ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

৩য় পর্ব

মানুষ যে হায় ভুলে গেছে চির মধুর ভালোবাসা (ভিডিও)

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪০৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ৯, ২০১৭
মানুষ যে হায় ভুলে গেছে চির মধুর ভালোবাসা (ভিডিও) মুর্শিদাবাদের পথে পথে

মুর্শিদাবাদ ঘুরে: বহরমপুর থেকে লালবাগ ১১ কিলোমিটার। বহরপমপুর বাংলাদেশের আর দশটা জেলা শহরের মতোই। বাসস্ট্যান্ড বা শহরের প্রাণকেন্দ্রে যা লোকের আনাগোনা, একটু ভেতরে গেলেই শান্ত-নিরিবিলি একটি শহর। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা করে বহরমপুর থেকে লালবাগের দিকে এগিয়ে গেলাম।

মুর্শিদাবাদে খুব ভালোমানের আবাসিক হোটেল নেই। নিম্ন-মাঝারি গোছের হোটেল রয়েছে অনেক।

মুশির্দাবাদের মূল আকর্ষণ কেন্দ্র হাজারদুয়ারি প্রাসাদ। এর ঠিক পাশেই রয়েছে হোটেল মঞ্জুষা। আগেই বুকিং দেওয়া ছিলো। কিন্তু রুমের অবস্থা দেখে আর থাকতে মন চাইলো না। তাই কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে বুকিং ক্যানসেল করে অন্য হোটেলের খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম।  

হোটেল মঞ্জুষা ভাগীরথী নদীর একবারে তীর ঘেঁষেই। এখান থেকে সবসময় ভাগীরথী নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। তাই এখানে থাকতে না পেরে মনটা একটু খারাপই হলো। একটু পাশেই আরও দু’টি হোটেল। এর একটিতে উঠে গেলাম।  

রাতের খাবার সেরে পরের দিন ঘোরার জন্য একটি অটোরিকশার সন্ধান করলাম। অটোরিকশার চালক পরবর্তী দুই দিনের জন্য আঠারোশো টাকা চাইলেন। দেন-দরবার করায় এক হাজার টাকাতেই রাজি হয়ে গেলেন।  

পরদিন চালক অমিত কথামতো সকাল আটটায় হোটেলে এসে হাজির। গন্তব্য কাঠগোলা প্রাসাদ। হাজারদুয়ারি থেকে বড়জোড় তিন কিমি দূরে।

কাঠগোলা প্রাসাদে ঢুকতে ২০ টাকার টিকিট কিনতে হয়। এর বিনিময়ে এ প্রাসাদের চারপাশের বাগান ও অন্যান্য স্থাপনা দেখা যায়। কিন্তু মূল প্রাসাদে ঢুকতে মাথাপিছু আরও ১০ টাকা গুনতে হয়।  

এ প্রাসাদের মূল ফটকটি অনেক উঁচু। ফটকের উপরে ও নিচে আগে প্রহরীদের থাকা ও পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা ছিলো। এখন প্রহরী নেই, তবে ব্যবস্থাটি এখনও বহাল রয়েছে।  

বলা হয়, প্রবেশ মুখে মূল ফটকের দুই পাশেই নাকি একসময় কাঠের গোলা ছিলো। তাই এর নাম রাখা হয় কাঠগোলা প্রাসাদ।  

ফটো-২: প্রাসাদ-বাগানের দীর্ঘ পথ/ছবি: লেখক/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

টিকিট কেটে মূল ফটকের ভেতরে ঢুকেই দেখলাম দীর্ঘ একটি পথ চলে গেছে দৃষ্টির শেষ সীমায়। রাস্তার দুই পাশেই আমবাগান। আর আমবাগানের ভেতরে দুই পাশে দুইটি করে মোট চারটি ঘোড়সওয়ারি মানব-মূর্তি। এগুলো এই প্রাসাদের মালিক ও বংশধরদের। অনেকে বলেন, এ আম বাগানে নাকি ১২৬ প্রকার আম ধরে।  

ফটো-৩: কাঠগোলার আমবাগান /ছবি: লেখক/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বর্তমানে কাঠগোলা প্রাসাদ ও বাগান একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান। এর নাম দেওয়া হয়েছে শ্রী শ্রী আদিনাথজী দেব ঠাকুর সেবায়েত। শ্রী লছমীপৎ সিং দুগড় এই প্রাসাদ ও বাগান বাড়িটি তৈরি করেছেন। তারই পরবর্তী প্রজন্ম বর্তমানের জিয়াগঞ্জ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীপৎ সিং।

এখানে কোনো গাইড নেই। তাই প্রহরীদের কাছে জিজ্ঞেস করে যা জেনেছি তা হলো, এই পরিবারের পূর্ব পুরুষ ছিলেন জগৎশেঠদের মুনিম। আরও কথিত রয়েছে, এই প্রাসাদের পূর্বদিকে যে মসজিদ ও কবরস্থান রয়েছে সেখান থেকে এই পরিবার অনেক গুপ্তধন পেয়েছিল। তা দিয়েই এখানে বাগান তৈরি করা হয়। এই বাগানের হরেক রকম ফুল সারা মুর্শিদাবাদে বিখ্যাত ছিলো। তার নমুনা এখনো পাওয়া যায়।    

