ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৪ আশ্বিন ১৪৩২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭ রবিউস সানি ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

নির্বাচন নিয়ে বিএনপির আগ্রহ-জামায়াতের বিরোধিতায় ভাটা

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:৫৮, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৫
নির্বাচন নিয়ে বিএনপির আগ্রহ-জামায়াতের বিরোধিতায় ভাটা বিএনপি ও জামায়াতের লোগো

অন্তর্বর্তী সরকারের দেওয়া রোডম্যাপ অনুযায়ী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। তবে এ নির্বাচন নিয়ে বিএনপির আগ্রহ কিংবা জামায়াতে ইসলামীর বিরোধে ভাটা পড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া রোডম্যাপ ঘোষণা করার পর বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী মধ্যে যে তৎপরতা ছিল, এখন তা আর তেমন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। কেননা, বিএনপি ৫ আগস্ট পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকেই বলছে, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেশের জন্য মঙ্গলজনক। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী বলছে, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ হওয়ার পরই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নেওয়ার আলোচনা চলছে। নির্বাচনের সময় যতই নিকটে আসছে, ততই এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা ও সমালোচনা বাড়ছে। জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি করছে, তবে বিএনপি এর ঘোর বিরোধ করছে। এ কারণে ফেব্রুয়ারিতে সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মত ভিন্ন হচ্ছে। এতে নির্বাচনের বিষয়ে কিছু তৈরি হয়েছে শঙ্কা। কারণ প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তাদের মিত্ররা পিআর পদ্ধতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে।

৫ আগস্টের পরবর্তী পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। আগে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দাবিতে দল দুটি দীর্ঘদিন ধরে যুগোপথ আন্দোলন চালিয়ে এসেছে এবং মিছিল ও সমাবেশে অংশ নিয়েছে। জুলাই মাসে জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন ও সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে জামায়াত কিছু দলকে সঙ্গে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করলে বিএনপি পাল্টা কর্মসূচি নিয়েছে। এর মাধ্যমে সারাদেশে নির্বাচনী আবহ তৈরি করতে বিএনপি নেতারা সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রার্থী বাছাই, দলীয় ৩১ দফা ও ইতিবাচক কাজ প্রচার, ভোটারের সঙ্গে বাড়ি বাড়ি যোগাযোগ ও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দেওয়া সহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।

বিএনপি মনে করছে, জামায়াতের যুগপৎ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য নির্বাচনের আগে মাঠে নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা এবং নেতাকর্মীদের সক্রিয় রাখা। এই পরিস্থিতিতে বিএনপি নিজ দলের নেতাকর্মীদের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রাখার কৌশল নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীসহ সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের জনসম্পৃক্ত কাজ বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আগামী জাতীয় নির্বাচনে উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতি চালুর ও জুলাই সনদের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের মতো কয়েকটি অভিন্ন দাবিতে মাঠে নামছে জামায়াতে ইসলামী, চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং অন্য কয়েকটি সমমনা দল। প্রাথমিকভাবে এই দলগুলো ঢাকাসহ সারাদেশে তিন দিনের বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। পাশাপাশি তারা ধারাবাহিকভাবে আরও কর্মসূচি পালনের পরিকল্পনা করছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাবেক মিত্র জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের টানাপোড়েন কয়েক বছর ধরে চলছিল। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর এই টানাপোড়েন আরও বেড়ে যায়। ‘সংস্কার আগে না নির্বাচন আগে’— এই প্রশ্নে পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে বিএনপি ও জামায়াত বিবাদে জড়ায়। এর ফলে পাল্টাপাল্টি বক্তৃতা ও বিবৃতি বেড়েই চলেছে। বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের আগে অন্য কোনো নির্বাচন চায় না, কিন্তু জামায়াত আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাইছে। এমন নানা ইস্যুতে বিবাদ এতটাই বেড়ে গেছে, এখন দল দুটির নেতারা প্রতিনিয়ত একে অপরের বিরুদ্ধে মন্তব্য ও বিবৃতি দিচ্ছেন।

