ঢাকা, সোমবার, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ মে ২০২৪, ০৪ জিলকদ ১৪৪৫

পর্যটন

শূন্য থেকে শুরু করে ১০ রিসোর্টের মালিক

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯, ২০২১
শূন্য থেকে শুরু করে ১০ রিসোর্টের মালিক টাংগুয়ার হাওরে রয়েছে সিন্দাবাদ তরী।

ঢাকা: গল্পটা প্রথাগত কোনো প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর নয়। সমুদ্র, নদী, পাহাড়, বন-জঙ্গলে  ঘুরে একজন ভ্রামণিকের গল্প এটি।

বাবা-মা ভেবেছিলেন এসব করতে করতেই ছেলের ক্যারিয়ার শেষ। কিন্তু না- ক্যারিয়ার হলো এখানেই। পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে একদম শূন্য হাতে শুরু। ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সারাদেশের বিভিন্ন পর্যটন স্পটে এখন রয়েছে প্রায় চার কোটি টাকা মূল্যের স্থাপনা। উচ্চ শিক্ষিত হয়ে চাকরিতে যোগ না দিয়ে পর্যটনেই গড়েছেন ক্যারিয়ার। কর্মসংস্থান করেছেন শতাধিক যুবকের।

বলছিলাম ট্যুর গ্রুপ বিডির (টিজিবি) উদ্যোক্তা মো. ইমরানুল আলমের কথা। তার সঙ্গে দীর্ঘ আলাপে উঠে এসেছে বাংলাদেশে ভ্রমণ ব্যবসার খুঁটিনাটি আরও অনেক কিছু । তুলে ধরছি সে আলাপচারিতা।

বাংলানিউজ: কেন মনে হলো পর্যটন খাতে এলে ভালো করবেন।

ইমরানুল: মূলত একদম ছোট বেলা থেকেই যাযাবরের মতন জীবন ছিল আমার। সেই জীবন বিভিন্ন ফরম্যাটে চলতে থাকলো। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ হবার আগ পর্যন্ত। তার আগেই নিজেরা মজা করে ঘোরাঘুরির জন্য ট্যুর গ্রুপ নামে একটি গ্রুপ করি। ঘোরাঘুরি চালু রাখার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিকে এসে মনে হলো অন্য কোনো সেক্টরে কাজ করলে ঘোরাঘুরি ব্যাপারটা কমে যাবে, হয়তো এক প্রকার বন্ধও হয়ে যেতে পারে। তখন মাথায় এলো এ সেক্টর নিয়ে কাজ করা যায় কিনা। কিছুদিন ঘাটাঘাটি করলাম, দেখলাম এ সেক্টরে প্রচুর মানুষ ভ্রমণে আগ্রহী কিন্তু সেই তুলনায় আয়োজক বা সংগঠকের সংখ্যা কম। মনে হলো এ সেক্টরে ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব। সেই ধারণা থেকেই আস্তে আস্তে আগানো। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে টিলাগাঁও ইকো ভিলেজ।

বাংলানিউজ: কি হতে চেয়েছিলেন, ক্যারিয়ার কি এখানেই থাকবে?

ইমরানুল: আমি বাণিজ্য শাখার ছাত্র ছিলাম, পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের জাপানিজ স্টাডিজ থেকে মাস্টার্স করি, মূলত ইচ্ছে ছিল ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে কাজ করার। দেশি-বিদেশি অনেকগুলো এনজিও এর সঙ্গেও জড়িত ছিলাম অনেক দিন, সেখান থেকেই ওই সেক্টরে কাজ করার আগ্রহ জন্মে। তবে প্র্যাক্টিক্যালি যখন পর্যটন এর খুব কাছাকাছি থাকা শুরু করলাম, আগ্রহের পরিবর্তন ঘটে। এ সেক্টরে কাজ করার মূল আগ্রহটা জন্মে এটা ভেবে যে এখানে স্বাধীনভাবে নিজের মতো করে কাজ করা যাবে, নিজেই কাজের ক্ষেত্র তৈরি করা যাবে, সেই সঙ্গে অন্য আরও অনেকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যাবে। নিজেকে এ খাতেই থিতু করলাম। আশা করছি এ খাতেই থেকে যাবো।

বাংলানিউজ: ক্যারিয়ার হিসেবে এটা কেমন?

ইমরানুল: যখন শুরু করেছিলাম, খুব উৎফুল্ল একটা ব্যাপার কাজ করতো। তবে দিন গেলে আস্তে আস্তে বুঝতে পারি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এটা কিছুটা ঝুকিপূর্ণ পেশা। প্রকৃতি, রাষ্ট্র, দুর্ঘটনা যে কোনো ইস্যুতে পর্যটন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা অন্যান্য পর্যটন বান্ধব দেশে অনেকটাই কম থাকে। ক্যারিয়ার হিসেবে খারাপ না, তবে ঝুঁকিগুলো আস্তে আস্তে কমে গেলে ক্যারিয়ার হিসেবে পর্যটন আরও অনেক বেশি সম্ভাবনাময় সেক্টর হয়ে যাবে। সুন্দরবনে জঙ্গল ক্রুজ শিপ।

বাংলানিউজ: এখানে টিকে থাকার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো কি?

