কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার সদর ইউনিয়নের ঐতিহাসিক বড়াইবাড়ী সীমান্তে ১৪ জন ব্যক্তিকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ঠেলে দেওয়াকে (পুশ ইন) কেন্দ্র করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।
মঙ্গলবার (২৭ মে) ভোর রাত থেকে এ উত্তেজনা দেখা দেয়।
এর আগে ২০০১ সালের ১৮ই এপ্রিল বড়াইবাড়ি গ্রামে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (তৎকালীন বিডিআর) ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের মধ্যে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে। ওই সংঘর্ষে বিএসএফের ১৬ জন সৈন্য নিহত হয় যাদের লাশ বাংলাদেশ সীমান্তের ধান খেতে পড়ে থাকে।
তবে স্থানীয়দের দাবি, ওই সংঘর্ষে আরও বেশি বিএসএফ সৈন্য নিহত হয়। এছাড়া বিডিআরের (বর্তমান বিজিবি) দুইজন সৈন্য নিহত হন। ওই সংঘর্ষ ঐতিহাসিক ‘বড়াইবাড়ি যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। বড়াইবাড়ী গ্রামে সীমান্তের ওপারে ভারতের আসাম রাজ্য।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাইফুল ইসলাম নামে বাংলাদেশের বড়াইবাড়ী গ্রামের এক বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয়। সাইফুল ২০০১ সালে ‘বড়াইবাড়ী যুদ্ধে’ অংশ নেওয়া যোদ্ধা।
তিনি বলেন, মঙ্গলবার ভোর রাতে ভারতের আসাম রাজ্যের মাইনকারচর কাকড়িপাড়া সীমান্ত পথে বিএসএফ ১৪ জন নারী-পুরুষকে (৯ জন পুরুষ ও ৫ জন রানী) গেট খুলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঠেলে দেয়। বিজিবি ও স্থানীয়রা খবর পেয়ে এতে বাধা দেয়। বিজিবি ওই নারী-পুরুষদের ভারতীয় সীমান্তে ফেরত দিতে চাইলে উত্তেজনা দেখা দেয়। স্থানীয়রা প্রতিবাদ করলে বিএসএফ রাবার বুলেট ছোড়ে এবং কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়।
সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, ‘বিএসএফ সীমান্তে অতিরিক্ত সৈন্য জড়ো করেছে। আমরাও বিজিবিসহ সীমান্তে অবস্থান করছি। ওরা অন্যায়ভাবে ওদের নাগরিকদের আমাদের দেশে ঠেলে দিয়েছে। ’
কুড়িগ্রাম-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও ২০০১ সালে বড়াইবাড়ি যুদ্ধে অংশ নেওয়া স্থানীয় বাসিন্দা রূহুল আমিন বলেন, ‘১৪ জন ভারতীয় নাগরিককে বাংলাদেশ সীমান্তে ঠেলে দিয়েছে বিএসএফ। তারা শূন্যরেখায় অবস্থান করছে। বিজিবি তাদের বাংলাদেশে প্রবেশে বাধা দিয়েছে। এ নিয়ে কিছুটা উত্তেজনা চলছে। আমি ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। ঠেলে দেওয়া নারী-পুরুষ সবাই ভারতীয় বলে জানা গেছে। ’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি বিজিবি সদস্যরাসহ সীমান্তের কাঁটাতারের কাছে গিয়ে বিএসএফকে ঠেলে দেওয়া নারী-পুরুষদের ফেরত নিতে বলি। কিন্তু তারা উত্তেজিত হয়ে যায়। এসময় তারা কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। পরে আমরা নিরাপদে সরে এসেছি। ’
ঘটনাস্থলে উপস্থিত রৌমারী উপজেলার স্থানীয় সাংবাদিক শাহারিয়ার নাজিম বলেন, ‘বিএসএফের ঠেলে দেওয়া ১৪ নারী পুরুষের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। তারা সবাই ভারতীয়। তারা দাবি করেছেন, তাদের নিজ নিজ এলাকা থেকে ধরে নিয়ে প্রথমে স্থানীয় একটি ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে মঙ্গলবার ভোর রাতে বড়াইবাড়ী সীমান্ত পথের গেট খুলে সীমান্ত পার করে দেয় বিএসএফ। এ নিয়ে সীমান্তে উত্তেজনা চলছে। বাংলাদেশ অংশে বিজিবির সঙ্গে স্থানীয়রাও জড়ো হয়েছেন। ’
বিএসএফের ঠেলে দেওয়া নারী-পুরুষদের মধ্যে খাইরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির জবানবন্দির একটি ভিডিও রেকর্ড এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। নিজেকে ভারতীয় নাগরিক দাবি করে খাইরুল ইসলাম বলেন, ‘ আমি ভারতের নাগরিক। আসামের মরিগাঁও জেলায় থাকি। সেখানে আমি সিপি (প্রাইমারি) স্কুল শিক্ষক। আমার আদি পুরুষ ভারতীয়। আমার মাটি-বাড়ি সব ভারতে। আমার মা ও ভাই সেখানে ওয়ার্ড মেম্বার পাশ করেছেন। গত ২৩ মে আমাকে ধরে এসপি অফিস নিয়ে যায়। সেখান থেকে গোয়ালপাড়া ডিটেনশন ক্যাম্পে নেয়। বিএসএফ ভোরে আরও ১৩ জনসহ আমাকে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেয়। ’
নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত স্কুল শিক্ষক খাইরুল বলেন, ‘আসতে চাইনি বলে মারধর করেছে। আসার সময় হাতে ২০০ টাকা, লাঞ্চের প্যাকেট ও একটি পানির বোতল ধরিয়ে দিয়েছে। ’
সকাল পৌনে ১০টায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ঠেলে দেওয়া ১৪ নারী-পুরুষ সীমান্তের শূন্য রেখায় অবস্থান করছিলেন। বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবি ও স্থানীয় বাসিন্দারা সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন। ওপারে বিএসএফ অতিরিক্ত সৈন্য ও ভারী অস্ত্র জমা করেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানা গেছে।
তবে এ বিষয়ে জামালপুর বিজিবি ৩৫ ব্যাটালিয়নের অধীন রৌমারী বড়াইবাড়ী বিজিবি ক্যাম্পের কেউ আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে রাজি হননি। জামালপুর বিজিবি অধিনায়কের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার সরকারি নাম্বার বন্ধ পাওয়া গেছে। ফলে বিজিবির দায়িত্বশীল কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
আরএ