ইসলাম একক ব্যক্তিকেন্দ্রিক কোনো ধর্ম নয়। ইসলাম হলো এক মহা ঐক্যের বার্তা-যেখানে মানুষের হৃদয়, সমাজ ও জাতিকে এক দিগন্তে মিলিত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
আবদুল্লাহ ইবনুনে মাসউদ (রা.) এক ব্যক্তিকে পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত ভিন্নভাবে তিলাওয়াত করতে শুনলেন।
অথচ তিনি নিজে নবী (সা.)-কে তা অন্যভাবে পাঠ করতে শুনেছিলেন। বিভ্রান্ত হয়ে তিনি লোকটিকে হাত ধরে নবীজির কাছে নিয়ে এলেন। নবী (সা.) উভয়ের পাঠ শুনে বললেন, ‘তোমরা দুজনেই ঠিক পড়েছ। ’ তারপর সতর্ক করলেন, ‘তর্কে জড়িও না; কেননা তোমাদের পূর্ববর্তীরা তর্কবিতর্কে লিপ্ত হয়ে ধ্বংস হয়েছিল। ’
(বুখারি, হাদিস : ২৪১০)
এই ঘটনা ইসলামের এক অনন্য শিক্ষার দরজা খুলে দেয়। সেটি হচ্ছে ‘ভিন্নতা সব সময় বিভেদ নয়, বরং অহংকার ও তর্কপ্রবণতাই বিভেদের সূচনা। ’ ইসলাম মানুষকে শেখায়, দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু হৃদয় যেন এক থাকে; পথ আলাদা হতে পারে, কিন্তু লক্ষ্য যেন এক হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি। ঐক্যের মূল শিকড় ইসলামের ঐক্য কোনো রাজনৈতিক চুক্তি নয়, এটি ঈমানের শিকড়ে প্রোথিত।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রশি দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো এবং বিভক্ত হয়ো না। ’
(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৩)
যদি আমরা আল্লাহর রশি কোরআন ও সুন্নাহকে একসঙ্গে ধারণ করি, তাহলে বর্ণ, ভাষা বা জাতিগত কোনো পার্থক্যই আমাদের আলাদা করতে পারে না। কিন্তু যখন আমরা কোরআন-সুন্নাহর পরিবর্তে দলীয় স্বার্থ, গোষ্ঠী, কিংবা নেতার অনুসরণে মত্ত হই, তখনই ঐক্য ভেঙে যায়, ভাই হয়ে ওঠে ভাইয়ের শত্রু।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মুমিনগণ এক দেহের মতো। দেহের একটি অঙ্গ কষ্ট পেলে, পুরো দেহ জ্বরে আক্রান্ত হয়।
’ (মুসলিম, হাদিস : ২৫৮৬)
এই হাদিস শুধু আবেগ নয়, এটি একটি বাস্তব সামাজিক নীতি। মুসলমানরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, তাদের হৃদয়, দুঃখ, আনন্দ ও আশার কেন্দ্র একীভূত হওয়া উচিত ঈমান ও ইসলামে।
মতভেদ ও বিভেদ: সূক্ষ্ম পার্থক্য
ইসলাম মতভেদকে অস্বীকার করে না, বরং তা স্বাভাবিক মানবিক প্রবণতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু ইসলাম ঘৃণা ও দলবাজির নামে বিভেদকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করে। ইমাম শাফেঈ (রহ.) বলেছেন, ‘আমার অভিমত সঠিক হলেও তাতে ভুলের সম্ভাবনা আছে, আর অন্যের মত ভুল হলেও তাতে সঠিকতার সম্ভাবনা আছে। ’ [শাওকানী (রহ.) রচিত ইরশাদুল ফুহুল, পৃষ্ঠা-২৫৩]
এমন উদারতা ও বিনয়ই ইসলামী চিন্তার সৌন্দর্য। কিন্তু যখন কেউ নিজের মতকেই একমাত্র সত্য মনে করে, অন্যদের প্রতি তাচ্ছিল্য দেখায়, তখন সৃষ্টি হয় বিভাজন, যা উম্মাহর শক্তিকে ধ্বংস করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা বিভক্ত হয়ে পড়েছিল এবং মতভেদে জড়িয়ে পড়েছিল। ’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৫)
ঐক্য: মুসলিম শক্তির প্রাণ
ইসলামী ইতিহাসের যে যুগগুলোতে মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ ছিল, তখনই তারা পৃথিবীর ন্যায়বিচার ও জ্ঞানের আলোকবর্তিকা ছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে মক্কা-মদিনার সহোদর মুসলমানরা এক পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে একে অপরের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন।
বিপরীতে বিভেদের ইতিহাস ভয়াবহ। আন্দালুসের পতন, বাগদাদের ধ্বংস, ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের পতন-সব কিছুর পেছনে ছিল অভ্যন্তরীণ কলহ ও দলাদলি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়-বাহ্যিক শত্রু মুসলমানকে পরাজিত করতে পারেনি; মুসলমান নিজেরাই বিভেদের বিষে আক্রান্ত হয়েছিল।
আজকের বাস্তবতা
আজ আমরা নামাজে এক কাতারে দাঁড়াই, কিন্তু হৃদয়ে কাতার ভেঙে যায়। আমরা একই কোরআন পড়ি, একই নবীকে মানি, তবু গোষ্ঠী, মাজহাব, রাজনীতি আর ভাষার নামে একে অপরকে অবজ্ঞা করি। কেউ নিজেকে ‘শুদ্ধতম’ মনে করে, অন্যকে ‘বিদআতি’ বা ‘অশুদ্ধ’ বলে ফতোয়া দিই। অথচ কোরআন আমাদের পরিচয় দিয়েছে একটাই-‘নিশ্চয়ই তোমাদের এই উম্মাহ এক উম্মাহ। ’
(সুরা : আল-আম্বিয়া, আয়াত : ৯২)
এই ঐক্যভিত্তিক পরিচয় পুনরুদ্ধার করাই আজকের সময়ের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। মুসলমানরা একে অপরের শত্রু নয়, বরং একই দেহের অঙ্গ। ইবনে মাসউদ (রা.)-এর হাদিস আমাদের গভীর শিক্ষা দেয় যে ভিন্নতা নয়, তর্ক ও অহংকারই ধ্বংসের মূল। মত থাকতে পারে, কিন্তু মন যেন না ভাঙে। বিতর্ক নয়, সংলাপ হোক; বিভাজন নয়, ভ্রাতৃত্ব হোক। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘মুসলমান মুসলমানের ভাই; সে তার ওপর জুলুম করে না, তাকে অবজ্ঞা করে না, তাকে পরিত্যাগও করে না। ’
(মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৪)
ঐক্য শুধু সমাজের প্রয়োজন নয়, এটি ঈমানেরও দাবি। ঐক্যই উম্মাহকে জাগিয়ে তুলবে, নতুন শক্তি দেবে, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ খুলে দেবে।
এসআই