ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর সহযোগী ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে। এ ফলাফল শুধু ক্যাম্পাস নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
একদিকে শিবিরের এই অপ্রত্যাশিত সাফল্যে বিএনপি ও তাদের সহযোগী ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নিজেদের ব্যর্থতা ও পরাজয়ের কারণ নিয়ে তীব্র বিশ্লেষণ শুরু করেছে।
অন্যদিকে, রাজনৈতিক অঙ্গনে যে জল্পনা ছিল— জাতীয় পার্টি আবারও বিরোধীদল হতে পারে, ডাকসুর এই নির্বাচনী ফলাফলের পর তা অনেকটাই গুরুত্ব হারিয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, জাতীয় পার্টি পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সহযোগী হিসেবে বিগত তিনটি নির্বাচনে সমঝোতায় বিরোধী দল হয়েছিল। সৌভাগ্যের বরপুত্র হিসেবে পরিচিত সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের এ দলটি ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পরও বিরোধীদল হতে পারে, এমন কানাঘুষা ছিল রাজনীতির অন্দরমহলে।
আবার জাতীয় পার্টির নেতারা বলছেন, আগের মতো সামনের নির্বাচনেও জাতীয় পার্টি মিনিমাম লেভেলের হলেও ফ্যাক্টর হবে। দল নিষিদ্ধের দাবিও তো তোলা হচ্ছে। কিন্তু এসব কিছুই হবে না, বরং জাতীয় পার্টি ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। ছাত্রদের নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচন এক নয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পতিত আওয়ামী লীগের ভোট আর জামায়াত বিরোধী দলগুলোর কাছে মন্দের ভালো ছিল জাতীয় পার্টি। এ কারণে গণ-অধিকার পরিষদ কয়েক দফায় জাতীয় পার্টির অফিস ভাঙচুর করে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দাবি, প্রকাশ্যে গণ অধিকার পরিষদ জাতীয় পার্টির অফিস ভাঙচুরে যুক্ত থাকলেও নেপথ্যে ছিল জামায়াতে ইসলামী। কেননা আগামী জাতীয় নির্বাচনে জামায়াত যে কোনোভাবেই সরকার বা বিরোধীদলের যেকোনো একটিতে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে এবার বদ্ধপরিকর।
তাদের মতে, ডাকসু নির্বাচনকে জামায়াত জাতীয় রাজনীতিতে নিজেদের ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে নিয়েছিল। জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কৌশলও ছিল সে প্রক্রিয়ার অংশ।
এমন আলোচনা শোনা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যান্য সংগঠন বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে না নিলেও জামায়াত যেকোনো মূল্যে ডাকসুতে জয় চাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় ছিল। সে অনুযায়ী দলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও ছাত্রদের মন জয়ে সামাজিক-অর্থনৈতিক সব শক্তি নিয়োগ করে, যা অন্যরা করতে পারেনি।
উদ্দেশ্য ছিল একটাই, আওয়ামী লীগ নেই, বিরোধীদলের শূন্যস্থান যেকোনোভাবেই হোক পূরণ করা। আর রাজনৈতিক সমঝোতা বা সিদ্ধান্তে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখা। ডাকসুতে জয়ের মাধ্যমে দলটি সে পথেই যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষক ড. শফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, জামায়াতও ভাবেনি তারা এত ভোট পাবে। মূলত এই নির্বাচন জুলাই আপরাইজিংকে কনটিনিউ করেছে। আধিপত্যবাদবিরোধী তরুণদের ঐক্য এখনও বিদ্যমান।