ইমরানুল: এ সেক্টরটা বাইরে থেকে অনেক মজাদার মনে হলেও সর্বক্ষেত্রে এমনটা থাকে না। প্রচুর ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে এ খাতে টিকে থাকতে হয়। কিছু চ্যালেঞ্জ প্রাকৃতিক যেমন আবহাওয়া খারাপ হলে পর্যটন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিছু আছে রাষ্ট্রীয় চ্যালেঞ্জ যেমন হুট করে হরতাল-ধর্মঘট কিংবা রাজনৈতিক অরাজকতায় পর্যটনে বাধা পড়ে। আবার নতুনভাবে মহামারি পরিস্থিতিও আমাদের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। রাস্তাঘাট বা দুর্ঘটনাজনিত চ্যালেঞ্জও রয়েছে।
এছাড়াও পর্যটকদের ভ্রমণের স্থান বা ধরনের প্রতি নিয়মিত রুচির পরিবর্তন হয়, এটাও এক প্রকার চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জগুলোর কিছুটা আমাদের হাতে থাকলেও বেশিরভাগই আমাদের হাতে থাকে না।

বাংলানিউজ: কি কি প্রজেক্ট আছে সারাদেশে?

ইমরানুল: আমাদের এখন আলহামদুলিল্লাহ বেশ কিছু প্রজেক্ট রয়েছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। সেন্টমার্টিনে রয়েছে নোনাজল বিচ রিসোর্ট, সাজেকে রয়েছে- লুসাই কটেজ টিজিবি, আদ্রিকা ইকো কটেজ, ছাউনি ইকো কুটির, তরুছায়া ইকো কটেজ, ফুডাংকি রেস্টুরেন্ট, এফ এন এফ রেস্টুরেন্ট (খাগড়াছড়ি)। সুন্দরবনে রয়েছে জঙ্গল ক্রুজ শিপ, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে রয়েছে টিলাগাঁও ইকো ভিলেজ, টাংগুয়া হাওরে রয়েছে সিন্দাবাদ তরী, বান্দরবানে রয়েছে টিজিবি এক্সপ্রেস (চান্দের গাড়ি)। ইমরান ও তার সঙ্গে পর্যটকরা।

বাংলানিউজ: এ দীর্ঘ কর্মযজ্ঞ কি আপনার একার প্রচেষ্টায়?

ইমরানুল: আমার কোম্পানি ট্যুর গ্রুপ বিডি বা টিজিবি নামে যাকে সবাই চেনে, আমাদের সব প্রজেক্ট এ কোম্পানির নামেই পরিচালিত হয়ে থাকে। কোম্পানির বাকি দুই অংশীদার বন্ধু রাহি রাফসান ও আরিফুর রহমান রিমন। তবে আমাদের সব স্থাপনা এবং অফিসিয়াল কার্যক্রম মিলে ১০০ জনের ওপর মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রয়েছে। সবাই মিলেই আমরা চেষ্টা করছি।

বাংলানিউজ: শুরুটা কবে?

ইমরানুল: ২০০৯ সালে বন্ধুরা মিলে গ্রুপের শুরু করেছিলাম যা পরবর্তীতে ২০১৪ সালে আমরা বাণিজ্যিক রূপে শুরু করি। এখন পর্যন্ত আমাদের গ্রুপ থেকে ১০০০ এরও বেশি ট্রিপ হয়েছে, সেই সঙ্গে আমাদের বিভিন্ন স্থাপনায় নিয়মিত ট্রিপ হচ্ছে এর বাইরেও। সবমিলিয়ে ১৬ হাজার থেকে ১৭ হাজার পর্যটককে আমরা সরাসরি ট্রিপ আয়োজনের মাধ্যমে সেবা দিয়েছি। এছাড়া আমাদের সব স্থাপনায় প্রতি বছর লক্ষাধিক মানুষের সেবা দিয়ে থাকি। শূন্য হাতেই শুরু করেছিলাম আমরা, পুঁজি ছিল কেবল অভিজ্ঞতা। এখন টিজিবির চার কোটি টাকার মতো স্থাপনা রয়েছে। সাজেকের আদ্রিকা ইকো কটেজ।

বাংলানিউজ: এ খাতের নতুনদের প্রতি পরামর্শ কি থাকবে?

ইমরানুল: নতুনরা যত এই সেক্টরে আসবে, ততই এই সেক্টর আরও বেশি প্রস্ফুটিত হবে, আরও নতুন নতুন ধারণা আসবে, নতুনভাবে কাজ হবে। তাই নতুনদের এ সেক্টরে আসা দরকার, বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণরা। কারণ কোনো খাতের আমূল পরিবর্তন করতে গেলে বা উন্নতি করতে গেলে ডাইমেনশনাল কাজ প্রয়োজন।  তবে কোনো ভাবেই লক্ষ্য স্থির না করে এ সেক্টরে নামা উচিত না। অবশ্যই এ সেক্টর নিয়ে জেনে-শুনে আসতে হবে এবং সততার সঙ্গে লেগে থাকার বা পরিশ্রম করার মানসিকতা নিয়ে আসতে হবে। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার, এ সেক্টরের ঝুঁকিগুলো নিয়ে পড়াশোনা এবং মাঠ পর্যায়ে জেনে-শুনে কাজ শিখে আসতে হবে।

ইমরানুল আলম ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছেলে।  জন্ম এবং বেড়ে উঠা সেখানেই। স্থানীয় উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকায় তিতুমীর কলেজ এ স্নাতক  এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পাস করেন। বাবা মো. আশরাফুল আলম সরকারি চাকরি করতেন এবং তার চাওয়া ছিল ছেলেও যেনো সরকারি চাকরি করে। কিন্তু তা আর হয়ে উঠলো না। ছেলে হয়ে উঠলো পেশাদার ঘুরন্দাজ।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৯, ২০২১
এসএইচডি/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।