ঢাকা, সোমবার, ১৩ আশ্বিন ১৪৩২, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৬ রবিউস সানি ১৪৪৭

সারাদেশ

খুলনাবাসীর দুর্ভোগ গল্লামারী সেতু, নির্মাণে কচ্ছপ গতি!

মাহবুবুর রহমান মুন্না, ব্যুরো এডিটর  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:৫৮, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২৫
খুলনাবাসীর দুর্ভোগ গল্লামারী সেতু, নির্মাণে কচ্ছপ গতি!

খুলনার ময়ূর নদের ওপর নির্মাণাধীন গল্লামারী সেতুর কাজের ধীরগতির কারণে পাশের সেতু দিয়ে প্রতিদিন শত শত বাস, ট্রাক, ইজিবাইক ও অন্য যানবাহনের চালক-যাত্রীরা পারাপার হচ্ছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।

গল্লামারী সেতুর দুইপাড়ে যানজট লেগেই থাকে।

স্থানীয়রা বলেন, কচ্ছপ গতিতে কাজ চলায় ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী, পরিবহন শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীরা। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর সেতু নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ ১ বছর পর কাজ শুরু হলেও তার দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। যে কারণে ক্ষিপ্ত নাগরিক নেতারা।

পরিবহন চালক ও পথচারীরা বলছেন, একটা সেতু দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হতে হয়। যানজটে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকতে হয়। নতুন সেতুটি কাজের ধীরগতির কারণে এখনও নির্মাণ হয়নি। তাই ঝুঁকি ও ভোগান্তি নিয়ে এ পথে চলাচল করতে হচ্ছে সবাইকে।

সড়ক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, যানবাহনের চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্রিটিশ আমলে ময়ূর নদের ওপর নির্মিত পুরোনো সেতুর পাশে ২০১৬ সালে ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে আরেকটি সেতু নির্মাণ করা হয়। কিন্তু পানির স্তর লাগোয়া সেতুটিতে মারাত্মক নকশা ত্রুটি ধরা পড়ে। অন্যদিকে শহরের অংশে যানজট আরও তীব্র হলে সড়ক বিভাগ এই দুই সেতু ভেঙে সেখানে ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে হাতিরঝিলের আদলে চার লেনের দৃষ্টিনন্দন একটি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং (এনডিই) লিমিটেড ২০২৩ সালের নভেম্বরে সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করে। তবে দু’দফা মেয়াদ বাড়িয়ে সেতু দুটির কাজ এখনো শেষ করা যায়নি। সেতুর কাজ ২০২৫ সালের ১ এপ্রিলের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। ২০২৪ এর ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বন্ধ হয়ে যায় সেতুর কাজ। দীর্ঘদিন কাজ থেমে থাকার পর গত ২৭ জুলাই গল্লামারী বাজারের দুই পাশে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে খুলনা সড়ক বিভাগ।

জানা গেছে, ২০২৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত পুরোনো একটি সেতু ভেঙে শুধু নদের দুই পাড়ে কংক্রিটের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। গতবছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আগে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সেতুর নির্মাণ ব্যয় ২০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১৪ কোটি টাকা বৃদ্ধির চেষ্টা করছিলেন ঠিকাদার। তখন বাড়তি টাকার বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছিলেন খুলনা-২ আসনের সাবেক এমপি সেখ সালাহ উদ্দিন জুয়েলসহ আওয়ামী লীগ নেতারা। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর নেতারা পালিয়ে যান, সড়ক বিভাগেও ব্যাপক রদবদল করা হয়। সড়ক বিভাগের নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরা সব ধরনের বাড়তি ব্যয়ের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। এরপর ১৫ শতাংশ হারে ১০ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধির চেষ্টা করা হয়। বাড়তি টাকার বিষয়ে আশ্বাস না পেয়েই এক বছর ধরে প্রকল্প এলাকায় কাজ বন্ধ রাখে ঠিকাদার। চলতি বছরের আগস্টের শুরু থেকে ফের সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়। কিন্তু ১ মাসে কাজের কোন অগ্রগতি নেই।

