ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২৯ মে ২০২৫, ০১ জিলহজ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

সাক্ষাৎকারে জুলাইযোদ্ধা শাহিন

জুলাই আহতদের নিয়ে কুচক্রীরা ব্যবসা করছে

রেজাউল করিম রাজা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:০৯, মে ২৮, ২০২৫
জুলাই আহতদের নিয়ে কুচক্রীরা ব্যবসা করছে জুলাইযোদ্ধা শাহিন

ঢাকা: জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের নিয়ে বিভিন্ন কুচক্রী মহল দালালি এবং ব্যবসা শুরু করেছে বলে অভিযোগ করেছেন ওই আন্দোলনের সম্মুখসারির যোদ্ধা শাহিনুর রহমান শাহিন। এ প্রবণতা বন্ধে তিনি অবিলম্বে জুলাই ঘোষণাপত্র ও আহতদের সুরক্ষা আইন করার দাবি জানিয়েছেন।

সম্প্রতি বাংলানিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শাহিন এ দাবি জানান। তিনি জুলাই গণহত্যায় অভিযুক্ত আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ, জুলাই আহতদের চিকিৎসা-পুনর্বাসন ও জুলাই সনদ প্রকাশের দাবিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন।

টাঙ্গাইলের ছেলে শাহিনুর রহমান শাহিন পড়াশোনার জন্য থাকেন ঢাকার মোহাম্মদপুরে। তিনি ঢাকা স্টেট কলেজে অনার্স চতুর্থ বর্ষে পড়ছেন। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদবিরোধী অভ্যুত্থানে তিনি ছিলেন সম্মুখসারির যোদ্ধা। আন্দোলন চলাকালে গত বছরের ৪ আগস্ট ঢাকার মোহাম্মদপুরে গুলিবিদ্ধ হন শাহিন।

বাংলানিউজ: কীভাবে আপনি গুলিবিদ্ধ হলেন?
শাহিনুর রহমান: আমি ৪ আগস্ট রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরে গুলিবিদ্ধ হই। তারপর আমাকে ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়। ইবনে সিনায় আমার একে একে তিনটা সার্জারি করা হয়। পেছন থেকে ঢুকে গুলি পেটের ভেতর আটকে ছিল। সার্জারি করে গুলি বের করা হয়। আমার পাকস্থলীর কিছু অংশ কেটে ফেলা হয়। আমি যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন আমাকে ভ্যাকসিন নিতে হবে। অ্যান্টিবডি তৈরির জন্য আমাকে আজীবন বছরে তিনটা করে ভ্যাকসিন নিতে হবে।

বাংলানিউজ: প্রতিটা ভ্যাকসিনের মূল্য কত?
শাহিনুর রহমান: ইবনে সিনায় আমি এক মাস ২০ বিশ দিন ভর্তি ছিলাম। ওই সময় আমাকে ভ্যাকসিনগুলো দেওয়া হয়েছিল। ইবনে সিনা সেই সময় আমার চিকিৎসার জন্য প্রায় ছয় লক্ষ টাকার বিল নেয়নি। এখন আমি আবার কিনতে গেলে হয়তো ভ্যাকসিনের দাম জানতে পারবো।

বাংলানিউজ: ভবিষ্যতের চিকিৎসা কোথায় কীভাবে করবেন?
শাহিনুর রহমান: এখন ইবনে সিনা থেকে বলছে, সরকার যেহেতু তোমাদের স্বাস্থ্য কার্ড দিয়েছে, তোমাদের জন্য যেহেতু আলাদা সেল করা হয়েছে, তোমরা সেখানে চিকিৎসা নিতে পারবা। তারপরও এখনো আমি ইবনে সিনা থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছি। আমাদের যদিও স্বাস্থ্য কার্ড দেওয়া হয়েছে, কিন্তু আহতরা সবাই আশানুরূপ ফলাফল পাচ্ছে না। আমরা চাচ্ছিলাম জুলাই ঘোষণাপত্র দিলে আমাদের আহত হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এখন ঘোষণাপত্র না দেওয়ার কারণে জুলাই আহতদের নিয়ে বিভিন্ন মহল বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করছে। যার কারণ সমাজে আমাদের মানসম্মান কমে যাচ্ছে। যারা আহত, তারা পূর্ণ সম্মান পাচ্ছে না। আমরা দেশের জন্য ত্যাগ করেছি, আমরা এখনো দেশের জন্যই আছি। আমাদের দেশে ১৯৪৭ সাল থেকে বিভিন্ন সময় বিপ্লব হয়েছিল, কোনো বিপ্লব সেই ভাবে স্বীকৃতি পায়নি। বিপ্লবের সার্থকতা পায়নি।

২৪ এর বিপ্লবের পরে নতুন সরকার গঠন করা হয়েছে, আমরা চাই, ২৪ এর যে চেতনা ছিল, আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যেন জানাতে পারি, ২৪-এ যে সাহসী সন্তানেরা ছিল তারা অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেনি, তোমরাও মাথা নত করবে না। আমাদের বিপ্লবকে যেন সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আমরা আহতরা অবস্থান গ্রহণ করেছি, জুলাই ঘোষণাপত্র চাওয়ার জন্য।

