি প্রযুক্তি সম্বলিত হবে না। পুরাতন যে স্টিমেট ছিল সে অনুযায়ী কাজ করলে ভালো হতো। কিন্তু এখন নতুন স্টিমেটের কারণে ভালো হবে না। দেখতেও খারা লাগবে। ব্রিজের সামনে নতুন স্থাপনা তৈরি এবং দোকানপাট থাকায় ব্রিজের মুখ থাকবে একদিকে রাস্তা থাকবে অন্য দিকে। ’

এদিকে ব্রিজের একদম সামনেই নতুন করে পাঁচতলা ভবনের কাজ শুরু করেছেন মিরপুর পৌর বাজারের ব্যবসায়ী নেতা বাবলু চৌধুরী। তবে পৌরসভার অনুমোদন না থাকায় কাজটি বন্ধ করে দিয়েছে পৌর প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।

বাবলু চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ‘এখানে যে ব্রিজটি হচ্ছে, আসলে আমাদের চাওয়া-পাওয়ার মতো হচ্ছে না। ব্রিজের উচ্চতায় দুর্ভোগে পড়বে সাধারন মানুষ। এই ব্রিজটি সাধারণ মানুষের গলার কাটা হয়ে যাবে। এখান থেকে কোন সুফল আসবে না। ’

তিনি আরো বলেন, ‘হঠাৎ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসে আমার নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। আমার ব্যক্তিগত জায়গায় মার্কেট করছিলাম আমি। পৌর সভায় এক লাখ ৫৫ হাজার টাকা ফি দিয়ে আবেদন করে মৌখিক অনুমোদনে কাজ শুরু করেছিলাম। কিন্তু কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। ’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘যে ব্রিজটি ১৫ ফুট উত্তরে হওয়ার কথা ছিল, সেটি বিভিন্ন মানুষের চাপাচাপির কারণে ১৫ ফিট পশ্চিমে তৈরি হচ্ছে। কোন প্রকার স্থানীয়দের সাথে সমন্বয় না করেই এমন কাজ করছে কর্তৃপক্ষ। ’

মিরপুর পৌরসভা সূত্রে জানা যায়, মিরপুর পৌর এলাকার ৬২২ নং খতিয়ানের মিরপুর মৌজার ৫১৪ নম্বর দাগের ওপরে যে ভবন নির্মাণ হচ্ছে তারজন্য পৌরসভা থেকে অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়েছিল। তবে সেটি অনুমোদন হয়নি।  

মিরপুর পৌর প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের অধীন মিরপুর ঈগল চত্ত্বরে যে বহুতল মার্কেট নির্মাণ হচ্ছে এটা খুব হাইলি টেকনিক্যাল বিষয়। পৌর বিল্ডিং নকশা অনুমোদনের আবেদনে ১৩টি স্থানে সংশোধনী চেয়েছে বিল্ডিং নকশা অনুমোদন কমিটি। এজন্য আমরা নকশা সংশোধনের জন্য তাকে লিখিত চিঠি দিয়েছি, সেই সাথে অনুমোদন না হওয়া পর্যন্ত কাজটি স্থগিত করতে বলেছি। ’

কুষ্টিয়া সড়ক ও জনপথ বিভাগের মুহাম্মদ মনজুরুল করীম বাংলানিউজকে জানান, নির্মাণাধীন ব্রিজটি হবে দৃষ্টিনন্দন এবং জেলার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ব্রিজ।  

তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যেই ব্রিজ নির্মাণের ৪৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে পিসি গাডার টাসকিং এর কাজ চলমান রয়েছে। আশা করি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ হবে। পূর্ববর্তী সেতু বরাবরই নির্মিত হচ্ছে। এখানে কারিগরিভাবে অসুবিধা হবে মনে হচ্ছে না। সেতুর উচ্চতা টেকনিক্যাল স্ট্যান্ডার্ন্ড মেনেই হচ্ছে। আশা করি সেতুটি নির্মাণ হলে সুফল পাবে সাধারণ মানুষ।

এসএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।