ঢাকা, বুধবার, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২৮ মে ২০২৫, ০০ জিলহজ ১৪৪৬

মুক্তমত

খালেদা জিয়া হতে পারেন রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের নিয়ামক

শরিফুল ইসলাম খান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০:৩৯, মে ২৬, ২০২৫
খালেদা জিয়া হতে পারেন রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের নিয়ামক খালেদা জিয়া

ঢাকা: যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ! দেশের মানুষ মনেপ্রাণে চায়, মিথ্যা হোক প্রাচীন মহাকাব্য ‘রামায়ণ’ থেকে আসা এই প্রবাদ। কারণ সত্য প্রমাণিত হলে আরো ভয়াবহ সংকটে পড়বে বাংলাদেশ।

পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হবে, বাড়বে সংঘাত-সহিংসতা।

তখন বাংলাদেশ ঘিরে সক্রিয় হবে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা। রাজনীতির সমীকরণও বদলে যাবে জ্যামিতিক হারে। একসময় চড়া মূল্য গুনতে হবে সাধারণ মানুষকে।

গত দুই দিন সংকট নিরসনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা।


প্রতিটি দলই নিজেদের অবস্থানে অনড়। এক দল আগে ভোট চায়, অন্যরা চায় সংস্কার। আবার কোনো দল চায় সংস্কার ও বিচার শেষ করে হোক জাতীয় নির্বাচন। বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে জোরালো দাবি থাকলেও আশ্বাস মেলেনি নির্বাচনী রোডম্যাপের।

ফলে সাধারণের আশাবাদী হওয়ার সুযোগ খুবই কম।  
অথচ অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল, আশায় বুক বেঁধেছিলে ড. ইউনূস ম্যাজিকে বদলে যাবে বাংলাদেশ। ফ্যাসিবাদের বদলে প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য-সুন্দর-মানবিক এক কল্যাণ রাষ্ট্র, যেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকবে, আসবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। সেই সঙ্গে মুক্তবাক-মুক্তচিন্তা নিশ্চিত হবে, ন্যায়বিচার পাবে মানুষ। সব মিলিয়ে ভোটাধিকার ফিরে পেয়ে গণতন্ত্রের পথে হাঁটবে লাল-সবুজের বাংলাদেশ।

স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতির ব্যাপারে বেশ সচেতন বাংলাদেশের মানুষ। সম্প্রতি গুজব-গুঞ্জন আর নানামুখী আলোচনা-সমালোচনায় এক ধরনের ভীতি আছে আবার মজা পাচ্ছে তারা। অন্যদিকে রাজনৈতিক সংকটে বড় বিপাকে পড়েছে কেউ কেউ। কারণ রাজনীতি ঘিরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে, অস্থিরতায় অনিশ্চয়তা দেখা দিচ্ছে সব সেক্টরে।  

কেবল রাজনীতি নয়, অর্থনীতির দশাও করুণ। আওয়ামী লুটপাটে ভঙ্গুর অর্থনীতিতে এখনও প্রাণ ফেরেনি, বরং নানা রকম হয়রানিতে আছেন দেশের ছোট-বড় ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। মুদি দোকানি থেকে করপোরেট ব্যবসায়ী, ভালো নেই কেউ। এ ছাড়া নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও দেশি বিনিয়োগ কম, আগ্রহী না বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও। আর দেশি বিনিয়োগকারীরা যদি শঙ্কাহীন ব্যবসার পরিবেশ না পান, বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না, এটিই স্বাভাবিক। সব মিলিয়ে অর্থনীতিতেও এক ধরনের স্থবিরতা আছে। ভীষণ প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে কোনোভাবে টিকে আছেন সবাই।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা আরো ভয়াবহ। বিস্তারিত না বললেও এই খাত নিয়েই সাধারণ মানুষের অভিব্যক্তি ভালো না। কেন অল্পদিনেই সরকারের সমালোচনায় সরব হচ্ছে সাধারণ মানুষ, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীলরা সেটা খুব একটা আমলে নিচ্ছেন না। বৈষম্যবিরাধী ছাত্র আন্দোলন থেকে জন্ম নেওয়া এনসিপির জনপ্রিয়তার পারদ কেন নিম্নমুখী, বিবাদে জড়িয়ে সেই খবরও হয়তো রাখার সময় পান না তরুণ নেতারা। বিএনপি-জামায়াতও ক্ষমতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ভুলে যেতে বসেছে নতুন বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার।

সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, ফ্যাসিবাদমুক্ত নতুন বাংলাদেশে কী কী আমূল পরিবর্তন হয়েছে? কতটা বদলেছে রাজনৈতিক সংস্কৃতি? সাম্য আর ন্যায়বিচার পাচ্ছে মানুষ? নিরপরাধ মানুষের নামে কি মামলা হচ্ছে না? জামিন পেলেও কি আবার জেলগেট থেকে আটক করা হচ্ছে না? মানুষ কি রাস্তাঘাটে নিজেদের নিরাপদ অনুভব করছে? ঘুষ-অনিয়ম কি বন্ধ হয়েছে? নতুন নেতারা কি অনেক বিনয়ী আচরণ করছেন? তাঁদের ক্ষমতার দাপট কি খুব কম গেছে? দখল, চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে গেছে একেবারে? জনগণ কি তাদের ভোটের অধিকার ফিরে পেয়েছে? ব্যবসায়ীরা কি নিরাপদে আছেন? বিনিয়োগ করতে পারছেন শঙ্কাহীনভাবে?

