রাজধানীর মিরপুর ১১ নম্বর সেক্টরের জান্নাতুল মাওয়া কবরস্থানে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ মো. কালামের কবর গুঁড়িয়ে দিয়ে আরেকজনকে দাফন করার অভিযোগ উঠেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং সেই শহীদের পরিবার বলছে, চলতি বছরের জুলাই মাসে জুলাইশহীদের কবর সংরক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হলেও মিরপুরে শহীদকে অসম্মান করতে কবর গুঁড়িয়ে দিয়ে আরেকজনকে দাফন করা হয়েছে।
শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা, জুলাইশহীদ মো. কালামের পরিবার জান্নাতুল মাওয়া কবরস্থানে উপস্থিত হয়ে এ অভিযোগ করেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শহীদ ও আহত সেলের সম্পাদক মোহাম্মদ তামিম খান বলেন, জুলাইশহীদের কবর সংরক্ষণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়। সক্ষম পরিবারের পক্ষ থেকে কবর সংরক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু মিরপুরের কবরস্থানে কালামের কবরের ওপরে আরেকজনকে দাফন করা হয়েছে। জেনে-বুঝে জুলাইশহীদদের অসম্মান করার জন্য এটা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা জুলাইযোদ্ধারা অপমানিত বোধ করছি। এর প্রতিকার করতে হবে, পাশাপাশি সারা দেশে আরও কোথাও এমন পরিস্থিতি যেন না হয় সরকারকে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
কালামের পরিবার যা বলছে
জুলাই আন্দোলনে শহীদ কালামের স্ত্রী ও মেয়েরা জানান, পরিবারের পক্ষ থেকে এক-দুই মাস পর পর কবর দেখে যাওয়া হয়। তেমনি চলতি সেপ্টেম্বর মাসের ১৮/১৯ তারিখে কবর দেখতে এসে দেখা যায়, কবরটি নেই। জুলাইশহীদের কবরে অন্য কাউকে দাফন করা যাবে না, সংরক্ষণ করতে হবে। কেন সংরক্ষণ না করে আরেকজনকে দাফন করা হলো, এমন প্রশ্ন করা হলে কেউ সঠিক জবাব দিতে পারেনি।
কালামের তিন মেয়ে তাদের বাবাকে শহীদ হিসেবে সরকারের গেজেট, নম্বর, কবরস্থানের ছবি ও নামফলক দেখিয়ে বলেন, আমাদের কাছে সব ডকুমেন্ট থাকলেও তারা বিবেচনা করেনি। ছোট্ট নামফলকটিও বিবেচনায় নেয়নি।
কবরস্থান কর্তৃপক্ষ যা বলছে
কবরস্থান মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা নুরুজ্জামান বলেন, সাধারণ কবর এক বছর পর ভেঙে দিয়ে ওই কবরে আরেকজনকে দাফন করা হয়। ২০২৪ সালের ২০ জুলাই জান্নাতুল মাওয়া কবরস্থানে মো. কালামের ‘স্ট্রোকজনিত’ মৃত্যু দেখিয়ে কবর দেওয়া হয়। রেজিস্টারেও সে হিসেবে লেখা হয়। সে অনুযায়ী, এক বছর দুই মাস পর মো. কালামের কবরে আরেকজনের কবর দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, কবর খোঁড়ার কাজটি অধিকাংশ সময়ে লেখাপড়া না জানা মানুষ করে থাকে। এছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বলেন, বা পরিবারের পক্ষ থেকেও বলা হয়নি। বরং ‘স্ট্রোকজনিত’ কারণে মারা গেছে বলা হয়। এজন্য সাধারণ কবর হিসাবে এক বছর অতিক্রম করার পর একই কবরে আরেকজনকে দাফন করা হয়েছে। এটা একটি সাধারণ রীতি। কবরে ছোট্ট একটি নামফলক লিখে রেখে গেলেও সেটি বোঝার উপায় ছিল না। পরে কখনো লাগিয়ে রেখে গেছে, যা দেখে বোঝার উপায় ছিল না।
কবরস্থানের রেজিস্টারে যা লেখা রয়েছে
কবরস্থানের রেজিস্টারে দেখা যায়, ২৭০০ নম্বর ক্রমিকে, ৫৩১ নম্বর রশিদে, ২০ জুলাই-২০২৪ তারিখে মো. কালামের নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে। কালামের ঠিকানা, বয়স, বাবা, মা ও এনআইডি লেখা হয়েছে। মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করা হয়েছে ‘স্ট্রোকজনিত’।
‘স্ট্রোকজনিত মৃত্যু’ লেখার ব্যাখ্যা পরিবারের
‘স্ট্রোকজনিত’ কারণে মৃত্যু হলে শহীদের তালিকায় নাম কেন, কেনইবা কবর সংরক্ষণ করা হবে-এমন প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয় পরিবার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে। বলা হয়, ১৯ জুলাই দেশে ক্ষমতায় ছিলেন শেখ হাসিনা। তখন গুলিতে মারা গেছে জানতে পারলে পরিবারের ওপর নির্যাতনের শিকার হবে, এজন্য মৃত্যুর কারণ ‘স্ট্রোকজনিত’ উল্লেখ করা হয়।
এক বছর দুই মাস পর ‘স্ট্রোকজনিত’ মৃত্যু লেখা বদলানোর উদ্যোগ
এক বছর দুই মাস পর মৃত্যুর কারণ ‘স্ট্রোকজনিত’ লেখা পরিবর্তন করে ‘গুলিতে নিহত’ লেখার উদ্যোগ নেয় কালামের পরিবার। তারই অংশ হিসেবে কবরস্থান কমিটি থেকে একটি প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু কবরস্থান কর্তৃপক্ষ প্রত্যয়নপত্রে রেজিস্টারে উল্লিখিত ‘স্ট্রোকজনিত’ কারণ উল্লেখ করে। প্রত্যয়নপত্র নেওয়ার পর ‘ওপরে’র পরামর্শে সেটা ফেরত দেওয়া হয়। যা কবরস্থান কর্তৃপক্ষের অফিসে সংরক্ষিত রয়েছে। গুলিতে মৃত্যু হয়েছে এমন প্রমাণ করতে অ্যাফিডেভিট জমা দেয় পরিবারে।
কবরস্থানের মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা নুরুজ্জামান জানান, ‘স্ট্রোকজনিত মৃত্যু’র পরিবর্তে ‘গুলিতে নিহত’ লেখা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। প্রয়োজনীয় নিয়ম অনুসরণ করে লেখা হবে।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিগ্যাল সেলের সম্পাদক মোতাসসিম বিল্লাহ মাহফুজ, শহীদ কালামের মেয়ে শারমিন আক্তার, ইয়াসমিন আক্তার ও চাঁদনী আক্তার।
জেডএ/এইচএ/