নানা জটিলতা পেরিয়ে গত মাসের মাঝামাঝি থেকে ছাপা শুরু হয়েছে প্রাথমিকের পাঠ্যবই। এরই মধ্যে উপজেলা পর্যায়ে বই সরবরাহও শুরু হয়েছে।
গত ৮ অক্টোবর হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম জাকিরুল হাসান জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে ডিপিই ও এনসিটিবিতে একটি চিঠি পাঠান। সেখানে তিনি বলেন, গত ৭ অক্টোবর অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেস, স্টেশন রোড, চৌমুহনী, নোয়াখালী থেকে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির সাত হাজার ওয়ার্ক বুক (আমার বই) ও সাত হাজার এক্সারসাইজ বুক (খাতা) সরবরাহের জন্য উপজেলা শিক্ষা অফিস, মাধবপুর, হবিগঞ্জে আনা হয়, যার চালান নম্বর ১০১১১৯০৫, আইডি নম্বর ১১১১২৮৬ ও লট নম্বর ১১৯। সরবরাহ করা বইগুলো বুঝে নিতে গেলে নিম্নমানের বলে প্রতীয়মান হয়।
চিঠিতে আরো বলা হয়, সরবরাহের জন্য আনা প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির ‘এসো লিখতে শিখি’ খাতার প্রস্থ ১৭.৬ সেমি, যার টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন ১৮.৪১৫ সেমি (এর ২ শতাংশ কমবেশি হতে পারে) এবং সরবরাহ করা বই ও খাতার কাগজের মান নমুনা কপির চেয়ে নিম্নমানের।
বিষয়টি নিয়ে তাৎক্ষণিক জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, হবিগঞ্জের সঙ্গে আলাপ করি। তিনি এনসিটিবিতে এবং প্রেস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করার পর সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বইগুলো মাধবপুর উপজেলায় সম্পূর্ণ আনলোড না করে সব বই ফেরত নিয়ে যায়। মাধবপুর ও হবিগঞ্জ উপজেলায় ওই চালানের বা অন্য কোনো চালানের কোনো বই গ্রহণ করা হয়নি।
জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা নিম্নমানের বই সরবরাহের বিষয়ে অবগত হয়েছি।
এ বিষয়ে যথাযথ অ্যাড্রেস করা হয়েছে। আমাদের অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিম্নমানের কোনো বই যাতে শিক্ষার্থীদের হাতে না যায় সে জন্য যা যা করা প্রয়োজন তা আমরা করব। ’
এনসিটিবি সূত্র জানায়, আগামী শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিকে প্রায় ৯ কোটি ও মাধ্যমিকে প্রায় ২১ কোটি বই ছাপানো হবে। এ জন্য প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
এর মধ্যে মাধ্যমিকের বই ছাপাতে প্রায় এক হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা ও প্রাথমিকের জন্য প্রায় ৪২৩ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছে। যদিও পুনঃ দরপত্রের ফলে মাধ্যমিকের বইয়ে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা খরচ কম হচ্ছে। ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে ৪০ কোটি বই ছাপা হলেও ২০২৬ শিক্ষাবর্ষে ১০ কোটি বই কমেছে। এ বছর দশম শ্রেণির জন্য পাঁচ কোটি এবং অতিরিক্ত বিষয়ের জন্য আরো পাঁচ কোটি বই কম ছাপা হচ্ছে।
নতুন শিক্ষাবর্ষে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ছাপানো পাঠ্যবইয়ের মান নিশ্চিত করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে এনসিটিবি। এর মধ্যে প্রতি ফর্মায় প্রেসের নাম লেখা, দ্বৈত ল্যাবে কাগজ পরীক্ষা, প্রতিটি প্রেসে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো ও ২৪ ঘণ্টা মুদ্রণ প্রক্রিয়া সরাসরি পর্যবেক্ষণ অন্যতম। একই সঙ্গে কাগজ ও ছাপার মান বাড়াতেও আনা হয়েছে নানা পরিবর্তন। কিন্তু এর পরও উপজেলা পর্যায়ে নিম্নমানের বই চলে যাচ্ছে, যা ভাবিয়ে তুলছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
