ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২৯ মে ২০২৫, ০১ জিলহজ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

সরকারি চাকরি অধ্যাদেশে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন নিরীহ কর্মচারীরা

গৌতম ঘোষ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২:৫৫, মে ২৭, ২০২৫
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন নিরীহ কর্মচারীরা

ঢাকা: সরকারি কর্মচারীদের শৃঙ্খলা সংক্রান্ত চার অপরাধে চাকরিচ্যুতির বিধান রেখে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করেছে সরকার। আর এই অধ্যাদেশকে নিবর্তনমূলক দাবি করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন কর্মকর্তা- কর্মচারীরা।

 

তারা বলছেন, এই অধ্যাদেশের ফলে নিরীহ কর্মচারী কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই চাকরিচ্যুত হবেন। চাকরির ভয় দেখিয়ে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা সহজে দুর্নীতি করবে, নিরীহ কর্মচারীরা হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হবে। ফলে গত তিন দিন ধরে এই অধ্যাদেশের বিরোধিতা করে সরকারি কর্মচারীদের প্রতিবাদ বিক্ষোভে উত্তাল প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়।  

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বর্তমানে প্রশাসনের যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন করার প্রয়োজন রয়েছে। তবে কোনো নিবর্তনমূলক আইন করা যাবে না। চাইলেই যে কাউকে চাকরিচ্যুত করার বিধান ভবিষ্যতে অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি করবে। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে চাকরিচ্যুতির মতো কঠিন শাস্তি দিতে হবে।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় প্রশাসনে। নাজুক পরিস্থিতির সুযোগে দাবি-দাওয়া আদায়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অবরুদ্ধ করা হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের। এতে ব্যাহত হচ্ছিল স্বাভাবিক কাজকর্ম। ফলে আন্দোলন-বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ প্রেক্ষাপটেই আইন সংশোধন করে কঠোর করার বিষয়টি সামনে আসে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৯ সালের বিশেষ বিধান অধ্যাদেশের আদলে ২০১৮ সালের চাকরি আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রণয়ন করা হয় ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’।

অধ্যাদেশে বলা হয়েছে- সরকারি কর্মচারীদের চারটি বিষয়কে অপরাধের আওতাভুক্ত করা হয়। সেগুলো হলো- সরকারি কর্মচারী যদি এমন কোনো কাজে লিপ্ত হন, যা অনানুগত্যের শামিল বা যা অন্য যেকোনো সরকারি কর্মচারীর মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি করে বা শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধার সৃষ্টি করে, অন্যান্য কর্মচারীর সঙ্গে সমবেতভাবে বা এককভাবে ছুটি ছাড়া বা কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া নিজ কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকেন বা বিরত থাকেন বা কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হন, অন্য যেকোনো কর্মচারীকে তার কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকতে বা বিরত থাকতে বা তার কর্তব্য পালন না করার জন্য উসকানি দেন বা প্ররোচিত করেন, যেকোনো সরকারি কর্মচারীকে তার কর্মে উপস্থিত হতে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধাগ্রস্ত করেন তাহলে তিনি অসদাচরণের দায়ে দণ্ডিত হবেন। অধ্যাদেশে এসব অপরাধের শাস্তি হিসেবে বলা হয়েছে, দোষী কর্মচারীকে নিম্নপদ বা নিম্ন বেতন গ্রেডে নামিয়ে দেওয়া, চাকরি থেকে অপসারণ বা চাকরি থেকে বরখাস্ত করার দণ্ড দেওয়া যাবে।

অধ্যাদেশ অনুযায়ী, কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের সাত দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। আর অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করা হলে কেন দণ্ড আরোপ করা হবে না, সে বিষয়ে আরও সাত কর্মদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। তার ভিত্তিতে দণ্ড আরোপ করা যাবে। এভাবে দণ্ড আরোপ করা হলে দোষী কর্মচারী ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে সেই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন। তবে রাষ্ট্রপতির দেওয়া আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না। আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করা যাবে।

বর্তমানে দেশে প্রায় ১৬ লাখের মতো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। আইন অনুযায়ী সবাই কর্মচারী।

