ঢাকা, শুক্রবার, ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২৪ মে ২০২৪, ১৫ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

গৃহহীন ও ভূমিহীনদের ঘর দেওয়ার প্রকল্প চাঙা করছে গ্রামীণ অর্থনীতি

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৭ ঘণ্টা, জুলাই ২৩, ২০২২
গৃহহীন ও ভূমিহীনদের ঘর দেওয়ার প্রকল্প চাঙা করছে গ্রামীণ অর্থনীতি ছবি: হোসাইন মোহাম্মদ সাগর

লক্ষ্মীপুর থেকে ফিরে: কাজল রেখা (৩৫) নামটা সুন্দর হলেও জীবনটা তার মোটেও সুন্দর ছিল না। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তার স্বামী মেঘনা নদীতে ভাড়া নৌকায় মাছ ধরে যা উপর্জন করতেন, তাই দিয়েই কোনো রকমে চলতো সংসার।

তবে সেই সুখও খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সর্বনাশা মেঘনার ভাঙনে তলিয়ে যায় কাজল রেখার ঘর। এরপর ঘর ভাড়া দিতেই যখন উপার্জনের প্রায় সবটুকু শেষ, তখন থেকেই স্বামী-সন্তান নিয়ে খেয়ে না খেয়ে শুরু হয় কাজল রেখার ঘোরতর কষ্টের দিন।

প্রায় একই রকম গল্প মো. আব্বাসেরও। একসময় তিনি ছিলেন ভূমিহীন বর্গাচাষি। গ্রামের জোতদারদের কাছ থেকে যে জমি বর্গা নিয়ে তিনি চাষ করতেন, তাতে ফসলের অধিকাংশই চলে যেত জমি বর্গা আর চাষের ঋণ মেটাতে। ফলে অন্যের মুখের খাবার তৈরি করে দিলেও নিজের স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে প্রায় দিনই একবেলা না খেয়েই থাকতেন তিনি।

লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চরবাদাম ইউনিয়নের কলাকোপা আশ্রয়ণ কেন্দ্রে যে ৭৫ পরিবার ঠাঁই পেয়েছে, তাদের অধিকাংশের জীবনের গল্পটাই এমন বা এর থেকেও ভয়াবহ কষ্টের। তবে সেসব কষ্ট এখন লাঘব হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহারের ঘরে মাথা গোঁজার পর থেকে সকলেই হয়ে উঠেছেন স্বাবলম্বী। ভূমিহীন এই মানুষগুলো নিজের ঘর পাওয়ার পর থেকে শুরু করেছেন নতুন কর্মজীবন। আর তা এখন চাঙা করছে গ্রামীণ অর্থনীতিকে।

আশ্রয়ণ প্রকল্প ঘুরে দেখা যায়, দুই শতাংশ জমির মালিকানাসহ সেমিপাকা ঘর করে দেওয়া হয়েছে এই মানুষগুলোকে। এরসঙ্গে আছে রান্নাঘর ও টয়লেট। উঠানে হাঁস-মুরগি পালন ও শাক-সবজি চাষের জায়গাও আছে বেশ খানিকটা। নিজেদের স্বাবলম্বী করতে আশ্রয়ণের বাসিন্দারা বেশ ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছেন সেটুকু। এছাড়া ঘরগুলো দিঘির পাড়ে হওয়ায় অনেকেই পালন করছেন হাঁস। এখানে আশ্রয় পাওয়া পরিবারগুলোর অধিকাংশ পুরুষরাই যেখানে পেশায় জেলে, সেখানে বাড়ির নারীরাও নিজের প্রচেষ্টায় এগিয়ে নিচ্ছেন সংসার আর সন্তানদের। নারীরা যেমন সেলাই মেশিন চালিয়ে বা উঠানে সবজি বাগান ও হাস-মুরগি-কবুতর থেকে উপার্জন করছেন, তেমনি জেলে পেশা বা কৃষি কাজের পাশাপাশি পুরুষরাও গড়ে তুলেছেন মুদি দোকান বা ছোট্ট গরুর খামার।

এই আশ্রয়ণেরই বাসিন্দা মাইনুর বেগম। নিজের বাড়িরে উঠানে বেশ বড় করেই একটা সবজি বাগান করেছেন তিনি। বাগানে আছে বেগুন, পেঁপে, লাউ, চিচিঙ্গা, মরিচ, শাক, কুমড়াসহ বিভিন্ন সবজি। হাঁস, মুরগিও রযেছে তার। এসব সবজি আর হাঁস-মুরগির ডিম বিক্রি করেই তিনি এক মাসে উপার্জন করেছেন প্রায় দুই হাজার টাকা।

