ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২৯ মে ২০২৫, ০১ জিলহজ ১৪৪৬

মুক্তমত

আগে ঘরের আবর্জনা পরিষ্কার করতে হবে সরকারকে

অদিতি করিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:৪২, মে ২৭, ২০২৫
আগে ঘরের আবর্জনা পরিষ্কার করতে হবে সরকারকে অদিতি করিম

শেখ সাদি বলেছেন, ‘একটি সাজানো বাগান ধ্বংসে একটি বানরই যথেষ্ট। ’ এক গ্লাস দুধ একটু চুনই নষ্ট করে দিতে পারে।

তেমনি দু-একজন ব্যক্তির অযোগ্যতা, ষড়যন্ত্র এবং উচ্চাভিলাষ একটি সরকারকে করতে পারে বিতর্কিত, বিপদগ্রস্ত। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষেত্রেও যেন এই কথাটি প্রযোজ্য। বিপুল জনসমর্থন নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করা এই সরকার এখন নানা চাপে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে কারও কোনো আপত্তি নেই। তিনি জাতির বিবেক। সবাই আশা করেন যে, বর্তমানে বাংলাদেশ যে রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য তিনি যোগ্য অভিভাবক। কিন্তু তার পাশে যারা রয়েছেন তাদের অনেকের ভূমিকাই বিতর্কিত, প্রশ্নবিদ্ধ।

শনিবার ও রোববার দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিয়ে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি-সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক হয়। এই বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের দূরত্ব স্পষ্ট হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে দেশ চালাচ্ছে, তাতে সন্তুষ্ট নয় রাজনৈতিক দলগুলো। প্রত্যেকটি দলই চায় সরকারের একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা। কিন্তু তা এখনো দৃশ্যমান নয়। সরকারের ভিতরের কিছু ব্যক্তির ভূমিকা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো প্রশ্ন তুলেছে। এসব ব্যক্তিরা কীভাবে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন জায়গায় বসেছেন এবং তারা আসলে কী করতে চাইছেন সেটি নিয়ে শুধু জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক শক্তিসমূহ নয়, জনমনে সন্দেহ ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। অনেকেই মনে করেন যে, এসব ব্যক্তির কারণেই ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকার সঠিক লক্ষ্যে এগোতে পারছে না। কেউ কেউ তাদের এখতিয়ার বহির্ভূত বিষয়ে আগ বাড়িয়ে কথা বলছেন। কেউ কেউ বিরাজনীতিকরণ উসকে দিচ্ছেন। অনেকেই দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার অভিপ্রায় নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলছেন। এর ফলেই তৈরি হচ্ছে অস্থিরতা। এদের কারণেই রাজনৈতিক বিভক্তি বাড়ছে। তাদের কারণে অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে।

মনে রাখতে হবে ঘরেই হয় সর্বনাশ। ঘরের ইঁদুরই বাঁশ কাটে। ঘরের বিশ্বাসঘাতকতায় হেরে যায় একটি ভালো উদ্যোগ। জুলাই বিপ্লবের পর গঠিত এই সরকারও হেরে যাবে, যদি ঘরের আবর্জনা পরিষ্কার না করতে পারে। এদের ব্যাপারে ড. ইউনূসকে কঠোর হতে হবে। তার চারপাশে যে সব লোক আছে তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

