নদী শুধু পানির ধারা নয়, প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য এবং জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশও বটে। অথচ জলবায়ু পরিবর্তন আর দখল-দূষণ এবং দুর্বৃত্তদের থাবায় হারিয়ে যেতে বসেছে নাটোরের নারদ নদ, গোদাই ও হোজা নদীসহ ছোট-বড় মিলে অন্তত ২৫টি নদ-নদী।
এছাড়া শিল্প-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলার কারণে নদ-নদীগুলো দূষিত হয়ে ড্রেজ বা ড্রেনে পরিণত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ফলে ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে নদীর আয়তন। হারিয়ে যাচ্ছে মিঠা পানির নানা প্রজাতির মাছ, ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। জৌলুস হারাচ্ছে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য এবং জীবনের ধারা।
স্থানীয়রা জানান, এক সময় যেখানে পানিতে থৈ থৈ করত নদীগুলো, সেখানে বর্ষা মৌসুম ছাড়া এখন বছরের অধিকাংশ সময়ই থাকে পানিশূন্য। নদীর বুক চিরে রেললাইন ও মহাসড়ক নির্মাণসহ অপরিকল্পিতভাবে ব্রিজ-কালভার্ট, স্লুইসগেট, বাঁধ-ক্রসবাঁধ এবং বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ, দখলসহ নানা কারণে এসবের অস্তিত্ব হারাচ্ছে। জেলার হাতে গোনা ৪ থেকে ৫টি নদী সচল থাকলেও তাতে পানি প্রবাহ ও স্রোতধারা আগের মতো নেই বললেই চলে। শুধুমাত্র বর্ষাকাল এলেই পানির আধার দেখা মিললেও শুষ্ক মৌসুম আসার আগেই তা শুকিয়ে যায়। আর অন্যদিকে জেলার অধিকাংশ নদীই কচুরিপানা, ময়লা আবর্জনা, দুষিত বর্জ্যে ভাগারে পরিণত হয়েছে।
সিংড়া উপজেলার নগর মাঝগ্রামের বাসিন্দা মো. আব্দুর রাজ্জাক, হাপানিয়া গ্রামের আবুল কালাম জানান, পুরোনো আত্রাই নদীর তীরে তার বাড়ি। এক সময় এ নদীতেই গোসল করাসহ যাবতীয় কাজকর্ম চলতো। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে পানি প্রবাহ বন্ধ থাকায় নদীতে গোসল বা কৃষি কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সময়েও পানি মেলে না।
এছাড়া এসব নদীগুলোতে মাছের দেখাও মেলে না। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে নদীগুলোর জীববৈচিত্র্য। আগে এসব নদী দিয়ে বড় বড় জং নৌকা, পাল তোলা নৌকা চলাচল করতো এবং আগে এ নদী ছিল প্রসারিত। দীর্ঘদিন ধরে চলাচল না থাকায় নৌকাগুলো অলস পড়ে আছে। বেকার হয়ে পড়েছেন নদীর ওপর নির্ভরশীল মানুষগুলো। ফলে স্থবিরতা নেমেছে ব্যবসা-বাণিজ্যেও।
তিনি বলেন, শৈশবকালে নদী পাড়ের মানুষের গোসলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় কাজ ছিল নদী কেন্দ্রীক। এখন সবই স্মৃতি। নদীগুলোকে বাঁচাতে দূষণ ও দখলমুক্ত করে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা প্রয়োজন।
নাটোরের প্রবীণ সাংবাদিক মো. রেজাউল করিম খান জানান, জেলার অধিকাংশ নদীগুলো চলনবিলের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ফলে কৃষি প্রধান এই অঞ্চলটিতে ফসলের সহায়ক ভূমিকা পালন করতো নদীগুলো। কিন্তু একদিকে দখল, দূষণ আর অপরিকল্পিতভাবে স্লুইস গেট নির্মাণ এবং সেই সঙ্গে দ্রুত পলি জমে ভরাট হচ্ছে নদীগুলো।