তিনি বলেন, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির এই বিজয়ের ধারা যদি নিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে পরিবর্তন আসন্ন। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিবির সহাবস্থানের রাজনীতি করলে ছাত্ররাজনীতির গুণগত পরিবর্তনও আসবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. রাশেদ আলম ভূঁইয়া বাংলানিউজকে বলেন, ডাকসু নির্বাচনের প্রভাব অবশ্যই সুদূরপ্রসারী হবে। জামায়াত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়ে গেল। বিএনপির বদনামের কারণে তাদের ভোট সামনে আরও অনেক বাড়তে পারে। কবি সুফিয়া কামাল হলে ডাকসুর ভিপি পদে নারী প্রার্থী উমামা ফাতেমা থাকার পরও সাদিক কায়েম ১২০০-এর বেশি ভোট পেয়েছে। এটা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, ডাকসুতে এবার তরুণ প্রজন্মের প্রথম ভোট ছিল। সেখানে প্রায় ৮০ শতাংশ ভোট পড়েছে। জাতীয় নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়তে পারে। ম্যাসিভ টার্নআউট হবে। জাতীয় নির্বাচনেও যদি অধিকাংশ মানুষ ভোট দিতে আসে, তাহলে ভোটের হিসেবে পাল্টে যেতে পারে।
নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে অধ্যাপক ভূঁইয়া আরও বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের ভোট চার হাজারের মতো রয়েছে। বাকি ভোট যেগুলো তারা পেয়েছে সেগুলো সুইং ভোট। দেশের শিক্ষিত তরুণরা জাতীয় ইস্যুগুলোতে গুরুত্ব দেয়। জাতীয় স্বার্থবিরোধী ইস্যুতে তরুণ প্রজন্ম এবার ঐক্যবদ্ধ ছিল।
তিনি বলেন, জাতীয় স্বার্থের জন্য ভারতীয় আধিপত্য হুমকি। আওয়ামী লীগের ভারত তোষণের মিথকে তরুণ প্রজন্ম চ্যালেঞ্জ করেছে। শিবির যার কারণে ভোট পেয়েছে। মূলত এই ভোটগুলো বিএনপি পরিবারের ভোট। যে বিএনপির শক্তি ছিল ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ। সেই চেতনার ভোটগুলোই শিবির পেয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আব্দুল লতিফ মাসুম বাংলানিউজকে বলেন, ডাকসু নির্বাচনে সকল জরিপকে মিথ্যা প্রমাণ করে শিবিরের জয় বিস্ময়কর। ৫ আগস্টের পর বিভিন্নভাবে ধারণা করা হতো জামায়াতে ইসলামী দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হয়ে উঠেছে। কিন্তু ডাকসুর মাধ্যমে সেটা এখন প্রমাণিত। জাতীয় নির্বাচনে ডাকসুতে শিবিরের জয় বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। এখন যেকোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে জামায়াতে প্রভাব বাড়বে।
জাতীয় পার্টির (আনিস-হাওলাদার) নবগঠিত অংশের নির্বাহী চেয়ারম্যান ও সাবেক মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বাংলানিউজকে বলেন, আমার মনে হয় না ডাকসু নির্বাচনের প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়বে। এটা ছিল শুধুমাত্র ছাত্রদের নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচন রাজনৈতিক দল, প্রতীক ও ব্যক্তির সংমিশ্রণে হয়ে থাকে। সেখানে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়া ও না যাওয়ার প্রশ্নও আছে। তাই দুটিকে মিলিয়ে ফেললে হবে না।
তার দাবি, ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণ হবে না জাতীয় পার্টি দেশের বিএনপি বা আওয়ামী লীগের পরের বৃহত্তম দল নয়। আমাদের দল এমন একটি দল যাদের প্রতিটি গ্রামেই কিছু না কিছু কর্মী-সমর্থক আছে। এরশাদের ৮ বছরের শাসনামলের চিত্র আমরা এখনও মানুষকে দেখাতে পারি।
জাতীয় পার্টির এ নেতা বলেন, অতীতের ন্যায় সামনের নির্বাচনেও জাতীয় পার্টি মিনিমাম লেভেলের হলেও ফ্যাক্টর হবে। আমাদের দল নিষিদ্ধের দাবিও তো তোলা হচ্ছে। কিন্তু এসব কিছুই হবে না, বরং জাতীয় পার্টি ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। যারা দল থেকে চলে গিয়েছিলেন তারাও ফিরে আসছেন। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, শেখ শহীদরা আসছেন।
জি এম কাদের অংশের সঙ্গে একত্রে সামনের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সম্ভাবনার বিষয়ে চুন্নু বলেন, একটি পরিবারের মনোমালিন্য থাকেই। তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারবেন। আশা করি, তিনি ফিরে আসবেন।
এনডি