এক-এগোরোর সময় যারা কুশীলব ছিলেন, যারা প্রভাবশালী ছিলেন এবং ‘এক-এগারো’ নীলনকশা প্রণয়ন করেছিলেন তাদের কেউ কেউ এই সরকারে বিভিন্ন স্তরে এখন প্রচণ্ড ক্ষমতাবান। সুশীল সমাজের এই অংশ সবসময় বাংলাদেশকে নির্বাচন, গণতন্ত্র থেকে দূরে রাখতে চায়। একটি অনির্বাচিত সরকার তারা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। উপদেষ্টাম লী, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের সদস্য এবং প্রধান উপদেষ্টার বিভিন্ন বিশেষ সহকারীদের অনেকেই রয়েছেন, যারা এক-এগারোর সময়ে বিভিন্ন বিতর্কিত ভূমিকার কারণে প্রশ্নবিদ্ধ। গণতন্ত্রের প্রতি, জনগণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা নেই। এসব ব্যক্তিকে কীভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, কেন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে যে রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার সবই হয়েছে এসব ব্যক্তির অযোগ্যতা, দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের কারণেই বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। প্রধান উপদেষ্টাকে অন্ধকারে রেখে কিছু কিছু উপদেষ্টা বেশ কিছু বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদ নিয়ে জটিলতার কথাই ধরা যাক। নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর গেজেট হলো, কিন্তু তারপরও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় শপথের ব্যবস্থা করল না কেন? স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। হয় তারা এ সংক্রান্ত রায় প্রতিপালন করতেন অথবা রায়ের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে আপিল করতেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কিছু না করে তারা এ ব্যাপারে আইন বিভাগের মতামতের জন্য পাঠালেন কেন?

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের কথাই ধরা যাক না কেন। চার দিন ধরে আন্দোলন চলল। শিক্ষা উপদেষ্টা কী করলেন? সংকট নিরসনে তিনি কেন ঘটনাস্থলে গেলেন না? সেখানে তথ্য উপদেষ্টা কেন যাবেন? তথ্য উপদেষ্টা সেখানে গিয়ে অপদস্ত হলেন- এটা কি সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করল?

অর্থ উপদেষ্টা বিদেশ ঘুরে বেডাচ্ছেন ঋণ সংগ্রহের জন্য। ঋণ পাওয়ার জন্য তার দৌড?ঝাঁপ। কিন্তু তিনি দেশের অর্থনীতির মূল শক্তি বেসরকারি খাতকে নিয়ে কয়টা বৈঠক করেছেন? বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংসের নীলনকশার বাস্তবায়ন চলছে। দেশের সবচেয়ে বড় ১১টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্তের নামে হয়রানি করা হচ্ছে। অনেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। ভুয়া হত্যা মামলায় হয়রানি করা হচ্ছে ব্যবসায়ী এবং বিনিয়োগকারীদের। একদিকে বিদেশি বিনিয়োগের ঢোল পেটানো হচ্ছে, অন্যদিকে দেশি উদ্যোক্তাদেরকে গলা চিপে হত্যা করা হচ্ছে। এই দ্বৈতনীতি দেশের অর্থনীতিতে কোনো সুফল আনতে পারবে না।

জাঁকজমক করে যে বিনিয়োগ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো তার ফলাফল কী হলো জাতি জানতে চায়। অর্থাৎ অর্থনীতিকে ভুল পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আইএমএফের ঋণের জন্য ডলারের বাজার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। অথচ ডলারের প্রভাব কী হবে তা কি অর্থ উপদেষ্টা বা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কখনো চিন্তা করে দেখেছেন? বাংলাদেশের বেসরকারি বিনিয়োগকারী উদ্যোক্তাদের হাত-পা বেঁধে রাখা হয়েছে। এভাবে দেশ কখনই অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যেতে পারে না। অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। এজন্য সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা এবং ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা কি জবাবদিহি করেছেন?

রাজনৈতিক অঙ্গনেও বিভাজন সৃষ্টি করছে কয়েকজন ক্ষমতাবান দায়িত্বহীন আচরণ এবং কথাবার্তায়। সরকার অনেকগুলো সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এসব কমিশনের কেউ কেউ যেন উপদেষ্টাদের চেয়েও ক্ষমতাবান। জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করাই যেন তাদের প্রধান কাজ। যখন পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছেন, তখন ঐকমত্য কমিশনের একজন প্রভাবশালী সদস্য বললেন, নাগরিক সমাজের সঙ্গেও কথা বলতে হবে। নাগরিক সমাজ কারা? কিছু মুষ্টিমেয় সুশীল, যারা দেশে নির্বাচন চান না? এর মধ্যে নারী সংস্কার কমিশন কেন গঠন করা হলো? এটা দরকার কী ছিল? গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠন করার এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের ছিল না। এই দুটি কমিশনের রিপোর্ট যদি পর্যালোচনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে সম্পূর্ণভাবে এই রিপোর্টগুলো জনগণকে বিভক্ত করার চেষ্টা। এসব কমিশনগুলোর সঙ্গে যারা যুক্ত তারা এক-এগারোর কুশীলব। এরা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়।

