ঢাকা, সোমবার, ১৪ আশ্বিন ১৪৩২, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৬ রবিউস সানি ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

এআই আতঙ্ক: অপপ্রচারে প্রার্থিতা বাতিল, হবে জেল-জরিমানাও

ইকরাম-উদ দৌলা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:২২, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২৫
এআই আতঙ্ক: অপপ্রচারে প্রার্থিতা বাতিল, হবে জেল-জরিমানাও

ঢাকা: এইআই প্রযুক্তি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে নির্বাচনের মাঠে অপপ্রচার চালালে জেল-জরিমানার বিধান রাখছে নির্বাচন কমিশন- ইসি। একইসঙ্গে প্রার্থিতা বাতিলের বিধানও রাখা হচ্ছে।

দণ্ড শুধু ব্যক্তির ক্ষেত্রে নয়, রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতা থাকলেও গুনতে হবে জরিমানা।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই নেট দুনিয়ায় বর্তমানে বেশ তুমুল জনপ্রিয় এক প্রযুক্তি। এমন কোনো ভার্চ্যুয়াল কাজ নেই যা এর মাধ্যমে করা যায় না। হোক সেটা ভালো কিংবা মন্দ। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে যেমন কারো কণ্ঠ হুবহু নকল করে বক্তব্য প্রচার করা যায়, তেমনি ছবি সম্পাদনা করে থেকে শুরু করে ভিডিও, সব মাধ্যমেই মিথ্যাকে সত্যের মতো করে উপস্থাপন করা যায়।

সামনে আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আর এই নির্বাচন এআই-এর অপব্যবহার করে প্রপাগান্ডা চালানোর আশঙ্কা রয়েছে। উন্নত বিশ্বেও এ ধরনের ঘটনা ইতিমধ্যে ঘটেছে। যার ঢেউ এসেছে পড়েছে বাংলাদেশেও। তাই ভোটে এআইভিত্তিক অপপ্রচার এখন অনেকটা আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এআই-এর অপব্যবহার করে ভোটের মাঠ দখলের চেষ্টা হতে পারে বলে আশংকা সংশ্লিষ্টদের। মিথ্যাকে সত্যের মতো করে উপস্থাপন, অপপ্রচার, মিথ্যাচার সবই হতে পারে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে। দেশে বা দেশের বাইরে থেকে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে ভোটের ফসল নিজের ঘরে তুলতে অনেকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে এআই। আর ধোঁকায় পড়তে পারে দেশের গণমাধ্যমও। নারী নেত্রীরাও সাইবার বুলিংয়ের আশংকা করছেন। ইতিমধ্যে তারা এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য দাবি তুলেছেন।

সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতে এবং ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে এআই-এর অপব্যবহার নিয়ে উদ্বিগ্ন নির্বাচন কমিশন (ইসি) এবং তার উন্নয়ন সহযোগীরাও। কানাডা ইতিমধ্যে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহায়তার আশ্বাসও দিয়েছে। কমিশনও প্রযুক্তির অপব্যবহারকে ঠেকাতে আইনি কাঠামোর মধ্যে এনেছে শাস্তির বিধান।

অংশীজনরা আশংকা করছেন নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হবে নারী প্রার্থীরা। তাই তাদের সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা দরকার। ইতিমধ্যে ১২টি সংগঠন নিয়ে গঠিত ‘নারীর রাজনৈতিক অধিকার ফোরাম’ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছে।

নারী নেত্রী ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য মাহীন সুলতানা এ বিষয়ে তারা ইসির কাছে লিখিত দাবি তুলে ধরেছেন। এতে বলা হয়েছে- নারী রাজনীতিবিদ ও প্রার্থীরা প্রায়শই অনলাইন এবং অফলাইন উভয় ক্ষেত্রেই হয়রানি, ভয়ভীতি ও অপমানজনক আচরণের শিকার হন, যা রাজনীতিতে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণকে নিরুৎসাহিত করে। এই সমস্যার সমাধানে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে অভ্যন্তরীণ নীতিমালা (code of conduct) প্রণয়ন করতে হবে, যাতে কোনো নারী কর্মী বা নেত্রী দলীয় বা আন্তঃদলীয় হয়রানির শিকার হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। দলের অভ্যন্তরে কোনো ব্যক্তি যদি অপরাধী হয় এবং নীতিমালা ভঙ্গ করে তাহলে তার ব্যাপারেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যবস্থা থাকতে হবে।  

এছাড়া সরকার ও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে অনলাইন হয়রানি (digital harassment) প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট আইন, অভিযোগ গ্রহণের কাঠামো এবং দ্রুত প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে। প্রার্থীদের জন্য একটি সুরক্ষা ও সহায়তা সেবা চালু করতে হবে, যেখানে হয়রানি বা সহিংসতার ঘটনা ঘটলে তারা অভিযোগ জানাতে পারবেন এবং দ্রুত প্রতিকার পাবেন।

