ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৫ আশ্বিন ১৪৩২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭ রবিউস সানি ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

উচ্চকক্ষে পিআরে আটকে আছে নির্বাচনী সমঝোতা

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:২৮, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৫
উচ্চকক্ষে পিআরে আটকে আছে নির্বাচনী সমঝোতা

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির বাস্তবায়নে জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বিভিন্ন ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নির্বাচনী সমঝোতা আটকে আছে। বিভিন্ন দল উচ্চকক্ষ ও বর্তমান সংসদে পিআর পদ্ধতির দাবি জানালেও বিএনপি শুধুমাত্র উচ্চকক্ষে পিআর মেনে নিলেই অনিশ্চয়তা কেটে নির্বাচনী ট্রেনের হুইসেল বাজবে বলে মনে করেন বিএনপি ও ইসলামী দলগুলোর একাধিক শীর্ষনেতা।

জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ঐক্যমত্য কমিশনের শীর্ষ কর্মকর্তারাও প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতির পক্ষে। এখন বিএনপি রাজি হলেই তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হতে পারে। যদিও এখন কমিশনের জুলাই সনদ বাস্তবায়নের কৌশল নিয়ে আলোচনা চলছে।

একাধিক ইসলামী দলের নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষে বা নিম্নকক্ষে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে সক্রিয় হওয়ার ঘোষণা দিলেও আদতে তারা এই দাবিতে বড় ধরনের সক্রিয় কর্মসূচিতে যাবে না। পতিত ফ্যাসিস্ট যাতে আন্দোলনে যুক্ত হয়ে নাশকতা করতে না পারে, এজন্যই তারা ভিন্ন কৌশল নিচ্ছে। নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ নির্বাচন বানচালের চক্রান্ত করছে— এটাও তারা বুঝতে পারছে। যুক্তরাষ্ট্রে আওয়ামী লীগের আগ্রাসী ভূমিকাও অনেককে ভাবিয়ে তুলেছে। আবার বিএনপিকে চাপে রাখতে যেকোনো মূল্যে তফসিলের আগেই বা সুবিধাজনক সময়ে তারা নির্বাচনী আসন বা পিআর ইস্যুতেও সম্মানজনক সমাধান চাইছে। নির্বাচন বর্জনের হুমকিও মূলত তাদের এই আন্দোলন ও নির্বাচনী প্রচারণার কৌশল।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির দাবিতে একমত হয়, তবে এটি বাস্তবায়ন করতে বড় কোনো জটিলতা থাকবে না। তার ভাষায়, সব দল যদি একসঙ্গে অবস্থান নেয়, তাহলে এক মাসের মধ্যেই এ পদ্ধতি বাস্তবায়ন সম্ভব। আমরা আন্দোলন করছি, দাবি জানাচ্ছি, পাশাপাশি আলোচনাও চালিয়ে যাচ্ছি। এই আন্দোলনের মাধ্যমে জাতিকে বোঝাচ্ছি যে আমাদের দাবি যৌক্তিক ও ন্যায্য।

সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, পিআর বা সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি সংবিধানে নেই, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশেও (আরপিও) নেই। আমাদের বিদ্যমান নির্বাচনি কাঠামোর মধ্যে পিআর পদ্ধতির কোনো স্থান নেই, আমরা আইন পরিবর্তন করতে পারি না।

এই প্রসঙ্গে গোলাম পরওয়ার মন্তব্য করেন, সংবিধান হোক বা আরপিও— সবই সংশোধনযোগ্য। সিইসির বক্তব্য একপেশে এবং এটি কোনো একটি দলকে খুশি করার জন্য দেওয়া হয়েছে বলে আমাদের মনে হয়।

পিআর পদ্ধতি আদায়ের পথে জামায়াতের জন্য চ্যালেঞ্জ বাড়বে কিনা— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আন্দোলন যেমন চলবে তেমনি আলোচনাও চলবে। ঐকমত্যের পথ এখনো বন্ধ হয়নি। সরকার চাইলে আমাদের আলোচনায় ডাকতে পারে।

যদিও তিনি গত ২ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ও জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেছিলেন, গণভোটে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন না হলে জামায়াতে ইসলামী সেটি মেনে নেবে।

গত শুক্রবার নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ করেন জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের। আলাপের শুরুতেই তিনি জানান, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের জন্য জামায়াতে ইসলামী প্রস্তুতি নিচ্ছে।

আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা সবাই এরসঙ্গে একমত। আমরাও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু তার আগে কিছু বিষয় আছে গুরুত্বপূর্ণ, যেগুলোকে সমাধান করা দরকার। যেমন- জুলাই সনদ, এটির বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন না হলে সেখানে একমত হওয়ার কোনো বাস্তবতা নেই।   