দুজন উপদেষ্টার ব্যক্তিগত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। নয় মাস পরে কেন দুর্নীতির অভিযোগ আসবে? প্রথমেই কেন এই উপদেষ্টারা তার সহকারীদের দুর্নীতির খবর পাবেন না? এটি কি তাদের অযোগ্যতা নয়? জনপ্রশাসনে আমরা দেখছি বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি নেই। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করার জন্য স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কী ধরনের উদ্যোগ সে সম্পর্কেও কোনোরকম তথ্য নেই কারও।

উপদেষ্টাদের সঙ্গে বিশেষ সহকারীদের দ্বন্দ্ব দেশে একটি দ্বৈতশাসন তৈরি করেছে। কারা সরকার চালাচ্ছে, সেই প্রশ্ন উঠেছে। রাখাইনে মানবিক করিডর বা চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে সরকার এত আগ বাড়িয়ে তৎপর হবে কেন? একজন উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলের একজন নেতা সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করবেন কেন? বিষয়গুলো পরিষ্কার হওয়া উচিত। বেশ কজন উপদেষ্টা আছেন, যাদের কোনো কাজ নেই, তবুও তাদের পদে রাখা হয়েছে। পরিকল্পনা উপদেষ্টা আগে শিক্ষা উপদেষ্টা ছিলেন। বছর গড়িয়ে যাচ্ছে এখনো পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে যায়নি। তার ব্যর্থতার দায় কেন সরকার নেবে? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কে চালাচ্ছে তা যেন এক রহস্য। পররাষ্ট্র মন্ত্রণায়ে একজন বিশেষ সহকারী নেওয়া হলো। তিনি এখনো যোগ দেননি কেন? জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চালান? এমন নানা প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত অন্তর্বর্তী সরকার।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস শান্তিতে নোবেল জয়ী একজন বিশ্ব বরণ্যে ব্যক্তিত্ব। তিনি নিশ্চয়ই জানেন একটি সরকার পরিচালনায় জবাবদিহি এবং স্বচ্ছতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ সরকারের প্রায় ১০ মাসে কারও কারও জবাবদিহি এবং স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এদের ব্যর্থতার দায় প্রধান উপদেষ্টা বা সরকার কেন নেবে?

এ সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে সব রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে। সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করা সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য একজন বিশেষ উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সেই বিশেষ উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছেন না। শুক্রবার বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘তারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়ে তারা পাঁচ দিনও সাক্ষাৎ পাননি। অবশেষে শনিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতে এত দেরি হবে কেন? আমরা আশা করি, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের পর সরকার তার কর্মপন্থা চূড়ান্ত করবে। নির্বাচন, সংস্কার ও বিচার- এই তিন কাজেই সীমাবদ্ধ থাকবে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম। অযাচিত বিতর্ক সৃষ্টি করবে না সরকারের ভিতরে থাকা বিশেষ গোষ্ঠী।

সংস্কার, গণহত্যার বিচার এবং নির্বাচন তিনটি রাজনৈতিক দলগুলোকে একসঙ্গে নিয়ে করতে হবে। আগামী ৯০ দিনের মধ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা উচিত এবং সেটা সহজেই সম্ভব। বিচার ও সংস্কার চলবে স্বাভাবিক গতিতে। এই সরকার সফল কি ব্যর্থ তার শেষ মাপকাঠি হলো নির্বাচন কতটা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক হয়েছে। যদি সরকার সেটি করতে পারে তাহলে এই সরকারকে ইতিহাসে সবাই সম্মান করবে। কিন্তু সেটি যদি করতে ব্যর্থ হয় তাহলে এ সরকারের প্রতিটি দোষের হিসাব জাতি কড়ায় গন্ডায় বুঝে নেবে। সেজন্য আগে ঘরের আবর্জনা সাফ করতে হবে। এখনই সেটা করা দরকার।

অদিতি করিম: নাট্যকার ও কলাম লেখক

ইমেইল: [email protected]

সূত্র: কালের কণ্ঠ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।