বিভিন্ন টকশো ও আলোচনা সভায় জামায়াতে ইসলামের নেতৃবৃন্দ ও প্রতিনিধিদের আত্মবিশ্বাস অনেক চোখে পড়ছে। অনেকে মনে করছেন, এটি সরাসরি শিবিরের সাম্প্রতিক সাফল্যের প্রতিফলন। অন্যদিকে, একই নির্বাচনের পর মাঠপর্যায়ে বিএনপির জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি বা নির্বাচন নিয়ে আলোচনা তুলনামূলকভাবে কমে গেছে বলে সাধারণ মানুষ ও মাঠকর্মীরা মনে করছেন। তবে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ তা অস্বীকার করে দাবি করছেন, তারা পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই জাতীয় নির্বাচনের পথে এগোচ্ছেন।

সরেজমিন ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু ও জাকসু) নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের বিজয়ের পর রাজনীতিতে উজ্জীবিত রয়েছে জামায়াতে ইসলামী। ফলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পিআর পদ্ধতিসহ জামায়াতে ইসলামীর ৫ দফা দাবির রাজনীতিতে নতুন আলোচনা সৃষ্টি হয়েছে। সেই কারণে নির্বাচনী আলোচনা কিছুটা কমে গেছে।

রাজধানীতে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা কমলেও স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা আগের মতোই চলছে। খোঁজ জানালে জানা গেছে, প্রতিদিন বিভিন্ন ওয়ার্ড, থানা ও উপজেলায় সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরা গণসংযোগে ব্যস্ত থাকছেন। জনসমর্থন বাড়াতে তারা জনগণের দ্বারে দ্বারে ছুটে চলেছেন।

গত ১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর বিএনপিতে নির্বাচনী আমেজ দেখা দিয়েছিল। সেই বৈঠক কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে নতুন আশাবাদ তৈরি করেছিল। তবে সরেজমিনে দেখা গেছে, ডাকসু-জাকসুর ফলাফলের পর বিএনপির অনেক নেতাকর্মী কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছেন, যা মাঠপর্যায়ের আলোচনাতেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে জানা গেছে, বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে এবং আলোচনা কমে যাওয়ার প্রবণতাও দেখা দিচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মাঠকর্মী জানিয়েছেন, শিবির সমর্থিত প্রার্থীদের অপ্রত্যাশিত বিজয় তাদের মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। জেলা পর্যায়ের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ডাকসু-জাকসু নির্বাচনের পর থেকে কর্মীদের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আগের মতো উদ্দীপনা নেই। অনেকেই মনে করছেন, এই নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ তৈরি করতে পারে, যা বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘বিএনপি পূর্ণ উদ্যম ও প্রস্তুতি নিয়ে জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। দলের তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনী কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছে। কিছু মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গুজব ছড়াচ্ছে, যাতে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। বিএনপি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ’

জাতীয় নির্বাচনে হাওয়ায় ভাটা পড়েছে কি না, এ ধরনের প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বাংলানিউজকে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। আমরা জানি ফেব্রুয়ারি ২০২৬ সালে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এজন্য সকল রাজনৈতিক দলই প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের দলও প্রার্থী ঘোষণা করাসহ কাজ করছে। ’

তিনি বলেন, ‘মূলত ঐকমত্য কমিশনে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিয়ে যে আলোচনা চলছে, তা বার্নিং ইস্যু। আমার ধারণা, এই বিষয়টির সমাধানের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো কিছুটা অপেক্ষা করছে। এর সমাধান হলে সামগ্রিকভাবে নির্বাচনের হাল বোঝা যাবে। ’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. দিলারা চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষনা অনুযায়ী আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ লক্ষ্যে সরকার ও নির্বাচন কমিশন কাজ করছে। আমরা আশা রাখি, উক্ত ঘোষণার অনুরূপ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ’

টিএ/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।