সাধারণ মানুষ মনে করে, এসব প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে ‘না’। তার মানে ৯ মাস পরও বিপ্লবের সুফল নিশ্চিত হয়নি। উল্টো ঐক্য কমেছে, বেড়েছে বিভক্তি। অংশীজনের বিভক্তি এমন পর্যায়ে গেছে, যা রাজনীতির স্বাভাবিক সীমা অতিক্রম করছে অনেক সময়। কারণ হচ্ছে, বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর গণ-অভ্যুত্থানের অংশীজনরা জনতার চেয়ে ক্ষমতাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। আন্দোলনের একক ক্রেডিট নেওয়ার প্রবণতা বিভক্তিকে আরো উসকে দিয়েছে। রাজনীতিতে পা রাখার কয়েক দিনের মাথায় সাধারণ জীবন ছেড়ে বিলাসী ও দাম্ভিক হয়ে উঠছেন অনেকে। এ ছাড়া দেশের যা-ই হোক, সবাই কেবল ক্ষমতায় যেতে চান, নয়তো ক্ষমতায় থাকতে চান; যেসব কারণে অনিবার্য হয়ে ওঠে রাজনৈতিক ক্যারিকেচার।

পরিস্থিতি উত্তরণে অন্তর্বর্তী সরকারকে অগ্রাধিকার তালিকা ঠিক করতে হবে। কেবল সুন্দরের স্বপ্ন দেখালে হবে না, স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। সরকারের নেওয়া ইতিবাচক পদক্ষেপগুলোকে সামনে আনতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে করণীয় ঠিক করে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় রাজনৈতিক বিভেদ হয় কালবৈশাখি, নয়তো ঘূর্ণিঝড় হয়ে আসবে সারা দেশে, লন্ডভন্ড করবে নতুন বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন।

১০ জন মিলে কোরাস গাইলে অবশ্যই হারমোনিয়ামসহ অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের স্কেলের সঙ্গে সুর মেলাতে হবে। খালি গলায় গাইলেও অন্তত সুরে-তালে ঐক্য থাকতে হবে। না হলে তাল-লয় কাটা পড়বে, সৃষ্টি হবে হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি। এখন তা-ই হয়েছে। কয়েক মাস না যেতেই ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিগুলোতে চরম বিরোধ দেখা দিয়েছে। দল গঠনের কয়েক মাসের মাথায় নিজেদের জৌলুস হারাচ্ছে এনসিপি। দলটির সঙ্গে এক ইস্যুতে বিএনপির বিরোধ, তো অন্য ইস্যুতে আবার জামায়াতের। দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপি-জামায়াতের মধ্যেও সখ্যর বদলে বৈরিতা বাড়ছে। কেবল রাজনৈতিক দলের মধ্যে নয়, সরকারের সঙ্গেও দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। বলছি না, সব দলের নীতি-আদর্শ এক হবে। কিন্তু মৌলিক ইস্যুতে তো ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, যেন জনগণের বৃহত্তর কল্যাণ নিশ্চিত হয়, রোধ হয় ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান।

বিশ্বাস-অবিশ্বাস আর চরম বিভক্তির রাজনীতিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া হয়ে উঠতে পারেন জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হতে পারে সংকটময় সময়ের সামগ্রিক ঐক্য প্রক্রিয়া। কারণ বহু বছর থেকেই সরাসরি দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নেই তিনি। মিথ্যা মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধের বদলে ভালোবাসার কথা বলেছেন, দিয়েছেন জাতীয় ঐক্যের ডাক। এর বাইরে দ্বিধাহীনভাবেই বলা যায় বাংলাদেশের সংগ্রামী নেত্রীর নাম খালেদা জিয়া। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, পেয়েছেন আপসহীন উপাধি। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে বলিষ্ঠ ভূমিকা আছে খালেদা জিয়ার।  

তাই টালমাটাল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোন উপায়ে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়াকে সম্পৃক্ত করা যায়, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতে পারে। সাধারণ মানুষ মনে করে, তুমুল জনপ্রিয়তার পাশাপাশি যেমন সাংগঠনিক দক্ষতা আছে খালেদা জিয়ার, তেমনি আছে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা আর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। এ ছাড়া জেল-জুলুম আর নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করতে করতে দলীয় বলয়ের সীমা অতিক্রম করে অনেক আগেই সংগ্রামী-মহীয়সী নামের প্রতীক হয়ে উঠছেন খালেদা জিয়া। ফলে বিভক্তির রাজনীতিতে ঐক্য ফেরাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া হয়ে উঠতে পারেন জাদুর কাঠি।

লেখক : হেড অব নিউজ, নিউজ২৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।