প্রার্থিতা বাতিল, হতে পারে জেল জরিমানা:
ভোটে অসৎ উদ্দেশ্যে প্রার্থী, তার এজেন্ট বা প্রার্থীর পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি সামাজকি যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্য কোনো মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহার করলে প্রার্থিতা বাতিল করে দেবে ইসি। একই সঙ্গে হতে পারে জেল জরিমানা। কেবল প্রার্থী নয়, দলের সংশ্লিষ্টতা থাকলেও থাকছে সংশ্লিষ্ট দলের জরিমানা।

রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর নির্বাচনী আচরণ বিধিমালায় ১৬ বিধি সংযোজন করে বলা হয়েছে, কোনো প্রার্থী বা তার নির্বাচনী এজেন্ট বা প্রার্থীর পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা পরিচালনা করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে প্রার্থী বা তার নির্বাচনী এজেন্ট বা দল বা প্রার্থী সংশ্লিষ্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নাম, অ্যাকাউন্ট আইডি, ই-মেইল আইডিসহ অন্যান্য শনাক্তকরণ তথ্যাদি প্রচার-প্রচারণা শুরুর পূর্বে রিটার্নিং অফিসারের নিকট দাখিল করতে হবে; প্রচার-প্রচারণাসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহার করা যাবে না; ঘৃণাত্মক বক্তব্য, ভুল তথ্য, কারো চেহারা বিকৃত করা ও নির্বাচন সংক্রান্ত বানোয়াট তথ্যসহ সকল প্রকার ক্ষতিকর কনটেন্ট বানানো ও প্রচার করা যাবে না; প্রতিপক্ষ, নারী, সংখ্যালঘু বা অন্য কোনো জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে ঘৃণাত্মক বক্তব্য, ব্যক্তিগত আক্রমণ বা উসকানিমূলক ভাষা ব্যবহার করা যাবে না; নির্বাচনী স্বার্থ হাসিল করার জন্য ধর্মীয় বা জাতিগত অনুভূতির অপব্যবহার করা যাবে না; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নির্বাচন সংক্রান্ত সকল কনটেন্ট শেয়ার ও প্রকাশ করার পূর্বে সত্যতা যাচাই করতে হবে; রাজনৈতিক দল, প্রার্থী বা প্রার্থীর পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি, ভোটারদের বিভ্রান্ত করার জন্য কিংবা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কোনো প্রার্থী বা ব্যক্তির চরিত্র হনন কিংবা সুনাম নষ্ট করার উদ্দেশ্যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্য কোনো মাধ্যমে, সাধারণভাবে বা সম্পাদন (Edit) করে কিংবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথা (Artificial Intelligence- AI) দ্বারা কোনো মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর, পক্ষপাতমূলক, বিদ্বেষপূর্ণ, অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ এবং মানহানিকর কোনো আধেয় (content) তৈরি, প্রকাশ, প্রচার ও শেয়ার করতে পারবেন না।

শাস্তির ক্ষেত্রে বিধিমালায় বলা হয়েছে, কোনো প্রার্থী বা তার পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি নির্বাচন পূর্ব সময়ে (তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের ফলাফল গেজেট আকারে প্রকাশ পর্যন্ত সময়) এই বিধিমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা অনধিক এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে; আর কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নির্বাচন পূর্ব সময়ে এই বিধিমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড করা হবে।  

এদিকে কমিশন যদি মনে করে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সংঘটিত অপরাধ প্রার্থিতা বাতিল হওয়ার মতো, তাহলে তদন্ত করে প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে।

কী বলছেন নির্বাচন কমিশনাররা:
নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ এ বিষয়ে বলেন, নারীর প্রতি সম্মান নিশ্চিতের লক্ষে যথাযথ কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সার্বিকভাবে নারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাদের জন্য সহনীয় অবস্থান তৈরির ব্যবস্থা থাকবে। এআই ব্যবহার করে যে কোনো ধরনের মিথ্যাচার বা অপবাদ ছড়ানো ইত্যাদি ব্যাপারে প্রার্থী, দল, সংস্থা, মিডিয়া সংস্থা সবার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। এটা একটা বৈশ্বিক সমস্যা। এটা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়।

এ বিষয়ে সিইসি এমএম নাসির উদ্দিন ইতিমধ্যে বলেছেন, আগামী এয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে সহায়তা দিতে চায় কানাডা। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি-ইউএনডিপি আমাদের পাশে আছে। তারা গ্যাপ থাকলে তা পূরণ করবে বলে জানিয়েছে। মিসইউজ অব এআই (এআই প্রযুক্তির অপব্যবহার) নিয়ে কথা হয়েছে। এটা আমাদের জন্যও হুমকি। আমরাও এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তারা বিষয়টি ছর্ট (sort) করতে চেয়েছে। গত বছর তাদের (কানাডা) নির্বাচনে এটা ফেস করতে হযেছে। তাই তারা তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে সাজেশন দেবে।

আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল দিতে চায় নির্বাচন কমিশন। এজন্য সব প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে সংস্থাটি।

ইইউডি/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।