সরেজমিনে দেখা যায়, গল্লামারী সেতুর কাজের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। সেতুর দুই পাড়ে ৭০-৮০ টন স্টিল ভিম ও হ্যাঙ্গার বার রাখা রয়েছে। সিকিউরিটি গার্ডের লোকরা সেগুলো পাহারা দিয়ে রাখছেন। ঠিকাদার ও সড়ক বিভাগের কিছু কর্মকর্তা সেখানে এসে মাপামাপি করছেন ও ঘুরে যাচ্ছেন। পাশের সেতুর মাঝে বাঁশ দিয়ে ডিভাইডার তৈরি করে আসা যাওয়া করছেন সাধারণ মানুষ। প্রতিদিন তীব্র যানজট ডিঙিয়ে সাধারণ মানুষকে যাতায়াত করতে হচ্ছে। সেতুর দুই পাড়ে ভোগান্তি নিয়ে চলাচল করছে সাধারণ মানুষ।

চরম অসন্তোষ যাত্রীরা

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. আরাফাত হোসেন বলেন, খুলনা জেলার গল্লামারী বাজার সংলগ্ন ময়ূর নদের ওপর স্থাপিত ব্রিজটি যেন জনগণের ভোগান্তির চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছিয়েছে। ব্রিজটি যান চলাচলের জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়লে সংস্কার করার কাজ হাতে নেয় সড়ক বিভাগ। কিন্তু দীর্ঘ সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও ব্রিজ নির্মাণের আশাতীত অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এই ব্রিজটি ‘জিরোপয়েন্ট টু ময়লাপোতা-সোনাডাঙ্গা’ অর্থাৎ খুলনার মূল শহরকে সংযুক্ত করেছে। ব্রিজটির কাজ ধীরগতিতে চলার কারণে সড়কটিতে জনদুর্ভোগ প্রকট আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন এই সড়কটিতে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। ব্রিজটির পাশেই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। প্রতিদিন হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে এই ব্রিজটি ব্যবহার করতে হয়। যার কারণে এই সড়কে যানজট সবসময় লেগেই থাকে। ব্রিজের কাজ ধীরগতি হওয়ায় ময়ূর নদটি এখন মৃতপ্রায়। নদের পানি প্রবাহ না থাকায় পানি দূষিত হয়ে পরিবেশ নষ্ট করছে। ব্রিজটি জনগণের ভোগান্তি যেমন বাড়িয়েছে তেমনি স্বাস্থ্য ঝুঁকিও বাড়িয়েছে। নদের বেহাল দশার কারণে পচা পানির দুর্গন্ধ ও ধুলাবালি থেকে নগরবাসীর অ্যালার্জি, শ্বাসকষ্ট, ত্বকের সমস্যা, স্ট্রোকের ঝুঁকি দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। তাই উক্ত ব্রিজ নির্মাণের কাজটি দ্রুত শেষ করার জন্য সড়ক বিভাগের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