কথা হলে মাইনুর বেগম বাংলানিউজকে বলেন, কখনো ভাবিনি নিজের ঘর হবে। স্বামী-সন্তান নিয়ে তিনবেলা খাবার খেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবো। এখন সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমার স্বামী যা ইনকাম করে আনে, তাতেই এখন সংসার চলে যায়। আর সবজি, হাঁস-মুরগির ডিম থেকে নিজেদের চাহিদাও যেমন মেটে, তেমন বিক্রি করে আমিও কিছু উপার্জন করে সঞ্চয় করি। যেন ভবিষ্যতে ছেলে-মেয়েদের কষ্ট না হয়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে লক্ষীপুর জেলার রামগতি উপজেলার চরপোড়াগাছা গ্রামে ভূমিহীন-গৃহহীন, অসহায় ছিন্নমূল মানুষের যে পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করেছিলেন, তা আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে লাখো মানুষের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প। এই প্রকল্প একদিকে যেমন বদলে দিচ্ছে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জীবন, ঠিক তেমনি এ প্রকল্প গ্রামীণ অর্থনীতিকেও চাঙা করে তুলছে।

এ প্রসঙ্গে কথা হলে কাজল রেখা বলেন, আগে কত দুঃখ-কষ্টে দিন কাটিয়েছি তা ভাবলেও মন কেমন করে ওঠে। আর এখন প্রধানমন্ত্রীর ঘর উপহার পাওয়ার পর আমি সেলাই মেশিনে কাজ শুরু করেছি। আগে তো নিজের ঘরই ছিল না, আলাদা কিছু কীভাবে করবো! আর এখন এখানকার প্রায় ৭৫ ঘরের সকলের নতুন জামা-কাপড় সেলাইয়ের কাজ আমি করি। এই টাকা দিয়ে এখন সন্তানদের স্কুলে পাঠাচ্ছি, পড়ার খরচ দিচ্ছি। আর ওদের বাবা যা উপার্জন করে, তা দিয়ে সংসার চলে। বাজারের সবজিও কেনা লাগে খুব কম, কেননা ঘরের সামনেই করেছি সবজির বাগান। সব মিলিয়ে এখন সুখের সংসার আমার। আর মাস শেষে সঞ্চয়ও করতে পারি কিছু ভবিষ্যতের জন্য।

প্রায় একই কথা বললেন বর্গাচাষি মো. আব্বাস। প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে ঘর পাওয়ার পর থেকে শুরু করেছেন নতুন কর্মজীবন, দিয়েছেন মুদি দোকান। কথা হলে বলেন, আগে তো বর্গাচাষ করে কোনো কিছুই করতে পারিনি ভাই। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একটু ভালো খেতেও পারিনি। মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকলে কি আর কিছু হয়! এখন ঘর হয়েছে, ঘরের সঙ্গের জায়গায় দোকান দিয়েছি। বেচাকেনাও বেশ ভালো হয়। সারাদিন ব্যবসা করি আর সকাল সন্ধ্যা দুইবেলা মাঠে সময় দেই। কাজ বেশি থাকলে এখানকার কাউকেই মজুর হিসেবে নিই। একসময় আমি নিজে মজুর ছিলাম, সেই আমি যে একদিন নিজে মজুর খাটাবো তা কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি।

চরবাদাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাখাওয়াত হোসেন জসীম বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামে এখন অনেক উন্নয়ন দৃশ্যমান। প্রকল্পের কাজগুলো করছে গ্রামের মানুষ, ফলে তারা লাভবান হচ্ছেন। আবার যারা এখানে ঘর পাচ্ছেন, তারাও বিভিন্নভাবে নিজেদের স্বাবলম্বী করে তুলছেন।

প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, বৈশ্বিক অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বাংলাদেশের অর্থনীতিকে যদি চাঙা রাখতে হয় তাহলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে হাত দিতে হবে। আর এই প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি যথেষ্ট চাঙা হচ্ছে। আমরা হিসেব করে দেখেছি প্রায় ১৩ কোটি ঘণ্টা শ্রমিকরা এখানে কাজ করেছেন। রড-ইট-সিমেন্ট, এসবের ব্যবসা আর ঘর পাওয়া মানুষগুলোর সাবলম্বী হওয়ার গল্প ঘিরেও গ্রামীণ অর্থনীতি যথেষ্ট চাঙা হচ্ছে। এদিক থেকে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে অর্থনীতিতে।

বাংলাদেশ সময়: ১১০৩ ঘণ্টা, জুলাই ২৩, ২০২২
এইচএমএস/এসআইএস 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।