ঢাকা, বুধবার, ১৫ আশ্বিন ১৪৩২, ০১ অক্টোবর ২০২৫, ০৮ রবিউস সানি ১৪৪৭

ফিচার

পর্ব ৩২

এই গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০:১৩, মে ১৮, ২০১৭
এই গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর মুর্শিদাবাদের পথে পথে

কবি নজরুল ইসলাম তার ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার!’ কবিতায় লিখেছেন, “ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর!/ উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার”।

১৯২৬ সালে কবি এ কবিতাটি যখন লেখেন তখন ভারত পরাধীনতার ১৭০ বছর উদযাপন করছে! নজরুল এ কবিতাটি রচনা করার দুই দশক পরে ভারত তার হৃত স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে।  

কিন্তু কোন গঙ্গার কথা কবি বলে গেছেন? একি শুধুই রূপকার্থে একটি নদী নাকি ভারতের স্বাধীনতা হারানোর সঙ্গে এই গঙ্গার রয়েছে কোনো সম্পর্ক? ফিরে যেতে হয় ইতিহাসে।

এমনকি কবির কবিতায়ও রয়েছে সেই উত্তর।

ভাগীরথী নদী

গঙ্গার প্রধান দু’টি প্রবাহের একটি হচ্ছে ভাগীরথী। এটিকে গঙ্গার উৎস হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। ভাগীরথী একটি পৌরাণিক নাম। পুরাণ অনুযায়ী, রাজা ভগীরথ মর্ত্যলোকে গঙ্গা নদীর পথপ্রদর্শক ছিলেন। তাই গঙ্গার অপর নামই ভাগীরথী। তাই, যা গঙ্গা তাই ভাগীরথী।  

মানচিত্রে নদী একটিই। যদিও স্থানভেদে এর নাম দেওয়া হয়েছে কোথাও গঙ্গা, কোথাওবা ভাগীরথী। ব্রিটিশ বাবুরা ভারতের স্বাধীনতা হরণ করে ভাগীরথীর অংশ বিশেষের নাম দিয়েছেন হুগলি। কলকাতার দিকে এই ভাগীরথী তাই হুগলি নামে পরিচিত। কলকাতা হুগলি নদীর তীরেই অবস্থিত।  

ভাগীরথী নদী

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলার ইতিহাসের এক পরাজয় ও গ্লানিময় দিন। এই দিনই পলাশির যুদ্ধে বাংলা হারিয়েছে তার স্বাধীনতা। গঙ্গা-ভাগীরথীর উত্তর-পশ্চিম তীরেই এই পলাশির প্রান্তর। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজধানী তখন মুর্শিদাবাদ। মুর্শিদাবাদ থেকে পলাশির দুরত্ব ৫০ কিমি। মুর্শিদাবাদ ও পলাশি দু’টোই ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত। ভাগীরথীর তীরে পলাশির প্রান্তরে যুদ্ধের নামে যে বিশ্বাসঘাতকতার নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল তারই পরিণতিতে বাংলার স্বাধীনতা-সূর্য ১৯০ বছরের জন্য অস্তমিত হয়। তাই নজরুলের উচ্চারণ, “ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর!”। সেই সূর্য আবার উদিত হয়েছে আমাদেরি রক্তের বিনিময়ে দুশো বছর পরে। নজরুল তাই বলেন, “উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার”।

কোন প্রেক্ষাপটে এ পরাধীনতা ও পরাজয় নজরুল তাও স্পষ্ট করেই বলেছেন, “কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,/বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!” ভাগীরথীর তীরেই সেদিন বাঙালির রক্তে ক্লাইভের তরোবারি রঞ্জিত হয়েছিল।  

ভাগীরথী নদী

প্রাসঙ্গিকভাবে বলে রাখা, নজরুল এই কবিতাটি ১৯২৬ সালের ২২ মে কৃষ্ণনগরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির বার্ষিক সম্মেলনে আবৃত্তি করেছিলেন। কৃষ্ণনগর থেকে পলাশির দূরত্বও প্রায় ৫০ কিমি। কলকাতা থেকে যেতে প্রথমে কৃষ্ণনগর, তারপর পলাশি ও পরে মুর্শিদাবাদ।  

কৃষ্ণগরের কথা এ কারণেই বলা যে, পলাশির যুদ্ধের সময় কৃষ্ণনগরের রাজা ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। পলাশির যুদ্ধে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ইংরেজদের সহায়তা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, পলাশির যুদ্ধে যাওয়ার সময় লর্ড ক্লাইভ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাসাদে রাত যাপন করেছিলেন।  কৃষ্ণচন্দ্র ক্লাইভের পক্ষ নিয়ে সিরাজের পরাজয় ত্বরান্বিত করেন। নবাব মীর কাসেমের সময় ইংরেজরা তাকে এর জন্য পুরস্কৃতও করে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তার ভুল বুঝতে পেরেছিলেন কিনা জানা যায় না, তবে ভারতবর্ষের অপরাপর রাজা-মহারাজার মতোই তাকে ও তার বংশধরদের ব্রিটিশদের অধীনতা ও পরাধীনতা মেনে নিতে হয়েছিল।  

