ঢাকা: ১৬ জুলাই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, তলপেটসহ তার বুকের ডান পাশে এবং বাম পাশে অন্তত ৯০টি ধাতব প্যালেটের আঘাত ছিল।
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করা এই প্রতিবেদন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের সহজবোধ্যভাবে বোঝার সুযোগ করে দিতে অনলাইন নিউজপোর্টাল বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম এর সম্পাদকীয় বিভাগ ইংরেজি থেকে হুবহু বাংলায় অনুবাদ করেছে। বাংলায় অনুদিত সেই প্রতিবেদনটি ধারাবাহিকভাবে পাঠকদের কাছে সংবাদ আকারে তুলে ধরা হচ্ছে। আজ থাকছে সেই প্রতিবেদনের ১২তম পর্ব।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে হাজার হাজার স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী (পুলিশের হিসাব অনুযায়ী তিন-চার হাজার শিক্ষার্থী) প্রতিবাদ মিছিল বের করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর গেটে শিক্ষার্থীরা সমবেত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। পুলিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যখন আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট দিয়ে জোরপূর্বক প্রবেশের চেষ্টা করেন, তখন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ শুরু হয়। পুলিশ ‘আন্দোলনরত শিক্ষার্থীসহ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে গ্যাস শেল ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে’। পুলিশ আরও জানায়, আবু সাঈদ গুরুতর আহত অবস্থায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান এবং তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে ‘মাথায় আঘাত ও গুলির আঘাত’ উল্লেখ করা হয়।
ভুক্তভোগী এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের নির্ভরযোগ্য ও সামঞ্জস্যপূর্ণ বিবরণ এবং প্রাপ্ত ভিডিওগুলো বিশ্লেষণে ওএইচসিএইচআর নিশ্চিতভাবে মনে করে যে, তার হত্যাকাণ্ডে পুলিশ সরাসরি জড়িত এবং দায়ী। ছাত্রলীগ সমর্থকদের সঙ্গে মিলে পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠি ও ব্যাটন নিয়ে হামলা চালায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, আবু সাঈদও হামলার শিকার হন। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর টিয়ারগ্যাস ছোড়ে এবং ধাতব গুলিভর্তি শটগান ব্যবহার করে। এতে কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন, একজন আংশিকভাবে দৃষ্টিশক্তি হারান। যখন পুলিশ জনতার ওপর গুলি চালানো শুরু করে, আবু সাঈদ দুই হাত প্রসারিত করেন।
ভিডিও ও প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য অনুযায়ী, তিনি এক হাতে বাঁশের লাঠি ধরেছিলেন, তবে ১৪-১৫ মিটার দূরে অবস্থান করা পুলিশ সদস্যদের জন্য তিনি কোনোভাবেই হুমকি ছিলেন না। ওএইচসিএইচআরকে সাক্ষাৎকার দেওয়া প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য অনুযায়ী, আবু সাঈদ পুলিশকে উদ্দেশ করে চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আমাকে গুলি করুন’, তখন দুই পুলিশ সদস্য প্রাণঘাতী ধাতব গুলিভর্তি শটগান দিয়ে তার শরীর লক্ষ্য করে একাধিকবার গুলি চালায়।
ওএইচসিএইচআর গুলি চালানোর ভিডিও ও ছবি পর্যালোচনা করে। এসব ছবি ও ভিডিও প্রথমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। পরে এসব ছবি ও ভিডিওর মানোন্নয়নের কাজ করে ওএইচসিএইচআরের ডিজিটাল ফরেনসিক। এরপর তারা প্রত্যক্ষদর্শীদের দেওয়া বক্তব্যের সঙ্গে ছবি ও ভিডিও মিলিয়ে দেখে এবং হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করে।
একজন প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, আবু সাঈদকে হাসপাতালে নেওয়া হলে একজন চিকিৎসক মূল্যায়ন করেন, ধাতব গুলির টুকরোগুলো তার ফুসফুসে প্রবেশ করে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ সৃষ্টি করতে পারে।
ওএইচসিএইচআরের ফরেনসিক চিকিৎসক আবু সাঈদের মামলার মেডিকেল রেকর্ড পরীক্ষা করেছেন। তাতে তিনি দেখতে পেয়েছেন, আন্তর্জাতিক ফরেনসিক মান অনুযায়ী তার (আবুসাঈদ) ময়না তদন্ত করা হয়নি। চিকিৎসক মরদেহের ছবিসহ চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রমাণ পর্যালোচনা করে শরীরে শটগানের গুলির ক্ষত শনাক্ত করেন। হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, তলপেটসহ তার বুকের ডানপাশে ৪০টি ধাতব প্যালেট এবং বাঁ পাশে ৫০টি ধাতব প্যালেটের আঘাত ছিল। ফরেনসিক বিশ্লেষণে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, আবু সাঈদকে প্রায় ১৪ মিটার দূর থেকে প্রাণঘাতী ধাতব প্যালেটস ভর্তি শটগান দিয়ে অন্তত দুবার গুলি করা হয়েছিল।
ভিডিও ফুটেজের ফরেনসিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আবু সাঈদের গলা, বুক ও হাত থেকে রক্তক্ষরণ হয়। এরপর তার মধ্যে হাইপোভোলেমিয়া (রক্ত ও শরীরের অন্যান্য তরলের শূন্যতা) ও মাথা ঘোরার লক্ষণ দেখা যায়। বিশ্লেষণে মাথায় কোনো গুরুতর আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি, যা মৃত্যুর বিকল্প কারণকে সমর্থন করে। যেমন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় আবু সাঈদের মাথা মাটি বা অন্য কিছুর সঙ্গে জোরে আঘাত পেয়েছিল। যথাযথ ময়নাতদন্ত না হওয়া সত্ত্বেও নথিভুক্ত ক্ষত ও সংশ্লিষ্ট ভিডিও ফুটেজ এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে যে কমপক্ষে দুবার গুলির ফলে প্রাণঘাতী মেটাল প্যালেটের আঘাতে আবু সাঈদের মৃত্যু হয়েছে।
বিশ্লেষণ করা তথ্যের ভিত্তিতে ওএইচসিএইচআরের এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট যুক্তি সংগত কারণ রয়েছে যে, আবু সাঈদ পুলিশের ইচ্ছাকৃত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
ইএস/এজে