আগের বছরগুলোতে দেখা গেছে, কিছু মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান বই ছাপার সময় ‘ইনার চেঞ্জ’ নামে একটি অনৈতিক পদ্ধতি অবলম্বন করত। এতে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের মানহীন বইয়ের ওপরের মলাটে বা পরিচিতি স্থানে শুধু নিজেদের নাম ছাপিয়ে নতুন বই হিসেবে সরবরাহ করত। ২০২৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রথমবারের মতো ছাপানো বইয়ের প্রতিটি ফর্মায় বাধ্যতামূলকভাবে লেখা থাকবে সংশ্লিষ্ট মুদ্রণপ্রতিষ্ঠানের নাম। ফলে বই বিতরণের পর কোনো গুণগত সমস্যা ধরা পড়লে দায়ী প্রতিষ্ঠান সহজে শনাক্ত করা যাবে।
জানা গেছে, আগে পাঠ্যবই ছাপায় ব্যবহৃত কাগজের ওজন ছিল ৮২ জিএসএম (গ্রাম পার স্কয়ার মিটার), এবার তা বাড়িয়ে ৮৫ জিএসএম করা হয়েছে। একইভাবে, কাগজের উজ্জ্বলতা সূচক বা ব্রাইটনেস বাড়ানো হয়েছে। এবার কাগজের বাস্টিং ফ্যাক্টর ১৬ থেকে ২০ করা হয়েছে। এ ছাড়া কাগজে আগে ব্যবহৃত হতো কৃত্রিম উজ্জ্বলকরণ বা অপটিক্যাল ব্রাইটনার। এবার ব্যবহার করতে বলা হয়েছে ১০০ শতাংশ প্রাকৃতিক পাল্প।
এবার প্রতিটি প্রেসে বসানো হচ্ছে সিসিটিভি ক্যামেরা। এর মাধ্যমে এনসিটিবি মুদ্রণ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবে। একই সঙ্গে পরিদর্শন সংস্থাগুলোর (ইন্সপেকশন এজেন্সি) ওপর কড়া শর্ত আরোপ করা হয়েছে, যাতে কোনো মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান এসব সংস্থাকে প্রভাবিত করতে না পারে। এনসিটিবিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের জন্য পৃথক দুটি ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। মনিটরিং কর্মকর্তারা প্রেস থেকে কাগজ নিয়ে আসবেন। এরপর ওই ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখা হবে, কাগজের মান ঠিক আছে কিনা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের বইয়ের মান কেমন ছিল তা চিহ্নিত করতে এনসিটিবি ৩২টি টিম ৬৪ জেলায় পাঠায়। টিমগুলো দৈবচয়ন পদ্ধতিতে বই সংগ্রহ করে দেখতে পায় ৩৩ শতাংশ বই নিম্নমানের। অর্থাৎ ৪০ কোটির মধ্যে ১৩ কোটি বইয়ের মান খারাপ। এসব বইয়ে জিএসএম, ঔজ্জ্বল্য, বাঁধাই—কিছুই ঠিক নেই। নিম্নমানের এসব বই দিয়ে শতকোটি টাকা অতিরিক্ত লোপাট করেছে অসাধুচক্র। অথচ ওই প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করেনি এনসিটিবি। এমনকি যারা নিম্নমানের বই সরবরাহ করেছে তাদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। ফলে ওই চক্রই ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের জন্যও নিম্নমানের বই সরবরাহ করছে।
বাংলাদেশ মুদ্রণ সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অতীতে যেসব অপকর্ম হয়েছে, যারা নিম্নমানের বই সরবরাহ করেছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি এনসিটিবি। ফলে তারা আবারও নিম্নমানের বই দিচ্ছে। আমরা চাই, এনসিটিবি কঠোর মনিটর করুক। তারা যেন বড় প্রেস মালিকদের সঙ্গে কোনো আঁতাত না করে। তাহলে শিক্ষার্থীদের হাতে সঠিক মানের বই পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। একই সঙ্গে এ বছরও অনেক প্রেস সক্ষমতার চেয়ে বেশি বই পেয়েছে, এতে ডিসেম্বরের মধ্যে বই পৌঁছানো সম্ভব হবে না। ছোট-বড় সব প্রেসকে তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী বইয়ের কাজ দিতে হবে। ’