ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২২ মে ২০২৫, ২৪ জিলকদ ১৪৪৬

সারাদেশ

বেপরোয়া গাড়িচাপায় মরছে সংরক্ষিত বনের প্রাণী

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:১৯, মে ২২, ২০২৫
বেপরোয়া গাড়িচাপায় মরছে সংরক্ষিত বনের প্রাণী

হবিগঞ্জ: গাছ থেকে নেমে রাস্তায় যাওয়া মাত্রই একটি বিপন্ন মুখপোড়া হনুমান শাবককে পিষে মেরে চলে যায় দ্রুতগতির একটি মাইক্রোবাস। চাপা পড়ে গুরুতর আহত হয় সঙ্গে থাকা মা হনুমানটিও।

ভাঙা পা নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে শাবকের দেহের পাশে কাঁদতে থাকে সে। পরে এক পথচারী লাঠি দিয়ে শাবকের মরদেহ জঙ্গলের ঝোঁপে ফেলে দিলে সেখানেও কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে মা হনুমানটি। এ সময় গাছের ওপর থেকে একদল হনুমান চিৎকার-চেঁচামেচি করতে থাকে।  

সম্প্রতি এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে।  

প্রতিবারের মতো এবারও বন বিভাগের ভাষ্য—‘সড়ক পরিবহন আইনের বিধান না থাকায় স্পিড ব্রেকার নির্মাণ করা যাচ্ছে না, এজন্য প্রাণীরা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। ’ 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে সাতছড়ি সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে গাড়িচাপায় শতাধিক প্রাণী মারা গেছে। অনেক প্রাণী আহত হয়ে পঙ্গু হয়েছে।

জাতীয় উদ্যান ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক এক সদস্য বলেন, কয়েক বছরের মধ্যে গাড়িচাপায় ১২ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি কিং কোবরা, একটি শঙ্খিনী সাপ, একটি কালনাগিনী সাপ, একটি চশমাপড়া হনুমান, একটি মুখপোড়া হনুমান, একটি মায়া হরিণ ও কয়েকটি বানর মারা যাওয়ার পর আমি নিজে ঘটনাস্থলে গিয়েছি। এছাড়া আরও অনেক প্রাণী মারা যাওয়ার খবর শুনেছি। গত পাঁচ বছরে দুর্ঘটনাজনিত কারণে মারা যাওয়া প্রাণীর সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যাবে।

তিনি আরও বলেন, স্থানীয়দের মতে-গাড়িচাপায় সবচেয়ে বেশি মারা যায় বানর। কারণ এরা রাস্তার পাশে বেশি ঘোরাফেরা করে। এছাড়া মারা যায় হনুমান, বন মোরগ, সজারু, বনরুই ও বিভিন্ন প্রজাতির সাপ।

প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ ৬০০ একর আয়তনের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে বর্তমানে ১৯৭ প্রজাতির জীবজন্তুর বসবাস। এর মধ্যে ২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬ প্রজাতির উভচর প্রাণী এবং আরও প্রায় ২০০ প্রজাতির পশুপাখি রয়েছে।

প্রাণী মৃত্যুর বিষয়ে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সোসাইটির (ডব্লিউসিএস) সমন্বয়কারী সামিউল মোহসেনিন বলেন, বনের ভেতর দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার সড়কে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা ২০ কিলোমিটার নির্ধারণ করা থাকলেও প্রয়োজনীয় সংখ্যক রোড সাইন নেই। চালকরাও প্রাণীর প্রতি সদয় আচরণ করেন না। ফলে দিন দিন প্রাণী মৃত্যুর হার বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে রোড সাইন বাড়ানোসহ জরুরি প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিকল্প নেই।

তিনি আরও বলেন, একটি জার্মান আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা সাতছড়িতে প্রাণী মৃত্যুর হার নির্ধারণে কাজ করছে। তারা এখানকার পরিস্থিতি নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মীর জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সাতছড়িতে ঠিক কত প্রাণী মারা গেছে, তা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তবে অনেক প্রাণী যে গাড়িচাপায় মারা যাচ্ছে, তা সত্যি। মূলত সড়ক পরিবহন আইনে স্পিড ব্রেকার নির্মাণের বিধান না থাকায় এমনটা ঘটছে।

তবে তিনি দাবি করেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার প্রাণী মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা কমেছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান স্যারের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি নিয়ে কিছু করার চেষ্টা করব।

সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিদিন কয়েক শতাধিক বালু ও পাথরবোঝাই ট্রাক সাতছড়ি সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করে। এছাড়া বাস, ট্রাক ও ট্রাক্টরসহ বিভিন্ন যানবাহন বেপরোয়া গতিতে বনের মধ্যবর্তী সড়ক ব্যবহার করছে যা প্রাণীদের জন্য প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে।

এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।