২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর সরকার বলেছিল, জুলাই ঘোষণাপত্র হবে। আমরা শহীদ মিনারে বিশাল বড় সভা করেছিলাম। ড. ইউনূস বলেছিলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়া হবে। আমাদের কিছুই করতে হবে না। ইতোমধ্যে প্রায় পাঁচ মাস হয়ে গেল, কিন্তু কিছুই হলো না। মার্চে ঘোষণা করার কথা ছিল তাও হয়নি। সেজন্য আহতদের মাঠে নামতে হচ্ছে, ঘোষণাপত্র দেওয়ার দাবিতে।

আওয়ামী লীগ ১৭ বছরের পিলখানা হত্যাকাণ্ড, ৫ মে হত্যাকাণ্ড এবং ২৪ সালে পাখির মতো সর্বসাধারণকে হত্যা করলো। যাদের হাত রক্তে রঞ্জিত, তাদের দেশ সেবার মত মহৎ কাজে নিযুক্ত করার কোনো দরকার আছে? কোনো বিবেকবান মানুষ তাদের রাখতে পারে কি না আমি জানি না। সেজন্য আমরা চাই আওয়ামী লীগের বিচার এবং স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করা হোক। জুলাই ঘোষণাপত্র এবং আহতদের সুরক্ষা আইন চাই। আহতদের জন্য এখনো কোনো সুরক্ষা নেই। বিভিন্ন মহল তাদের হুমকি দিচ্ছে। আহতদের সুরক্ষা, চিকিৎসা এবং পুনর্বাসন চাই।

বাংলানিউজ: আপনার মত অন্যান্য যারা আহত রয়েছে তারা কি সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছে?
শাহিনুর রহমান: ঢাকাকেন্দ্রিক আমরা যারা ছিলাম তারা মোটামুটি চিকিৎসা পেয়েছি। আন্দোলন তো শুধু ঢাকায় হয়নি, সারাদেশেই হয়েছে। দেশের বিভিন্ন মফস্বল শহরে যারা ছিল তারা সেভাবে চিকিৎসা পায়নি। যেহেতু আমাদের মৌখিকভাবে সম্মান দিয়েছেন, আমরা চাই সার্বজনীনভাবে আমাদের সম্মান দেওয়া  হোক। আহতদের নিয়ে কেউ ছিনিমিনি কিংবা ব্যবসা করবেন না। ২৪ এর চেতনা বিক্রি করে আহতদের মান-সম্মান ক্ষুণ্ণ না করার জন্য আমি সব দলকে বলছি।

আহতদের নিয়ে সবাই বলে এটা করবে সেটা করবে। প্রকৃতপক্ষে তারা দুই-একজনকে সহযোগিতা করে, বাকিদের জন্য কিছুই করে না। আপনি আমাকে একটা বিষয় নিয়ে সহযোগিতা করবেন, সেটাও মিডিয়া কভারেজ হয়ে যাবে। কিন্তু আমার পাশে যে আরেকজন রয়েছে তাকে দেবেন না।

বাংলাদেশের প্রায় ২২ হাজার আহত রয়েছে, ২০০০ শহীদ পরিবার রয়েছে, আমরা চাই সব আহত এবং শহীদ পরিবারকে সমমর্যাদায় সমানভাবে সম্মান দেওয়া হোক এবং কোনো সহযোগিতা যদি করা হয়, সবাইকে যেন সমানভাবে করা হয়। ব্যক্তিকেন্দ্রিক কাউকে সহযোগিতা করে সেটা আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়ে আহতদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করার প্রয়োজন নেই।

এখানে অনেক আহত রয়েছেন, যারা দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকার কারণে তাদের সংসার পরিচালনা করার সামর্থ্য নেই। সরকার বলছে ভাতা দেবে, এখনো কিন্তু কেউ ভাতা পায়নি। কিন্তু আমাদের ফ্যামিলিকে সবাই বলে, তোমাদের ছেলে মেয়েকে সরকার কোটি কোটি টাকা দিচ্ছে। জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে আমাকে এক লাখ টাকা দিয়েছে এবং সরকার থেকে এক লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে। ইবনে সিনার খরচটা মওকুফ না করলে এখন পর্যন্ত প্রায় ১২ লক্ষ টাকা খরচ হয়ে গেছে। ইবনে সিনার খরচ বাদ দিলেও আমার ৬ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে, কিন্তু আমি সরকার থেকে দুই লক্ষ টাকা পেয়েছি। টাকার বিষয় তুলবো না, কারণ আমরা দেশের জন্য করেছি। আল্লাহ হয়তো আমাদের ত্যাগকে কবুল করেছেন, আলহামদুলিল্লাহ।

আহতদের নিয়ে কেউ যেন ব্যবসা বা ছিনিমিনি না করে। জুলাই আহতদের নিয়ে বিভিন্ন কুচক্রী মহল দালালি শুরু করেছে। কোনো মহল যদি আমাদের সেবা করতে চায়, তাহলে তারা যেন নিজেরা করে, কোনো দালালের মাধ্যমে নয়। দেশবাসীর কাছে কাম্য, সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে জুলাই ঘোষণাপত্রের জন্য সোচ্চার হন।

আরকেআর/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।