এ বিষয়ে সাবেক কয়েকজন আমলা বলেছেন, সরকার যখন দুর্বল হয় তখনই কিন্তু সে নিবর্তনমূলক আইনের আশ্রয় নেয়। কঠোর আইন করার বিষয়টিকে একেবারে খারাপ বলা যাবে না। কঠোর আইন দরকার আছে। তবে সেটা নিবর্তনমূলক হবে না। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে, নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে। এরপর সেই তদন্তে কেউ যদি দোষী সাব্যস্ত হয় তবে তাকে সাজা দেওয়া হোক। সেই প্রক্রিয়ার সময়টা সংক্ষিপ্ত হোক।

সরকার যে অধ্যাদেশ করেছে সেখানে চাকরিচ্যুত করার বিধান রাখা হয়েছে, যেটা ভবিষ্যতে অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি করবে। এ ধরনের আইনের অপপ্রয়োগের ভয়টা বেশি থাকে। এই আইনের মাধ্যমে নিরীহ কর্মচারীরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। কর্মচারীদের ভয় সেখানেই।  

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি বাদিউল কবীর বলেন, সরকার কর্মচারীদের শৃঙ্খলা সংক্রান্ত চার অপরাধে চাকরিচ্যুতির বিধান রেখে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করেছে। ফলে অনেক নিরীহ কর্মচারী কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই চাকরিচ্যুত হবেন। এতে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা সহজে দুর্নীতি করতে পারবে ও চাকরির ভয় দেখিয়ে হয়রানি ও কর্মচারী নিপীড়নের স্টিম রোলার চালাবে।

তিনি আরও বলেন, আমরা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলেছি। কিন্তু কেউ আমাদের আশ্বস্ত করতে পারেনি। যতক্ষণ পর্যন্ত এই ‘কালো’ আইন বা অধ্যাদেশ সম্পূর্ণরূপে বাতিল না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত এই কর্মসূচি চলমান থাকবে। এই আইন বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে চলমান কর্মসূচি সমাপ্ত হবে।  

বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের মহাসচিব মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা যে কয়জন উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছি তারা আমাদের ব্ল্যাকমেইল করছে। আমরা এর প্রতিবাদ জানাই। একইসঙ্গে এই কালো আইন শুধু সচিবালয়ের জন্য না, সারাদেশের ১৬ লাখ সরকারি কর্মচারীদের জন্য আইন। আমরা এটা বাতিল চাই। আমাদের সপক্ষে সারাদেশে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবো। কেউ ঘরে বসে থেকেন না। সচিবদের হুমকিতে আমরা ভয় পাই না। আমাদের কর্মসূচি চলছে, চলবে।  

এদিকে উত্তাল সচিবালয়। কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়ে অধ্যাদেশটি প্রত্যাহারের দাবিতে সোমবার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মচারী মিছিল করে সচিবালয় চত্বরের বাদামতলায় জমায়েত হন। এরপর তারা সচিবালয়ের ভেতর বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নতুন ভবনের নিচে সমাবেশ করেন। এরপর আবারও মিছিল নিয়ে বাদামতলায় জমায়েত হন তারা। এক পর্যায়ে সচিবালয়ের মূল ফটকের কাছে যান তারা।  

এ সময় প্রধান ফটকসহ সচিবালয়ের বিভিন্ন ফটক বেশ কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে সরে এসে আবারও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নতুন ভবনের নিচে আসেন কর্মচারীরা। সেখানেই অধ্যাদেশ প্রত্যাহার না হাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখা এবং আরও কঠোর করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন কর্মচারী নেতারা।

জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ সংশোধন করে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ -এর খসড়া অনুমোদনের পর গতকাল অধ্যাদেশ জারি করা হয়। কর্মচারীদের অভিযোগ, সাড়ে চার দশক আগের বিশেষ বিধানের কিছু ‘নিবর্তনমূলক ধারা’ সংযোজন করে অধ্যাদেশটি করা হয়েছে।  

উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে খসড়াটি অনুমোদনের পর থেকেই এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মচারীরা। তারা এই অধ্যাদেশকে ‘নিবর্তনমূলক ও কালাকানুন’ আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। এরমধ্যে গত রোববার সন্ধ্যায় ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করে সরকার। এ নিয়ে আরও ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছেন কর্মচারীরা।

জিসিজি/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।