রাজধানীর পল্লবীতে আধিপত্য বিস্তার ও মাদক কারবারকে কেন্দ্র করে একের পর এক সহিংস ঘটনা ঘটে চলেছে। গত কয়েক সপ্তাহে পল্লবীর বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসী হামলা, গুলি ও কুপিয়ে জখমের ঘটনা ঘটেছে।
বেগুনটিলা বস্তিতে সন্ত্রাসী মাসুম গ্রুপের তাণ্ডব
১৭ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৯টার দিকে পল্লবী থানাধীন মিরপুর-১২ নম্বর সেকশনের বেগুনটিলা বস্তিতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসী মাসুম গ্রুপ গুলি চালায়। এ সময় অস্ত্রধারী জীবন, সাহেব আলী, নাদিম ও মাসুম এলাকার দোকান লুটপাট করেন এবং ৬টি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে এলাকায় অবস্থান নেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানায়, মাসুম ওরফে ভাগ্নে মাসুম বস্তিতে প্রকাশ্যে তিনটি গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন। এ সময় সন্ত্রাসীরা ৬টি আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন করে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে।
চাঁদা না পেয়ে মাদক কারবারিকে কুপিয়ে জখম
১৩ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১০টার দিকে কালশী ২২ তলা গার্মেন্টস সংলগ্ন আদর্শনগর ডুইপ এলাকায় চাঁদা দাবিকে কেন্দ্র করে মাদক কারবারি লাভলীকে (৪৫) কুপিয়ে ও তার ভাই সুমন মিজিকে (৩২) গুলি করে রক্তাক্ত জখম করে সন্ত্রাসীরা। হাড্ডি সোহাগ, বাদশা ও তাদের সহযোগীরা এ হামলায় অংশ নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, সেনাবাহিনীর কাছে তথ্য দেওয়ার সন্দেহে দীর্ঘদিন ধরেই লাভলী ও সুমনকে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। হামলার পর সেনাবাহিনীর একটি টিম ঘটনাস্থল থেকে ৮-১০ জনকে গ্রেপ্তার করে। বর্তমানে গুরুতর আহত সুমন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এবং লাভলী চিকিৎসা শেষে বাসায় ফিরেছেন।
গুলিবিদ্ধ ভুক্তভোগী সুমনের ভাই মামুন অভিযোগ করে বলেন, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরে আমরা তাকে (সুমন) হাসপাতালে নিয়ে যাই চিকিৎসার জন্য। এই হামলার ঘটনার দুইদিন পরে পল্লবী থানায় মামলা করতে গেলে মামলা নেয়নি পুলিশ। থানায় মামলা করতে যাওয়ার তথ্য হামলাকারীরা কীভাবে যেন পেয়ে যায়। থানার কোনো কর্মকর্তা তাদের জানিয়ে দেন। আমার ভাই গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় এখন পর্যন্ত মামলা করতে পারিনি!
মাদকবিরোধী অবস্থানের কারণে ছাত্রদল নেতার ওপর হামলা
৪ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে সেকশন-১১ এর মিল্লাত ক্যাম্প এলাকায় ছাত্রদল নেতা ও পল্লবী থানা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সৈয়দ হাসান সোহেলকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে স্থানীয় মাদক কারবারিরা। হামলায় তার ভাই সৈয়দ হাসান রনি, ছাত্রদল নেতা হৃদয় ও ডলারও আহত হন।
এলাকাবাসী জানান, দুই দিন আগে সোহেল এলাকায় মাদকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় আলোচিত মাদক সম্রাজ্ঞী ‘পৃথিবী’র ভাই-বোন এবং শীর্ষ সন্ত্রাসী হুদা মামুনসহ শতাধিক কারবারি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। পুলিশের মাদক নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণেই এ হামলা সংঘটিত হয়েছে।
মাদকের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে সংঘর্ষ
চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে রাজধানীর মিরপুরে পল্লবী থানা এলাকায় মাদকের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন দুজন। মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের ‘ই’ ব্লকের ১ নম্বর সড়কে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় আহত হন মো. জসিম উদ্দিন (৪৪) ও তার বোন শাহিনুর বেগম (৩২)। তাদের একজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