পিআর প্রসঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জানিয়েছে, তারা নিম্নকক্ষে নয়, উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চায়। তবে জামায়াত উচ্চ ও নিম্ন, দুই কক্ষেই পিআর চায়। এ ব্যাপারে তাহের বলেন, আমরা দুই কক্ষেই পিআর চাচ্ছি। ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে ৩১টি দল ছিলাম। এর মধ্যে ২৫টি দল পিআরের পক্ষে। কিন্তু কিছু পার্থক্য ছিল, কেউ উচ্চ কক্ষে পিআরের পক্ষে আবার কেউ উচ্চ ও নিম্ন দুই কক্ষেই পিআরের পক্ষে। কিন্তু পিআর চায় ৩১ দলের মধ্যে ২৫টি দল। সেজন্য আমরা পিআর চাচ্ছি।

পিআর শেষ পর্যন্ত না হলে নির্বাচনে অংশ নেবেন কিনা, প্রশ্ন করা হলে উত্তরে তিনি বলেন, ইফ, বাট— এগুলো রাজনীতিতে নাই। আমরা আমাদের দাবি করছি। আশা করি সরকার এটি মানবে, যেহেতু এটা জনগণের দরকার। এবং আমরা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনে অংশ নেব।

তাছাড়া জামায়াত নেতারা দাবি করছেন, দেশের বেশিরভাগ মানুষ ও দল পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিলে ভোট চুরি ও স্বৈরাচার হওয়ার সুযোগ থাকবে না। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে, জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের বিষয়ে সরকারকে কোনো সহযোগিতা করবে না বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন নেতারা।

ইসলামী আন্দোলনের একজন শীর্ষনেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, সবাই সবার স্বার্থ দেখছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সন্দেহ আর অবিশ্বাস বাড়ছে। এমনকি ইসলামী দলগুলোর মধ্যেও সন্দেহ ও অবিশ্বাস বাড়ছে, যেগুলো খালি চোখে দেখা যাচ্ছে না। এজন্য সবাই সমঝোতার মাধ্যমেই সামনে যাবে— এটাই প্রত্যাশা। এক্ষেত্রে বিএনপি অভিভাবকের ভূমিকা পালন করলে ভালো হতো। কিন্তু তারা আমাদের সম্পর্কে যেভাবে মন্তব্য করছে তা দুঃখজনক।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বাংলানিউজকে বলেন, জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন থেকে তো সংসদের উচ্চ বা নিম্নকক্ষে পিআরের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানানো হয়নি। এখন যারা এগুলো নিয়ে আন্দোলন করছে, তারা আসলে নির্বাচনী কৌশল হিসেবে এগুলো সামনে আনছে।

জ্যেষ্ঠ এই নেতা আরও বলেন, বিএনপি বারবারই বলেছে, নির্বাচিত সংসদ ঠিক করবে পরের সংসদের উচ্চকক্ষ বা নিম্নকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে সংসদ সদস্য মনোনয়ন সম্ভব কিনা কিংবা বিবেচনায় নেওয়া যায় কিনা।

শেষ পর্যন্ত সমঝোতার জন্য উচ্চকক্ষের ব্যাপারে বিএনপির ছাড় দেওয়ার সম্ভাবনার বিষয়ে দুদু বলেন, যারা আন্দোলন করছে পিআর নিয়ে— এগুলো তো রাজনৈতিক কর্মসূচি। আসলে তারা নির্বাচনী অন্যান্য বিষয়ে আলোচনার জন্যই এগুলো সামনে আনছে। দেখা যাক কী হয়।

এ বিষয়ে ইসলামী দলগুলোর ঘনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আব্দুল লতিফ মাসুম বাংলানিউজকে বলেন, পিআর সিস্টেমটা ভালো, কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের অভিজ্ঞতা, শিক্ষা ও অন্যান্য অবস্থা বিবেচনায় সংসদের উচ্চ বা নিম্নকক্ষে একসাথে এই পদ্ধতি সময়োপযোগী কি না তা বিবেচনার দাবি রাখে। তাই সংসদের উচ্চকক্ষে এই পদ্ধতিতে সদস্য নির্বাচন হলে অন্তত জনগণ বা রাজনৈতিক দলগুলোও এর ভালো-মন্দ অবস্থা বুঝতে পারবে।

তাহলে বিএনপি ও অন্যান্য দল শেষ পর্যন্ত উচ্চকক্ষে পিআর সিস্টেমে সমঝোতায় আসছে— এমন সম্ভাবনা দেখছেন কিনা জানতে চাইলে ড. মাসুম বলেন, একজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে মনে হচ্ছে, উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে বিএনপি রাজি হলে এনসিপি, জামায়াত, চরমোনাই পীর ও অন্যান্য ইসলামপন্থী বা তাদের সমমনা দলগুলো নিম্নকক্ষে বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতিতেই নির্বাচনে অংশ নেবে। আমার মনে হয় এ ব্যাপারে সমঝোতার সম্ভাবনা রয়েছে।

এনডি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।