ব্যাংক কর্মকর্তা নিশাত সুলতানা বিপাশা বাংলানিউজকে বলেন, শাচিবুনিয়া বিশ্বরোড বাড়ি হওয়ায় প্রতি রবি হতে বৃহস্পতিবার আমাকে গল্লামারী সেতু পার হয়ে অফিসে যাতায়াত করতে হয়। ২০২৩ সালের অক্টোবর হতে দুটি ব্রিজের মধ্যে একটি ব্রিজ বন্ধ করে দেওয়ায় প্রতিদিন ৩০ মিনিটের রাস্তা এক ঘণ্টা সময় অফিস লাগে পৌঁছাতে। সন্ধ্যার অবস্থা আরও করুণ। সারাদিন অফিস এরপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। বন্ধের দিন কাজে বেরুলেও এত জ্যামের কারণে অস্বস্তিতে পড়তে হয় সময়মতো পৌঁছানো সম্ভব হয় না। তারপর মোহাম্মদনগর ঢোকার রাস্তা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, অসমতল হওয়ার যানবাহনগুলো প্রায় একপাশে কাত হয়ে পড়ে, আর এই স্থানে ময়লা স্তূপ করে রাখার ফলে তীব্র গন্ধের কারণে মূর্ছা যাওয়ার জোগাড়! শিশু, অসুস্থ লোকের জ্যাম ও তীব্র দুর্গন্ধের জন্য নিশ্বাস নিতে না পেরে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, সোনাডাঙ্গার রাস্তা খারাপ হওয়ার ফলে বড় বাস, ডাবল-ডেকারগুলো এদিক দিয়ে যায় তাতে যানজট আরো বাড়ে। এত চাপে ব্রিজ ভেঙে পড়ার আশঙ্কা বেড়ে গেছে। পাশেই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের গেট হওয়ায় ছাত্র-ছাত্রীরা এই রাস্তায় চলাচল করে। এই তীব্র জ্যাম ও পরিবেশ দূষণ এর কারণে তাদের জীবন ঝুঁকির মুখে রয়েছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) ইংরেজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ও নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) খুলনা মহানগর শাখার উপদেষ্টা মো. সামিউল হক বাংলানিউজকে বলেন, গল্লামারীতে নির্মাণাধীন সেতুর কাজ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। ফলে ময়ূর নদীর উভয় পাড়ে প্রতিদিনই সৃষ্টি হচ্ছে অসহনীয় যানজট। মাঝেমধ্যে যানজটের ভয়াবহতা এতটাই তীব্র থাকে, পাঁচ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করতে ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়। এতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-শিক্ষকসহ সাধারণ লোকজনকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। যার কারণে সেতু নির্মাণের সাথে সংশ্লিষ্টদের প্রতি শিক্ষার্থী ও সাধারণ লোকজনের ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে। এমতাবস্থায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে সঠিক ব্যবস্থা না নিলে যে-কোনো সময় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে। শুনেছি কাজ আবার শুরু হয়েছে। প্রতিদিনই এ রাস্তা দিয়ে চলাচল করি। কিন্তু দৃশ্যমান কোন কাজ দেখতে পারি না। তাই এটা নিয়ে যথাসম্ভব শিগগিরই একটি সমাধানে আসা উচিত।

খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, খুলনা নগরের অন্যতম প্রবেশপথ গল্লামারী। প্রতিদিন গল্লামারী সেতু দিয়ে হাজার হাজার যানবাহন ও লোকজন চলাচল করায় তীব্র যানজট এবং ভোগান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। এ এলাকায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, পাইকারী ও খুচরা বৃহৎ বাজার এবং জনবসতি গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে বিভিন্ন রুটের বাস-ট্রাক, ইজিবাইক এবং নানা পরিবহন ও বিপুল সংখ্যক মানুষ চলাচল করে।
নাগরিক এ নেতা অভিযোগ করে বলেন, এখানে আগের একটি সেতু নির্মাণে নকশা ত্রুটিতে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় হয়েছে। ফলে মাত্র ৩/৪ বছরের ব্যবধানে সেতুটি ভেঙে ফেলতে হচ্ছে। ওই সেতুটি নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহি ও আইনের আওতায় আনতে হবে।

যে কারণে ঠিকাদারের কাজের ধীরগতি

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিংকের (এনডিই) পিডি বিপ্লব পাল বাংলানিউজকে বলেন, সেতু এলাকায় ৭০-৮০ টন স্টিল ভিম ও একটি সেতু তৈরি করতে যত হ্যাঙ্গার বার প্রয়োজন তা পৌঁছেছে। আর দুইশ টন আগামী সপ্তাহে আশা করি পৌঁছে যাবে। আর কিছু নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখা আছে ওখানে। সরকার পরিবর্তনের কারণে অনেক জায়গায় কাজ স্লো হয়ে ছিল। সেতু নির্মাণ কাজও তেমনি স্লো হয়ে ছিল। এখন উন্নয়ন কাজে গতি ফিরেছে। আগামী ২০-৪০ দিনের মধ্যে সব মালামাল সেতু নির্মাণের স্থানে পৌঁছে যাবে। আশা করছি, তখন সেতু নির্মাণের কাজ দৃশ্যমান হবে। বিদেশ থেকে মালামাল আসতে ৬০ দিন সময় লাগে। আবার সেই মালামাল আনার পর আবার সেট করতে হয়। এসব কারণে দেরি হচ্ছে।

ব্যর্থতার দায় স্বীকার সড়ক বিভাগের

সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী তানিমুল হক বাংলানিউজকে বলেন, কাজের অগ্রগতি খুবই কম। আমরা চেষ্টা করে পারছি না। আমরা ব্যর্থ। ঠিকাদার যদি সঠিকভাবে কাজ করে তাহলে এক মাসের মধ্যে সেতুর কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব।

এমআরএম/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।