ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৪ ভাদ্র ১৪৩২, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

ডাকসু নির্বাচন ঘিরে বদলে যেতে পারে জাতীয় রাজনীতির সমীকরণ

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:৪৪, সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৫
ডাকসু নির্বাচন ঘিরে বদলে যেতে পারে জাতীয় রাজনীতির সমীকরণ

আগামী ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। এরই মধ্যে জাতীয় রাজনীতিতে এটি আগামী সংসদ নির্বাচনের রিহার্সাল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ডাকসু নির্বাচনকে গুরুত্ব দিয়ে মাঠে নেমেছে, সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীদের পক্ষে চালাচ্ছে প্রচার-প্রচারণা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই নির্বাচন শুধু ক্যাম্পাস রাজনীতির সীমায় আটকে থাকবে না; বরং তা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটারদের মানসিকতা ও রাজনৈতিক সমীকরণেও বড় প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ এবং নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের ভোট বিএনপির জন্য নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

ডাকসুতে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ সমর্থকদের ‘সেকেন্ড বেস্ট’ কৌশল

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধের পাশাপাশি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় ছাত্রলীগকেও। এবারের ডাকসু নির্বাচনে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের কোনো প্রার্থী নেই। ছাত্রলীগ বাদে ডাকসু নির্বাচনের মাঠে লড়ছেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ, গণঅধিকার পরিষদ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রমৈত্রীসহ বামপন্থী সংগঠনগুলোর সমর্থিত প্যানেল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এ লড়াইয়ের মাঠে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির ঠেকাতে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ এবং নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের সমর্থকরা।

কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ এবং নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ অ্যাক্টিভিস্ট ও সমর্থকদের অনেকে অনলাইনে শিবির ঠেকানোর ডাক দিচ্ছেন। ছাত্রদলকে ‘সেকেন্ড বেস্ট’ হিসেবে ভোট দেওয়ারও আহ্বান জানাচ্ছেন।

আওয়ামীপন্থী অ্যাক্টিভিস্ট অমি রহমান পিয়াল ছাত্রশিবির ঠেকাতে ছাত্রদলকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মনে রাখবেন ডাকসুতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হইতেছে ছাত্রদল আর শিবিরের। ছাত্রদলের প্যানেল একটাই। বাকিসব প্যানেল শিবির, তাগোই লোক নানা রূপে। ছাত্রদল যত খারাপই হোক আমাগো খারাপ, নব্বইয়ে আমাগো লগে রক্ত দেওয়া। শিবিরের মতো মুনাফিক না, সাপ না, বিশ্বাসঘাতক না। ’

তিনি আরও লেখেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক ঐতিহ্য ধইরা রাখতে ছাত্রদলরে ফুল প্যানেলে জয়ী করুন। শিবির আরেক বার জানুক যত মেটিকুলাস প্ল্যানই করুক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজাকার- আলবদর-বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের জন্য নিষিদ্ধ গন্ধম। ছাত্রদলকে ফুল প্যানেল জয়ী করে শিবিরকে টুপকিলাল সালাম দিন। ’

নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে, ছাত্রশিবিরকে ঠেকাতে তারা বিকল্প যেকোনো প্যানেলকে ভোট দেবেন। সেক্ষেত্রে তারা মনে করছে ছাত্রদলের জয়ের সম্ভবনা বেশি, তাই তারা তাদের সেকেন্ড বেস্ট অপশন হিসেবে ছাত্রদল প্যানেলের প্রার্থীদের ভোট দেবেন।

ছাত্রদল সূত্রে জানা গেছে, তাদের সঙ্গে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের সঙ্গে কোনো সমঝোতা বা যোগাযোগ হয়নি।

জাতীয় রাজনীতির সমীকরণ বদলাতে পারে ডাকসু নির্বাচন

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের ছাত্রদলের দিকে ঝুঁকে পড়া আগামী দিনে জাতীয় রাজনীতিতে বিএনপির জন্য বড় সুবিধা এনে দিতে পারে। বিশ্লেষকরা বলছেন, কার্যক্রম নিষিদ্ধ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সাধারণ সমর্থকদের ভোটব্যাংক যদি বিএনপির দিকে সরে আসে, তবে নির্বাচনী সমীকরণ পুরোপুরি পাল্টে যাবে। অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে থাকবে বিএনপি। সম্প্রতি অস্তিত্ব রক্ষায় আওয়ামী লীগ আমলের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও তাদের অস্তিত্ব রক্ষায় বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। চাপের মুখে পড়বে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, ইসলামী আন্দোলনসহ অন্যান্য দল।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ডাকসু নির্বাচন কেবল ছাত্র সংসদে ক্ষমতার লড়াই নয়; বরং জাতীয় নির্বাচনের আগে জনমত যাচাইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্নিপরীক্ষা।

তারা বলছেন, কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ এবং নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ ভোটাররা যদি সত্যিই বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়েন, তবে এটি হবে জাতীয় রাজনীতিতে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা। আর সেই পরিবর্তনের প্রথম ইঙ্গিত মিলবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিতব্য ডাকসু নির্বাচনে।

অন্যদিকে ছাত্রশিবির যদি ডাকসুতে শক্ত অবস্থান নেয়, তাহলে জাতীয় রাজনীতিতে তাদের দরকষাকষির ক্ষমতা বাড়বে। ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য ও মনোবল বাড়বে। একই সঙ্গে আগামী সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর ভোটে এটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খোরশেদ আলম বলেন, ডাকসু নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনে একটি ভালো প্রভাব রাখবে, তবে সেটি কত বড়, তা বলা যাচ্ছে না। এটিকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদ বলা হয়। তবে এটি একমাত্র ডিসাইসিভ ফ্যাক্টর হবে না।

তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ যদি নির্বাচিত হয়, তাহলে তাদের বার্গেইন চিপ বাড়বে। নির্বাচন কেন্দ্রিক একধরনের নেগোসিয়েশন, দেন-দরবার, জোট-ঐক্যজোট হয়। ফলে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কেউ জিতলে তারা বিভিন্ন আলোচনায় বাড়তি সুবিধা পাবে।

ছাত্রশিবিরের অবস্থান তুলে ধরে অধ্যাপক খোরশেদ বলেন, ছাত্রশিবির জিতলে জামায়াতে ইসলামী সমাজে একটি ন্যায্যতা পাবে, মধ্যবিত্ত সমাজ তাদের চায় বা আর অপছন্দ করছে না।

তিনি বলেন, এবারের নির্বাচনে তাদের জনসমর্থন কেমন তৈরি হয়েছে, নাকি কেবল সামাজিক মাধ্যমে প্রোপাগান্ডা, তার একটি এসিড টেস্ট হবে। এছাড়াও, জামায়াতে ইসলামীর ক্ষেত্রে এটি জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে।

তবে সবচেয়ে কম প্রভাব বিএনপির ক্ষেত্রে পড়বে বলে মনে করছেন খোরশেদ আলম। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে বিএনপি অ্যাবসোলিউট মেজরিটি পেতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন। ফলে নির্বাচনে ডাকসুর ফলাফল তাদের ক্ষেত্রে তেমন প্রভাব ফেলবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আইনুল ইসলাম বলেন, নির্বাচন নিয়ে সারাদেশে গ্রামে-গঞ্জ পর্যন্ত সবার আগ্রহ আছে। এখানে ৪০ হাজার ভোটার আছে। তারা সবাই কোনো না কোনো জেলা থেকে আসেন। সেখানে তাদের একটি প্রভাব আছে। ফলে এখানে কারা জয়ী হবেন, তা জাতীয় রাজনীতিতে ম্যাটার করে।

তিনি বলেন, অনেকে ডাকসু নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা আছে এখানে। যারা নির্বাচিত হবেন, তারা জাতীয় নির্বাচনে প্রচারণায় ভূমিকা হতে পারেন। তিনি কোনো দলের পক্ষে প্রচারণা চালান, সেটি বড় প্রভাব রাখবে।

তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের আরেক অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান মনে করছেন, ছাত্রদের এই নির্বাচন জাতীয় রাজনীতিতে কোনো প্রভাব রাখবে না।

তিনি বলেন, এটি শিক্ষার্থীদের নির্বাচন। এখানে শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা হবে। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন, কিন্তু তার অর্থ এই নয়, জাতীয় পর্যায়ে ভোটাররা প্রভাবিত হবে।

অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, এখানে যেসব শিক্ষার্থীরা এসেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, তাদের বাবা-মা এবং আত্মীয়-স্বজনের এই নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ আছে। ফলে তাদের একটা আগ্রহ আছে জানার। কিন্তু এটি জাতীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে না। জাতীয় নির্বাচনের সাথে এখানকার নির্বাচনের দাবি-দাওয়া ও স্বার্থের কোনো মিল নেই।

তিনি বলেন, এখানে শিক্ষার্থীদের চাওয়া-পাওয়ার বিষয় আছে। অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিসহ একাধিক বিষয় জড়িত। ফলে ওখানে প্রভাবিত করবে না।

আলোচিত ভিপি-জিএস-এজিএস প্রার্থী যারা

ডাকসুর ২৮টি পদের বিপরীতে এবার লড়ছেন ৪৬২ জন প্রার্থী। এর মধ্যে ভিপি পদে ৪৮, জিএসে ১৯ এবং এজিএসে ২৮ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

ছাত্রদল সমর্থিত ‘আবিদ-হামীম-মায়েদ পরিষদ’ থেকে ভিপি পদে আবিদুল ইসলাম খান, জিএস পদে শেখ তানভীর বারী হামিম এবং এজিএস প্রার্থী তানভীর আল হাদী মায়েদ আলোচনায় আছেন।

ছাত্রদল-শিবির সমর্থিত প্যানেলের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। শিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট থেকে ভিপি পদে আবু সাদিক কায়েম, জিএস পদে এসএম ফরহাদ এবং এজিএস প্রার্থী হিসেবে মহিউদ্দিন খান লড়ছেন।

রাজনৈতিক প্যানেলের বাইরে আলোচনায় আছেন স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী শামীম হোসেন।

গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেল থেকে ভিপি পদে আবদুল কাদের এবং জিএস প্রার্থী হিসেবে আবু বাকের মজুমদার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ’ থেকে জিএস মাহিন সরকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। তবে তিনি জিএস পদে আবু বাকের মজুমদারকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।

এ ছাড়া ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেল থেকে ভিপি পদে উমামা ফাতেমা; ছাত্রঅধিকার পরিষদ থেকে ভিপি পদে বিন ইয়ামিন মোল্লা এবং বামপন্থী শিক্ষার্থীদের প্যানেল ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ থেকে ভিপি পদে শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি, জিএস পদে মেঘমল্লার বসু লড়ছেন।

 এমইউএম/এফএইচ/এমজেএফ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।