তিনি বলেন, এক জরিপে দেখা গেছে, বিলে পানি সরবরাহকারী নদী দ্বারা বছরে প্রায় ৬ দশমিক ৩ মিলিয়ন ঘন ফুট পলি জমা হয়। আর ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন ঘনফুট পলি বিভিন্ন নদী ও ক্যানেল দিয়ে বের হয়ে যায়। অর্থাৎ বছরে প্রায় ৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন ঘন ফুট পলি জমা হয় এই বিলে। এসব পলি চলনবিলের ৩৬৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় সমভাবে বিস্তৃতি করে দেওয়া হলে প্রতি বছর এর উচ্চতা প্রায় ১ দশমিক ২৭ সেন্টিমিটার করে বৃদ্ধি পাবে।
স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের মতে, চলনবিলের প্রধান প্রধান নদী ও খাল ড্রেজিংয়ের আওতায় এনে পানির প্রবাহ সৃষ্টি ও ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. রেদওয়ানুর রহমানের প্রবন্ধ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে- প্রায় ২৯ বছর আগেও চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীতে বছরজুড়েই ৬ থেকে ১২ ফুট পানি থাকত। ফলে বছরজুড়েই করত নৌকা চলাচল। কিন্তু বছরের পর বছর পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে এসব নদী। আকার বা আয়তনে ছোট হয়ে গেছে এসব নদী।
স্থানীয়দের মতে, জেলার নদ-নদীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নাটোর শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নারদ নদ। এই নদটির দৈর্ঘ্য ১৬ কিলোমিটার এবং গড় প্রস্থ ২৪ মিটার। এটি পদ্মা নদীর একটি উপনদী, যার পানি মূলত বড়াল ও মুসাখান নদ থেকে আসে। একসময় এটি ব্যবসা-বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল, তবে বর্তমানে নদীটি দূষণ ও দখলদারদের কবলে পড়ে বিলুপ্তির পথে। দুই পাশে দখলের মহোৎসবে নারদের অস্তিত্বই আজ হুমকির মুখে। স্থানীয় নাগরিকরা এ নারদ নদ দখল-দূষণমুক্ত করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। বরং এ নদের উভয় তীরে বসবাসরতরাই এটির মালিক মনে করেন। তারা ইচ্ছামতো ভরাট করছেন।
নাটোর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মো. জিল্লুর রহমান খান বাবুল চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন শিল্পকারখানা ও পৌরসভার সব বর্জ্য এ নারদ নদেই ফেলা হয়। ফলে এ নারদ নদ অনেক আগেই প্রাণ হারিয়েছে। এখন এটি একটি পরিত্যক্ত জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। অথচ এ নদের পানিতেই এক সময় মানুষ সাঁতার কেটেছে, নৌকা চালিয়ে চলাচল করেছে, নদে জাল ফেলে মাছ শিকার করেছেন অনেকে। ফলে নারদ নদকে ঘিরে রয়েছে স্থানীয়দের সোনালি অতীত। কিন্তু দুর্বৃত্তদের থাবায় দখল আর বিভিন্ন শিল্প কারখানার দুষিত বর্জ্য ফেলার কারণে নারদ নদ পরিণত হয়েছে এখন মরা খালে। তাই দখল-দূষণ রোধে জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ আর দ্রুত সংস্কার করতে হবে। শুধু প্রশাসনিক ভাবে নয়, রাজনৈতিক ভাবেও এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, সদর উপজেলায় নদটির প্রায় ১৬ কিলোমিটার এলাকা দখল হয়ে গেছে। এর মধ্যে বেশকিছু অংশ দখল করেছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ভূমিহীনরা কাঁচা বাড়ি স্থাপন করলেও কেউ কেউ নদের জমি দখল করে বহুতল পাকা বাড়ি বানিয়েছেন। এতে ইতোমধ্যে নদটির দুই পাড়ের আয়তন কমে গেছে, নদ সরু হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে তিনবার নারদ নদ থেকে দখলদারদের উচ্ছেদ করা হলেও তা আবারও দখল হয়ে গেছে। এছাড়া নারদ নদের অস্তিত্ব হারানোর জন্য শিল্পকারখানার দুষিত বর্জ্য ফেলা অনেকটা দায়ী।
নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রিফাত করিম বাংলানিউজকে জানান, এ জেলার বড়াল, বারনই নদীসহ নারদ নদ সংস্কার ও দখল-দূষণ মুক্ত করতে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। যা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে যাচাই-বাচাই কাজও সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে অনুমোদন ও সরকার অর্থায়ন করলে নারদ নদসহ জেলার বিভিন্ন নদ-নদী দ্রুত সংস্কার করা সম্ভব হবে বলে। এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড সর্বদা প্রস্তত আছে।
নাটোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. আবুল হায়াত বাংলানিউজকে বলেন, জেলার সব নদীর নাব্যতা ফেরাতে জেলা প্রশাসন থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দপ্তরের মাধ্যমে বড়াল নদী খননসহ সংস্কার এবং বানিয়াকোলা খাল সংস্কার ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে।
সম্প্রতি শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নারদ নদের কচুরিপানা ও ময়লা আবর্জনা পরিষ্কারের উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন। যা ধারাবাহিকভাবে এই কার্যক্রম চলমান থাকবে। এছাড়া জেলার সব নদ-নদীর নব্যতা ফিরিয়ে আনতে সংস্কার, দখল-দূষণ মুক্ত করতে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন, নাটোর জেলা শাখার সদস্য সচিব মো. শিবলী সাদিক বাংলানিউজকে বলেন, নদী কেবল জীবনধারণের জন্য পানীয় জলের উৎস নয়, বরং এর জল, দুই তীরের সবুজ প্রকৃতি এবং কলকাকলি মিলে এক অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্যের সৃষ্টি করে।
এছাড়া কৃষি, মৎস্য চাষ, পরিবহন এবং অন্যান্য শিল্পে নদীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নদী পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং জীববৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। নদীর ঢেউ, স্রোত এবং দুই তীরের জনজীবন সবকিছু মিলে নদীকে এক জীবন্ত সত্তায় পরিণত করেছে, যা প্রকৃতির সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে। তাই নদীকে দখল, দূষণ মুক্ত করতে হবে এবং সংস্কার করতে হবে, যাতে নদীর নাব্যতা ফিরে আসে।
উল্লেখ্য, প্রকৃতি এবং নদী একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত; নদী প্রকৃতির এক অত্যাবশ্যকীয় অংশ, যা জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করে এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে। নদী শুধু পানির একটি প্রাকৃতিক জলধারা নয়, বরং এটি এক অপরূপ সৌন্দর্য ও জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশও বটে। যা বিশ্ব নদী দিবসের মতো দিবসে পালিত হয়।
এদিকে নদীগুলোর সুরক্ষা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও নদী ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করা এবং নদী রক্ষার কাজে উৎসাহিত করতে আজ রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) বিশ্ব নদী দিবস পালিত হচ্ছে। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার পালিত হয় এ দিবসটি এবং এটি নদীসমূহের গুরুত্ব তুলে ধরে ও নদী সংরক্ষণে জনসচেতনতা বৃদ্ধির একটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগ। “নদী ও জলাধার: আমাদের প্রকৃতি ও সামাজিক মূলবোধের আধার” এ প্রতিপাদ্য নিয়ে পালিত দিবসটিতে জেলার নারদ নদ সংস্কার, দখল-দূষণ মুক্ত করার দাবি জানান পরিবেশ কর্মী, সুশীল সমাজসহ সংশ্লিষ্টরা।
আরএ