বিগত শতকের আশির দশকে একটা চুটকি খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সেটা এরকম: পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক যে নাপিতের কাছে চুল কাটাতেন সে বেশ চালাক-চতুর একটা মানুষ।
রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। প্রতি পাঁচ বছর পর পর জনগণ তার সেই মালিকানা প্রয়োগ করতে পারে ভোট প্রদানের মধ্য দিয়ে। সেই ভোট প্রদান যাতে উৎসবমুখর এবং অংশগ্রহণমূলক হয় সেটাই তাদের একমাত্র চাওয়া। কিন্তু দেশের জনগণ গত ১৫ বছর ধরে সেই ভোটের অধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত রয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার বিশেষ করে দলটির প্রধান শেখ হাসিনা সেই ভোটের অধিকার থেকে জনগণকে বঞ্চিত রাখার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করেছেন। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় বসে শেখ হাসিনা প্রথমেই টার্গেট করলেন জনপ্রিয় নির্বাচনী ব্যবস্থা ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ধ্বংস করার জন্য। আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে চালু করলেন বিনা ভোটের নির্বাচন। বিএনপি জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনকালীন একটি সরকার ব্যবস্থা চালু করার জন্য শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন করলো। এরই একটি পর্যায়ে এসে প্রথম শ্রেণীর চাকরিতে কোটা প্রথা বাতিলের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে গত বছরের জুন মাসে। দুয়ে দুয়ে চার, অংকে মিলে যায়। প্রবল আন্দোলনের মুখে বিদায় নেয় ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা। ক্ষমতা গ্রহণ করে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুস। সব রাজনৈতিক দল তাকে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছে যাতে তিনি একটি সুন্দর নির্বাচন উপহার দিয়ে দেশবাসীকে কৃতার্থ করেন।
ক্ষমতায় বসেই তিনি বেশ কিছু সংস্কারের কথা বলে কমিটি করলেন। সব রাজনৈতিক দলের সমর্থন সেখানেও ছিল। সব কমিশন তাদের রিপোর্ট ও জমা দিয়েছেন। এখন বাকি রয়েছে শুধু নির্বাচন। এই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা নিয়ে শুরু হয়েছে জটিলতা। আর সেই জটিলতা থেকে শুরু হয়েছে বিশৃঙ্খলা এবং নৈরাজ্য। যখন তখন রাজপথ বন্ধ করে চলছে আন্দোলন সংগ্রাম। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সপ্তাহের সাত দিনই বিক্ষোভ হয়। সড়কে চলাচল বিঘ্নিত হয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে এমন কোনো ক্ষমতা নেই যা দিয়ে এই বিক্ষোভগুলোর অবসান ঘটানো সম্ভব। রাষ্ট্র একটা বিশাল ব্যাপার। সেটা পরিচালনা করা গুটিকয়েক উপদেষ্টার পক্ষে সম্ভব নয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাইরেও আরো এমন কিছু শক্তির প্রয়োজন হয় যা দিয়ে একটি রাষ্ট্র সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব। সেই শক্তিটা আছে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে। জুলাই বিপ্লবের পর ১১ মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে। কিন্তু সরকার স্থিতিশীল হতে পেরেছে এমনটা দাবি করা যুক্তিসঙ্গত হবে না। আর একটা স্থিতিশীল সরকার ছাড়া একটা স্থিতিশীল দেশ আশা করা যায় না। আর স্থিতিশীল দেশ ছাড়া উন্নয়ন অগ্রগতি সম্ভব নয়। বিনিয়োগকারীরা আস্থা পায় না। এই পরিস্থিতি যত দীর্ঘায়িত হবে দেশের জন্য ততই অমঙ্গল। এই অমঙ্গল এর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে জরুরি হয়ে পড়েছে একটি নির্বাচন। জনগণ ভোট দিয়ে যাদের নির্বাচিত করবে তারা ক্ষমতা গ্রহণ করলে যেসব উটকো ঝামেলায় এখন দেখা যাচ্ছে সেগুলো দূরীভূত হবে। ফেসবুক টুইটার কিংবা এক্স এর মাধ্যমে জনমত সৃষ্টি করে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলা যায় কিন্তু দেশ পরিচালনা করা যায় না। সেটা আরেকবার প্রমাণিত হলো। দেশ পরিচালনার জন্য দরকার অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক দল। রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ অভিমান থাকতে পারে কিন্তু দিনশেষে একটি রাষ্ট্র পরিচালনার ভার তাদের ওপরই ন্যস্ত হয়। বিশ্বের দেশে দেশে রাজনৈতিক নেতাদের হাত ধরেই সাফল্য এসেছে।
এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করায় অনেক রাজনৈতিক দল নাখোশ। তাদের বিরুদ্ধে নানামুখী অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। কিন্তু বিগত ১৫-১৬ বছর ধরে এই দলটি লাগাতার আন্দোলন করেছে একটি সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য। দলটির দাবি জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া একটি সরকার চলতে পারে না। আওয়ামী লীগ জনগণের মেন্ডেট ছাড়া দেশ পরিচালনা করার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। বিএনপি তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। সেই আন্দোলন নিয়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক তির্যক ভাষায় সমালোচনা করেছেন। কিন্তু বিএনপি কি সেই আন্দোলন থেকে পিছপা হয়েছে? তাদের আন্দোলনের মুখে সরকারের পতন হয়েছে এমনটা দাবি না করলেও তাদের আন্দোলন ছাড়া ছাত্রদের গণঅভ্যুত্থান সাফল্যের মুখ দেখতো কি? বিএনপি তাদের বিগত দিনগুলোর আন্দোলনে সর্বস্তরের জনগণকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার এতটাই বেপরোয়া এবং নির্যাতনকারী ভূমিকা পালন করেছে যে বিএনপির নেতা কর্মী ছাড়া সাধারণ জনগণ আন্দোলনে নামতে ভয় পেয়েছে। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে জনগণ রাস্তায় নেমেছে, সঙ্গে ছিল বিএনপির বিশাল কর্মী বাহিনী। সফল হয়েছে একটি গণঅভ্যুত্থান। এজন্য শিক্ষার্থীরা সাধারণ জনগণের সমর্থন পেয়েছে শ্রদ্ধা পেয়েছে। সেই শিক্ষার্থীরা এখন রাজনৈতিক দলও গঠন করেছে। তারা ক্ষমতায় যেতে চায়। এই চাওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় যেতে চায়। সেই হিসেবে ছাত্রদের এনসিপি, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীসহ অপরাপর সব রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় যেতে চায়। তাহলে সবাইকে নির্বাচনে আসতে হবে এটাই তো বিধান। জনগণের ভোট ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়ার বিকল্প রাস্তা কি আছে?
এক বছর দেখতে দেখতে চলে গেল। সরকার নির্বাচনের কোনো রোডম্যাপ ঘোষণা করতে পারলো না। এটা একটি অনিশ্চয়তা। একটি দেশ কি কখনো এমন অনিশ্চিত গন্তব্যে হাঁটতে পারে? তাদের তো পরিষ্কার করা উচিত, তারা কতদিন ক্ষমতায় থাকতে চায় কিংবা কবে নাগাদ ভোট দিতে পারবে। অন্তর্বর্তী সরকারের কথা এবং কাজে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। যার ওপর জনগণের আস্থা থাকবে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যায় সমন্বয়হীনতা। একেক উপদেষ্টা এক এক ধরনের কথা বলেন। স্বচ্ছতা থাকলে এই সমন্বয়হীনতা চোখে পড়তো না। ক্ষমতার কেন্দ্রে কে কিংবা ক্ষমতার কেন্দ্র কয়টি সেটাও বুঝে ওঠা মুশকিল। এমন জগাখিচুড়ি মার্কা সরকার আর বেশিদিন ক্ষমতায় থাকলে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. ইউনুস সর্বদলীয় যে বৈঠক ডেকেছেন, সেখানে নির্বাচনের ব্যাপারে একটা সুনির্দিষ্ট রোড ম্যাপ এলে দেশ একটি দুর্যোগ থেকে মুক্তি পাবে।
লেখক: সাংবাদিক