এ ঘটনায় পুলিশ জানায়, মাদক ব্যবসার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে ওই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। মিরপুর ১১ নম্বর সেকশন এলাকার শহীদুল ও তুহিন গ্রুপের সঙ্গে জসিম ও তার বোন শাহিনুর মাদক ব্যবসা করেন। তাদের মধ্যে টাকা ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব বাঁধে। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। এতে জসিম ও তার বোন শাহিনুর গুলিবিদ্ধ হন।
মাদক কারবারিদের গুলিতে গৃহবধূ নিহত
২০২৪ সালের ৩০ অক্টোবর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে পল্লবী থানাধীন মিরপুর ১১ নম্বরের বাউনিয়াবাঁধ ‘বি’ ব্লকে চিহ্নিত মাদক কারবারি মমিন, শাবু, সম্রাট, শামিম, জয়নাল, ইদ্রিস, কালা মোতালেব, কামাল, জাহাঙ্গীর, আল ইসলাম, ভেজাল মামুন, জয়, ইউনুস, রুবেলসহ অজ্ঞাতনামা ১৪-১৫ জন এলাকার শীর্ষ মাদক কারবারি মামুনের কাছে চাঁদা দাবি করেন। এ নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে বাউনিয়াবাঁধ ‘বি’ ব্লকের একটি বাসার দ্বিতীয় তলার সিঁড়ির করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকা আয়েশা আক্তার গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, পল্লবীতে আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি ও মাদক কারবারিকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটছে। এতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। তারা দ্রুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
ডিএমপির সূত্র জানায়, মিরপুর বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম হচ্ছে পল্লবী থানায়। গত আগস্ট মাসে এ থানায় দুই শতাধিক মামলা হয়েছে। আর চলতি মাসে আগের মাসের তুলনায় মামলার সংখ্যা আরও বেশি বলে জানিয়েছে সূত্র।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) শফিউল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, মিল্লাত ক্যাম্প এলাকায় ছাত্রদল নেতা সোহেলের ওপর হামলার ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। বেগুনটিলা এলাকায় গোলাগুলির ঘটনায় ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। তবে সেখানে গোলাগুলির কোনো আলামত পাইনি।
সুমন গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় কোনো মামলা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ঘটনায় কেউ মামলা করতে থানায় আসেনি। মামলা দেওয়ার জন্য ভুক্তভোগীর পরিবারকে থানায় ডেকেছি। তারা এখন পর্যন্ত মামলা বা কোনো অভিযোগ করেনি।
এক প্রশ্নের জবাব হবে ওসি বলেন, আমরা পল্লবী থানা এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তৎপর আছি। মাদকবিরোধী অভিযান চলমান আছে। প্রতিনিয়ত মাদক মামলা নেওয়া হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, “পল্লবী এলাকায় সম্প্রতি বেগুনটিলা বস্তিতে গুলি, কালশীতে মাদক ব্যবসায়ী লাভলী ও তার ভাইকে কুপিয়ে-গুলিবিদ্ধ করা, ছাত্রদল নেতার ওপর হামলা কিংবা চাঁদার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে সংঘর্ষ—সবকিছুর মূলে রয়েছে মাদক। যখন কোনো এলাকায় মাদকের আখড়া থাকে, তখন সেটিকে ঘিরেই আধিপত্য ও চাঁদাবাজির দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এর ফলেই নিয়মিত সংঘর্ষ, গুলি ও প্রাণহানি ঘটছে। ”
তিনি আরও বলেন, “পল্লবীর মতো এলাকায় দিনে-দুপুরে ও রাতে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের প্রকাশ্যে গুলি চালানো, দোকান লুট করা বা রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর হামলা করা—এগুলো স্পষ্ট করে যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসাধু কর্মকর্তা মাদক কারবারিদের মদত দিচ্ছে। এসব তাদের অজানা নয়। ”
এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, শুধু আর্থিক সুবিধার জন্যই কিছু পুলিশ কর্মকর্তা এই কারবারিদের ছায়া দিচ্ছে। যতদিন না এসব অসৎ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে, ততদিন মাদকের বিস্তার রোধ করা যাবে না। আর ততদিন সাধারণ মানুষকে এভাবেই আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করতে হবে।
এমএমআই/এমজেএফ