রংপুরের তিন উপজেলায় ১১ জনের শরীরে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। শুরুতে জেলার পীরগাছা উপজেলায় এর সংক্রমণ শনাক্ত হলেও পরে পার্শ্ববর্তী কাউনিয়া ও মিঠাপুকুর উপজেলায়ও ছড়িয়ে পড়ে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) বিশেষজ্ঞরা অ্যানথ্রাক্সের এই ১১ রোগী শনাক্ত করেছেন। গত ১৩ ও ১৪ সেপ্টেম্বর তারা পীরগাছার ১২ জনের নমুনা সংগ্রহ করেন। পরীক্ষায় আটজনের অ্যানথ্রাক্স ধরা পড়ে। আর বুধবার (১ অক্টোবর) কাউনিয়ায় দুজন ও মিঠাপুকুরে একজন রোগী শনাক্ত হন।
অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু শনাক্ত হওয়ায় স্থানীয় জনমানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনেকে গরু-ছাগলের যত্ন নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন, আবার অনেকে গরুর মাংস খাওয়াও বাদ দিয়েছেন। এতে স্থানীয় মাংস ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। খামারে পড়ছে বিরূপ প্রভাব।
আইইডিসিআর সূত্র জানা যায়, ফ্রিজে রাখা গরুর মাংসে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু পাওয়া গেছে। আক্রান্তদের মধ্যে একজন ছাগলের মাংসের সংস্পর্শে ছিলেন।
রংপুরের সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, গত জুলাই ও সেপ্টেম্বরে পীরগাছায় দুজনের মৃত্যু হয়। তাদের শরীরে অ্যানথ্রাক্স জীবাণু থাকলেও মৃত্যু হয়েছে অন্য কারণে। একই সময়ে চার ইউনিয়নে অন্তত ৫০ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন। এর মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশই সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, গত দুই মাসে অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত শতাধিক গবাদিপশু মারা গেছে। অথচ রংপুর মহানগরী ও জেলায় প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজার পশু জবাই হলেও স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয় না। বিভাগজুড়ে এক হাজার ৩০৩টি হাট-বাজার থাকলেও কোথাও নেই আধুনিক কসাইখানা বা ভেটেরিনারি সার্জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যানথ্রাক্স-আক্রান্ত গবাদিপশুর শ্লেষ্মা, লালা, রক্ত, মাংস, হাড়, নাড়িভুঁড়ির সংস্পর্শে এলে মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়। এ রোগ গবাদিপশু থেকে মানুষে ছড়ায়। তাই অ্যানথ্রাক্সকে জুনোটিক ডিজিজ বলা হয়। তবে এই রোগ মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। মানুষের শরীরে এ রোগের প্রধান লক্ষণ হচ্ছে চামড়ায় ঘা সৃষ্টি হওয়া।
অ্যানথ্রাক্স হলো ব্যাসিলাস অ্যাথ্রাসিস নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত একটি রোগ। মাটির নিচে বহু বছর এরা বেঁচে থাকতে পারে। বর্ষা মৌসুমে এরা মাটির নিচ থেকে ওপরে উঠে আসে। গরু, ছাগল, মহিষ বা ভেড়া ঘাস খাওয়ার সময় এদের শরীরে এই ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করে। জীবাণু শরীরে প্রবেশের পর গবাদিপশু খুব দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়ে।
যেভাবে অ্যানথ্রাক্স ছড়ায়
অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু মূলত ছড়ায় আক্রান্ত প্রাণীর মাধ্যমে। মাটিতেও থাকতে পারে এই জীবাণু। কেউ যদি অসুস্থ প্রাণীর মাংস খায় কিংবা শ্বাসের মাধ্যমে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু শরীরে ঢুকে যায় তাহলে তিনি এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। মানুষের হাঁচি-কাশির মাধ্যমে অ্যানথ্রাক্স ছড়ায় না। ত্বকে কোনো ক্ষত থাকলে সেই ক্ষত দিয়ে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু প্রবেশ করতে পারে।
অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ
কারও দেহে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু কীভাবে প্রবেশ করছে, তার ওপর এর উপসর্গ নির্ভর করে। মাংস খাওয়ার মাধ্যমে আক্রান্ত হয়ে থাকলে বমিভাব, বমি, রক্তবমি, পেটব্যথা, মাথাব্যথা, ক্ষুধামান্দ্য, জ্বর, গলা ব্যথা বা ঘাড় ফুলে যেতে পারে। রক্তমিশ্রিত পাতলা পায়খানা হতে পারে।
নিশ্বাসের মাধ্যমে অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত হলে গলাব্যথা, পেশি ব্যথা, জ্বর, ক্লান্তি দেখা দিতে পারে। পাশাপাশি বুকে অস্বস্তি এবং শ্বাসকষ্ট হতে পারে। বমিভাব থাকতে পারে। কফের সঙ্গে রক্ত আসতে পারে। ঢোক গিলতে ব্যথা হতে পারে। জ্বরের তীব্রতাও বাড়তে পারে। মস্তিষ্কের পর্দায় হতে পারে প্রদাহ। রক্তচাপ কমে যেতে পারে।
ত্বকের মাধ্যমে ছড়ালে ত্বকে পোকার কামড়ের মতো ফোলা ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে। চুলকানিও হয়। পাশাপাশি ক্ষতস্থানের মাঝখানে কালো হয়ে যায়। ক্ষতের আশপাশেও ফুলেও যেতে পারে।
অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধে বিশেষজ্ঞদের মতামত
মাংস খুব ভালোভাবে সেদ্ধ করে রান্না করে খেতে হবে। শরীরে কোনো ক্ষত থাকলে কাঁচা মাংস নাড়াচাড়া করার সময় গ্লাভস ব্যবহার করতে হবে। গবাদিপশুকে নিয়মিত অ্যানথ্রাক্সের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অসুস্থ গবাদিপশুর মাংস খাওয়া, কাটাকুটি করা বা নাড়াচাড়া করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু মাটিতে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে। বর্ষাকালে গবাদিপশু ঘাসের মাধ্যমে অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়। মানুষ পরিবেশ থেকে অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয় না, তবে প্রাণী থেকে আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত প্রাণী যারা নাড়াচাড়া করে, কিংবা মাংস কাটাকাটি করে, তাদের শরীরে সামান্য কাটা কিংবা ক্ষত থাকলে, আবার মাংস কাটার সময়েও অনেক সময় হাত সামান্য কেটে যেতে পারে, তখন এই সংক্রমণ ঘটে।
অ্যানথ্রাক্স আক্রান্তের চিকিৎসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটার চিকিৎসা পদ্ধতি খুব সহজ। সিপ্রোফ্লক্সাসিন ট্যাবলেটে কাজ হয়। অ্যানথ্রাক্সে মানুষের মৃত্যু একেবারে নেই বললেই চলে। অন্যদিকে আমরা অনেক হাই হিট দিয়ে দীর্ঘক্ষণ মাংস রান্না করি, এতে আক্রান্ত পশুর মাংসও যদি কেউ খায়, তাতে করে সংক্রমণ হবে না। এই রোগে আতঙ্কের কিছু নাই, তবে স্বাস্থ্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, মানুষকে সচেতন করতে হবে যেন এটা বেশি না ছড়ায়।
আরকেআর/এইচএ/