ভাগীরথী নদী

মুর্শিদাবাদ অথবা পলাশির প্রান্তর আমাদের ইতিহাসের সেই স্মৃতিকেই জাগিয়ে দেয় বারবার। এর পাশ দিয়ে বয়ে চলা গঙ্গা-ভাগীরথী আমাদের সেই নদী যার ওপারে অস্ত গিয়েছিল আমাদের প্রিয় মাতৃভুমির স্বাধীনতার সূর্য। ১৯০ বছরের পরাধীন সূর্য আজ স্বাধীন। ভাগীরথী যেনো বয়ে চলা এক সময় নদী যা আমাদের নিয়ে যায় রক্তাক্ত পলাশিতে।  

ভাগীরথীর মতো এতো শান্ত অথচ দৃঢ় জলপ্রবাহ চোখে পড়ে না। এর দুই তীরে রয়েছে বিস্তৃত সবুজের সমারোহ, উপরে প্রসন্ন আকাশ ও স্বচ্ছ নীল জলস্রোত-যেনো পটে আঁকা এক ছবি।  

ভাগীরথী নদী

ভাগীরথী পাড় হয়েই যেতে হয় সিরাজের কাছে, খোসবাগে। যে সিরাজ আজও মরেনি। এই সেই নদী, পলাশির পরাজয়ের পর সিরাজ এই নদী দিয়েই পাটনা যাওয়ার পথে ভগবানগোলায় শত্রুদের হাতে বন্দি হয়েছিলেন। এরপরের ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। জানে এই নদীও। সবই জানা আছে তার, শুধু কথা বলে না। তবু তার স্রোতে কান পেতে শুনি— মরেনি সিরাজ, স্বাধীনতা অমলিন।

বাংলাদেশ সময়: ১৬১০ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০১৭
এসএনএস 

আগের পর্ব পড়ুন
** ১ম পর্ব: এক যে ছিলো মুর্শিদাবাদ
** ২য় পর্ব: কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ
** ৩য় পর্ব: মানুষ যে হায় ভুলে গেছে চির মধুর ভালোবাসা
** ৪র্থ পর্ব: চার ভাইয়ের বাগান বিলাস ও একটি গুপ্তপথ
** ৫ম পর্ব: জগৎশেঠকে সপরিবারে হত্যা করা হয় যে প্রাসাদে
** ৬ষ্ঠ পর্ব: নুরলদীনের ‘জাগো বাহে’ শোনা যায় নসীপুর প্রাসাদে
** ৭ম পর্ব: কিরীটেশ্বরী মন্দির ও জগদ্বন্ধু সুন্দরের আশ্রম
** ৮ম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর কলিজাখেকো মেয়ের সমাধি!
** ৯ম পর্ব: হেস্টিংসের স্ত্রী, মেয়ের সমাধি ও একটি আর্মেনিয়ান চার্চ
** ১০ম পর্ব: মুজিবনগর ও পলাশী: বাংলার ইতিহাসের দুই আম্রকানন 

** ১১তম পর্ব: ৩শ বছরের ডাচ সিমেট্রি ও যোগেন্দ্র নারায়ণের মন্দির
** ১২তম পর্ব: সতীদাহ ঘাটের পাতালেশ্বর মন্দির

** ১৩তম পর্ব : আশি টাকার গাড়ি ও সোনার রথ
** ১৪তম পর্ব : ষড়যন্ত্রের গ্রিনরুম ছিল কাসিম বাজার

** ১৫তম পর্ব: কাসিম বাজার ছোট রাজবাড়ির বড় আয়োজন
** ১৬তম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর জগৎজয়ী কামান
** ১৭তম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর সমাধি
** ১৮তম পর্ব: ফুটি মসজিদ: নির্মাণের অপেক্ষায় ৩শ বছর
** ১৯তম পর্ব: রোশনিবাগে শুয়ে আছেন নবাব সুজাউদ্দিন
** ২০তম পর্ব: মুর্শিদাবাদের শেষ নবাবের প্রাসাদ
** ২১তম পর্ব: বৈচিত্র্যময় মুর্শিদাবাদের খাবার
** ২২তম পর্ব: গ্রামের পথে খোসবাগ থেকে রোশনিবাগ
** ২৩তম পর্ব: রেশম যুগের মুর্শিদাবাদ
** ২৪তম পর্ব: বাচ্চাওয়ালি কামান ও ইমামবাড়া
** ২৫তম পর্ব: হাজার দুয়ারি প্রাসাদে শেকলবন্দি নবাব
** ২৬তম পর্ব: রহস্যে ঘেরা ঘসেটি বেগমের ধনভাণ্ডার
** ২৭তম পর্ব: ষড়যন্ত্রের আখড়া ঘসেটির প্রাসাদ

** ২৮তম পর্ব: মতিঝিল: ষড়যন্ত্রস্থলে আজ প্রকৃতি তীর্থ
** ২৯তম পর্ব: জগৎশেঠের বাড়ি ও তার পরিণতি
** ৩০তম পর্ব: মীর জাফর ও পরাধীন নবাবদের সমাধিক্ষেত্র
** ৩১তম পর্ব: নিমক হারাম দেউড়ি ও মীর জাফরের বাড়ি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।