কুড়িগ্রাম: অর্ধশতাধিক নদ-নদী বেয়ে ছড়িয়ে থাকা কুড়িগ্রাম জেলার চার শতাধিক চর যেন আজ বেদনার আরেক নাম। আগাম বন্যা আর ভারী বর্ষণে ভাঙনে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে জেলার ৯টি উপজেলার বহু চর।
ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, দুধকুমার আর তিস্তার আগ্রাসী ছোবলে ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, ভিটেমাটি হারিয়ে বারবার স্থানান্তরিত হতে হতে এখন কোনঠাসা অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে চরবাসী।
সরেজমিনে ঘোগাদহ ইউনিয়নের প্রথম আলো চর ও যাত্রাপুর ইউনিয়নের বারো বিশের চরে গিয়ে দেখা গেল, একসময়ের দূরবর্তী গ্রামের ভূমি এখন ভাঙনের কারণে আরও কাছাকাছি চলে এসেছে। দুই গ্রামের মাঝখানে চর রসূলপুরে পরের জমিতে টিনের ঘর তুলে থাকেন শাহ জামাল-মাজেদা বেগম দম্পতি। বৃদ্ধ বাবা-মা আর চার সন্তানসহ মোট আটজনের সংসার।
সংসারের অভাব ঘোচাতে শাহ জামাল কাজ করছেন দূরের একটি ইঁটভাটায়। কবে ফিরবেন জানা নেই। ছেলে মেয়েদের নিয়ে মাজেদা মহাসঙ্কটে।
মাজেদা বেগম বলেন, একমাস আগে ভগবতিপুর চর থাকি ব্রহ্মপুত্র বাড়ি ভেঙেছে। সংসারে অভাব। তাই ঈদে গাড়ি ভাড়া বেশি দিয়ে ছাওয়ার বাপে বাড়ি আসপের নয়। ঈদের খরচ করার জন্যি কিছু টাকা পাঠাইছে। ছোট ছাওয়াটার একটা শার্ট কিনছি। ঈদের দিন ব্রয়লার মুরগি কিনি আনমো। ওইটা দিয়েই ঈদ চলি যাইবে। ভাঙ্গা-গড়ার জীবন হামার, ঈদ কোথায় পামো?
তিনি জানান, ঢাকায় থাকা তার স্বামী কখনও সামান্য টাকা পাঠান, কখনও পাঠাতে পারেন না। বাচ্চারা তাদের বাবার আসার অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু কোরবানীর ঈদের তার বাড়ি ফেরা হবে কিনা, জানেন না।
ওই গ্রামের তিন শতাধিক পরিবারের অধিকাংশ পুরুষ ঢাকাসহ দেশের নানা জায়গায় রিকশা চালানো, ইঁট ভাঙা কিংবা কৃষি শ্রমিকের কাজ করেন। যারা গ্রামেই থাকেন, তারা কৃষিকাজ কিংবা দিনমজুরিতে সংসার চালান। নারীরাও পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে খুঁজে নেন জীবিকার উৎস। তবে প্রতিদিনের আয়ে দৈনিক খরচ চলানোই যেখানে কষ্টসাধ্য, সেখানে ঈদের কেনাকাটা যেন বিলাসিতার মতো। ঈদের প্রসঙ্গে কখনো তাদের কণ্ঠে বিষাদ, কখনো ক্ষোভ।
উলিপুর উপজেলার আইরমারী চরের শহিদুল ইসলাম জানান, এ বছর চরে মানুষের অভাব বেশি। আগে ৩-৪টা গরু কোরবানী হতো। এ বছর ৫ জন ভাগে একটা গরু কোরবানী দিচ্ছেন। আবারে, দুজন মিলে দুটি ছাগল দিয়ে কোরবানী দিচ্ছেন। অনেকে ব্রয়লার মুরগি কিনে খাবে। কেউ হয়ত ঘরের হাঁস-মুরগি জবাই করবে।
জেলা জুড়ে প্রায় অর্ধশতাধিক চরে একই অবস্থা। কুরবানির পশু কিনতে না পারায় আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে। কোথাও হয়ত একটি গরু কোরবানি হয়। কিন্তু আইরমারী চরে এবার একটি গরুও কোরবানী হবে না।
হলোখানা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম বলেন, আমার ইউনিয়নের পশ্চিম সাড়োডোব, ঢেপরির ও লক্ষিকান্ত— এই তিনটি চরে সাধারণত কোরবানি হয় না। আমার জানামতে, এসব চরে সরকারি বা বেসরকারিভাবে এ বছরও কোনো কোরবানি হচ্ছে না।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাঈদা পারভীন বলেন, কুড়িগ্রামের বিভিন্ন চর ও আশ্রয়কেন্দ্রের মানুষের জন্য ৬০টি পশু কোরবানি দেওয়া হচ্ছে। সেসব পশুর মাংস সংশ্লিষ্ট পরিবারের মধ্যে বিতরণ করা হবে।
এমজে