এই প্রাসাদের বর্তমান উত্তরাধিকার মাঝে মধ্যেই এখানে আসেন। যেহেতু এটি সেবায়েত প্রতিষ্ঠান তাই খোঁজ নিতে আসতে হয়। পর্যটকদের প্রবেশমূল্য বাবদ যা আয় হয় তা পুরোটাই এর ব্যবস্থাপনার কাজে ব্যয় হয়।  

কাঠগোলার মূল প্রাসাদ/ছবি: লেখক/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

আমবাগান পার হওয়ার পর আরেকটি গেট। গেটের ভেতরেই রয়েছে মূল প্রাসাদ ও ফুলের বাগান। আয়তকার এ বাগানবাড়ির মাঝখানে রয়েছে মূল প্রাসাদ। প্রাসাদের পশ্চিম দরজা দিয়ে বের হলেই বিরাট পুকুর। এ পুকুরে মোট ছয়টি ঘাট। তিনতলা এ প্রাসাদের সব ক’টি তলা থেকেই পুকুর দেখা যায়।

কাঠগোলার পুকুর/ছবি: লেখক/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

রাস্তা ধরে আরেকটু আগালেই দীর্ঘ বাগান। এর পরেই রয়েছে একটি জৈন মন্দির। তার পাশে আবার আরেকটি পুকুর। এখানে ছোট ছোট বোট রয়েছে। একটু এগিয়ে গেলে আরেকটি মন্দির চোখে পড়বে।  

মূল প্রাসাদের সঙ্গে লাগোয়া তিনটি বড় বড় ভবন। একটি ১১ কক্ষবিশিষ্ট একতলা ভবন। এটি ছিলো সে সময়ের রান্না ঘর। মাঝখানে রয়েছে হাম্মাম খানা বা গোসল খানা ও টয়লেট। এ দুইটি ভবন এখনও মোটামুটি অক্ষত রয়েছে। কিন্তু পাশে আরেকটি দুইতলা ভবন প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার উপক্রম। এটি ছিলো অতিথিশালা। বর্তমানে এটি একটি পরিত্যক্ত ভবন।  

বড় একটি বাগানের মধ্যখানে ছিলো নাচঘর। এটি বেশ উচু একটি মঞ্চ। এর উপর থেকে বাগান ও প্রাসাদটিকে ভালোভাবে দেখা যায়। এখানে জলসা হতো।    

এরপর মূল প্রাসাদে ঢুকলাম। একেকটি ৭৫ ফুট উচু বিনা সাপোর্টের কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়।

এর ভেতর রয়েছে মহামূল্যবান সব আসবাবপত্র ও তৈজসপত্র। সেই সঙ্গে দূর্লভ সব পেইন্টিং। এই পরিবারের বংশধরদের তৈলচিত্রও রয়েছে অনেক।  

কাঠগোলার মন্দির /ছবি: লেখক/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

এছাড়া রয়েছে কষ্টিপাথরের সিংহাসন, ১৮ ফুট উচু বেলজিয়াম আয়না, মার্বেল টেবিল যার মধ্যে তাজমহলের মতো কাজ করা হয়েছে, প্রাচীন কালের মার্বেল ও পার্সিলিনের স্ট্যাচু, ২২ ফুট উঁচু পক্ষ ও ঝিনুকের কাজ করা পিলার।  

নিচতলায় প্রাসাদের চারদিকে চারটি টেবিল ও চেয়ার বসানো রয়েছে। এগুলো মার্বেল টেবিল। প্রাসাদের অভ্যন্তরে ছবি তোলা নিষেধ।  

কাঠগোলার ধ্বংসপ্রায় অতিথিশালা /ছবি: লেখক/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

প্রাসাদের চারপাশে সিংহমূর্তি ও নারী মূর্তি রয়েছে। প্রতিটি তলাতেই রয়েছে প্রশস্ত বারান্দা, উন্মুক্ত ছাদ। এ ছাদ থেকে পুরো বাগানটি দেখা যায়। এই প্রাসাদের ছাদ থেকে হাজারদুয়ারি প্রাসাদও দেখা যায়। এর নির্মাণশৈলীতে ব্রিটিশ প্রভাবই বেশি।  

ভিডিও: কাঠগোলা প্রাসাদ ও বাগান

সৌন্দর্য ও আভিজাত্যের দিক দিয়ে হাজারদুয়ারির পরেই এর স্থান। কিন্তু সব সৌন্দর্যই একদিন ফুরিয়ে যায়। এই প্রাসাদ ও বাগানের সেই জৌলুস আজ অনেকটাই ম্লান। তবু আজও টিকে রয়েছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে, হয়তো কারও ভালোবাসার স্মৃতি ধারণ করে। প্রাসাদ ও বাগান দেখে বের হয়ে আসার সময় একটি বোর্ডের ওপর চোখ পড়লো, তাতে লেখা দেখলাম, ‘মানুষ যে হায় ভুলে গেছে চির মধুর ভালোবাসা’।  

বাংলাদেশ সময়: ১০০৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৯, ২০১৭
এসএনএস

**
আগের পর্ব পড়ুন-
** ১ম পর্ব: এক যে ছিলো মুর্শিদাবাদ
** ২য় পর্ব: কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।