পরিবার হলো সমাজের প্রাথমিক একক। একটি পরিবারে যদি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে সন্তানরা নৈতিক, শিক্ষিত ও দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে বড় হয়।
এটি নির্দেশ করে যে প্রত্যেক সন্তানের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। হাদিসে এসেছে : ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের মধ্যে দান-অনুদানে সমতা বজায় রাখো। ’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
সন্তানদের মধ্যে বৈষম্য, তাদের প্রতি অবহেলা বা প্রতারণা ইসলামিক দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধ। যখন বাবা জীবিত অবস্থায় এক সংসারের সন্তানদের বঞ্চিত করেন এবং অন্য সংসারের পক্ষ নেন, তখন তা শুধু পারিবারিক ক্ষতি নয়, বরং আল্লাহর নৈতিক আদেশ লঙ্ঘন করা হয়।
পরিবারে সম্পত্তি বণ্টন শুধু অর্থের হিসাব নয়, এটি সন্তানদের মানসিক নিরাপত্তা ও বিশ্বাসের প্রশ্ন। সন্তান যখন নিজের প্রাপ্য পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তখন সে ন্যায়বিচারের অভাব থেকে অনিশ্চয়তা, হতাশা ও অবিশ্বাসে বড় হয়। এটি সমাজে হিংসা, প্রতিশোধবোধ ও অনৈতিক মানসিকতার জন্ম দেয়। ইসলাম মনে করিয়ে দেয় যে অন্যায় বিলম্বও অন্যায়ের সমান।
হাদিসে এসেছে : ‘যে ব্যক্তি তার সন্তানদের প্রতি অবহেলা করে, সে আল্লাহর দয়া থেকে বঞ্চিত হয়। ’
সন্তানদের প্রতি অবিচার শুধু ব্যক্তি নয়, পুরো সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বৈষম্য ও প্রতারণার ফলে পরিবারে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, বিশ্বাসের অভাব এবং শিশুদের মানসিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটে। ছোটবেলা থেকেই যে শিশু অবহেলা, বৈষম্য বা নিপীড়নের শিকার হয়, সে বড় হয়ে সমাজে অন্যায়ের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে অথবা ভয় ও অবিশ্বাসে পূর্ণ মানুষ হিসেবে বিকশিত হয়। বাংলাদেশে সন্তানের অধিকার ও পারিবারিক ন্যায়বিচারের জন্য আইন স্পষ্টভাবে নিয়মিত।
Penal Code, ১৮৬০ অনুযায়ী সন্তানের প্রতি শারীরিক বা মানসিক শোষণ, প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাৎ গুরুতর অপরাধ। ধারা ৩২৫ অনুযায়ী, শারীরিক ক্ষতি বা নিষ্ঠুর আচরণে সাত বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা। ধারা ৩৭২ ও ৩৭৪ অনুযায়ী মানসিক বা আর্থিক শোষণে ১০ বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা। ধারা ৩৬৪(এ) অনুযায়ী প্রতারণা বা সম্পত্তি আত্মসাতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড। এ ছাড়া ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩ অনুযায়ী সন্তানের জীবন, শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য পিতা-মাতা বাধ্য।
তাই সন্তানদের অধিকার রক্ষা এবং পারিবারিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব। সমাজ ও স্থানীয় কমিউনিটি কর্তৃক পারিবারিক সালিস, নৈতিক শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সন্তানদের অধিকার নিশ্চিত করা যায়। মসজিদ, মাদরাসা ও স্কুলে পারিবারিক ন্যায়বিচার এবং ইসলামী দায়িত্ববোধের শিক্ষার মাধ্যমে সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
সন্তানদের অধিকার রক্ষা, বৈষম্য প্রতিরোধ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা শুধু ধর্মীয় নৈতিকতার বিষয় নয়, এটি সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুতর দায়িত্ব। বাবা জীবিত অবস্থায় ন্যায়বিচার না করলে, তা শিশুর মানসিক নিরাপত্তা, শিক্ষাগত উন্নয়ন ও নৈতিক বিকাশকে হুমকির মুখে ফেলে। সমাজ ও রাষ্ট্র উভয়কে সক্রিয়ভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং শিশু অধিকার রক্ষায় ভূমিকা নিতে হবে।
সুতরাং পরিবারে ন্যায়বিচার ও সন্তানের অধিকার নিশ্চিত করা ইসলামের নৈতিক নির্দেশনা, সামাজিক শান্তি ও রাষ্ট্রের আইনি দায়িত্বের সংমিশ্রণ। প্রত্যেক বাবা-মায়ের নৈতিক দায়িত্ব হলো সন্তানদের প্রতি সমান আচরণ এবং তাদের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করা। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো আইনগতভাবে ও সামাজিকভাবে নিশ্চিত করা যে কোনো সন্তান বৈষম্য, প্রতারণা বা অবহেলায় ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
পরিবারে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা শুধু একটি পারিবারিক মূল্যবোধ নয়, এটি সমাজের নৈতিক ভিত্তি, শিশুদের নিরাপদ ভবিষ্যৎ এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের প্রতিফলন। যদি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র একত্রে এগিয়ে আসে, তবে আমরা নিশ্চিত করতে পারি যে আমাদের সন্তানরা ন্যায়বিচার, বিশ্বাস ও মানবিকতার আলোতে বড় হবে।
লেখক: প্রভাষক, ব্রেভ জুবিলেন্ট স্কলার্স অব মনোহরদী মডেল কলেজ (বিজেএসএম মডেল কলেজ) মনোহরদী, নরসিংদী
এসআই