ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৪ আশ্বিন ১৪৩২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭ রবিউস সানি ১৪৪৭

মুক্তমত

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সহায়তা আরো সহজ করা প্রয়োজন

নিরঞ্জন রায়, সৌজন্য: কালের কণ্ঠ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:০০, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৫
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সহায়তা আরো সহজ করা প্রয়োজন নিরঞ্জন রায়

বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি দেশের ব্যবসায়ীদের নীতি সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে একটি নীতিমালা জারি করেছে। ইতোপূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের কিছু বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, বিশেষ করে বৃহৎ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ ঋণ পুনঃ তফসিল সুবিধা দিয়েছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ ঋণ পুনঃ তফসিল সুবিধার তুলনায় এই নীতি সহায়তা কিছুটা বিস্তৃত পরিসরে গৃহীত হয়েছে, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে (১) নীতি সহায়তাপ্রাপ্তির যোগ্যতা, (২) নীতি সহায়তার ধরন ও প্রকৃতি, (৩) বিশেষ ঋণ পুনঃ তফসিল সুবিধা, (৪) বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারজনিত ক্ষতির প্রেক্ষিতে নীতি সহায়তা, (৫) বিশেষ ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা, (৬) বিশেষ ঋণ স্থানান্তর বা এক্সিট সুবিধা এবং (৭) নীতি সহায়তা গ্রহণের জন্য আবেদনের প্রক্রিয়া ও অযোগ্যতা।

বিশেষ ঋণ পুনঃ তফসিল সুবিধা এবং নীতি সহায়তা, উভয়ই দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে গৃহীত হলেও দুটো ব্যবস্থার মধ্যে কিছু সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান।

প্রথমত, বিশেষ ঋণ পুনঃ তফসিল ছিল খুবই সীমিত পরিসরের একটি সুবিধা, যেখানে ঋণের অর্থ পরিশোধ এবং ভালো রাখার বিষয়টি উল্লেখ আছে। সেদিক থেকে নীতি সহায়তার আওতায় কিছু বর্ধিত সুবিধা রাখা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ঋণ পুনঃ তফসিল সুবিধার আওতায় নতুন ঋণ প্রদানের কোনো বিধান ছিল না, কিন্তু নীতি সহায়তায় সেই সুযোগ রাখা হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে নীতি সহায়তা প্রদানের সার্কুলার জারির পর ঋণ পুনঃ তফসিল সুবিধা এই নীতিমালার একটি অংশ হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সহায়তা আরো সহজ করা প্রয়োজননীতি সহায়তা সার্কুলারে কিছু সীমাবদ্ধতা এবং অসামঞ্জস্যতা লক্ষ করা গেছে। প্রথমত, নীতি সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে যারা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সরবরাহ বিঘ্ন এবং মুদ্রার অস্বাভাবিক অবমূল্যায়নের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা এই নীতি সহায়তা পাবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সরবরাহ বিঘ্নের বিষয়টি এতটাই বিষয়ভিত্তিক (সাবজেক্টিভ) যে এটা কাগজপত্রের মাধ্যমে প্রমাণ করা কঠিন। ফলে এ বিষয় নিয়ে গ্রাহক এবং ব্যাংকারদের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হবে এবং অনেকেই এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।

দ্বিতীয়ত, এই নীতি সহায়তার অধীনে ঋণ পুনঃ তফসিল সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে তাদেরকে, যাঁরা ইতোপূর্বে কখনো ঋণ পুনঃ তফসিল সুবিধা গ্রহণ করেননি। এই অগ্রাধিকার প্রদানের কারণে একজন ব্যবসায়ী আগে ঋণ পুনঃ তফসিল সুবিধা নেননি ঠিকই, কিন্তু তাঁর বর্তমান ব্যবসার অবস্থা একেবারেই শোচনীয়, অর্থাৎ বন্ধ হয়ে গেছে, অথচ তিনি এই নীতি সহায়তা আগে পাবেন। পক্ষান্তরে একজন ব্যবসায়ী আগে ঋণ পুনঃ তফসিল সুবিধা গ্রহণ করে তাঁর ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন এবং একটু সহযোগিতা পেলে সমস্যা কাটিয়ে আরো ভালো করতে পারবেন, অথচ তিনি এই নীতি সহায়তা পাবেন অন্যদের পরে বা একেবারেই পাবেন না শুধু অগ্রাধিকারের তালিকায় নিচে থাকার কারণে। এর অর্থ দাঁড়ায় যে যারা ব্যংকের ঋণ নিয়ে অর্থ অন্যত্র সরিয়ে ফেলেছেন, তাঁরাই এই নীতি সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবেন। পক্ষান্তরে যাঁরা আগে ঋণ পুনঃ তফসিল সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে কষ্ট করে ব্যবসা চালু রেখে সংকটে থাকলেও তাঁরা নীতি সহায়তা গ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকবেন।
ঋণ পুনঃ তফসিল সুবিধার সর্বোচ্চ মেয়াদ এবং ডাউন-পেমেন্টের শর্ত আরো কঠোর করা হয়েছে। ঋণ পুনঃ তফসিল সুবিধার শর্ত হিসেবে ২% ডাউন পেমেন্টের বিধান রাখা হয়েছে, যা পূর্বের বিশেষ ঋণ পুনঃ তফসিলের ক্ষেত্রে ছিল মাত্র ১%। শুধু তা-ই নয়, যেসব ব্যবসায়ী আগে তিন বা ততোধিক ঋণ পুনঃ তফসিল সুবিধা নিয়েছেন, তাঁদের অতিরিক্ত ১% ডাউন পেমেন্টের অর্থ জমা দিতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা যদি সমস্যায় থাকনে, তাহলে তাঁরা এই ডাউন পেমেন্টের বিশাল অর্থ সংগ্রহ করবেন কিভাবে। যাঁরা সমস্যায় নেই এবং যাঁদের অর্থ আছে, তাঁদের তো আর নীতি সহায়তার প্রয়োজন নেই। যাঁদের সমস্যা এবং আর্থিক সংকট আছে, তাঁদের জন্য নীতি সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ নিয়ে তাঁদেরই বলা হচ্ছে অর্থ পরিশোধের জন্য। বিষয়টা কিভাবে কাজ করবে, তা আমার কাছে মোটেই বোধগম্য নয়। একইভাবে নীতি সহায়তার আওতায় ঋণ পুনঃ তফসিলের সর্বোচ্চ মেয়াদ করা হয়েছে ১০ বছর, যা পূর্বের বিশেষ ঋণ পুনঃ তফসিল সুবিধার ক্ষেত্রে ছিল ১৫ বছর। এর ফলে ঋণ পরিশোধের মাসিক বা ত্রৈমাসিক কিস্তির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে ঋণ পুনঃ তফসিল করা ঋণের কিস্তির পরিমাণ যদি একজন ব্যবসায়ীর ব্যবসা থেকে প্রাপ্ত নগদ প্রবাহের থেকে বেশি হয়, তাহলে সেই ব্যবসায়ী ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সেই কিস্তি পরিশোধ করতে পারবেন না।

ঋণ পুনঃ তফসিলের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মেয়াদ এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়, যাতে মাসিক বা ত্রৈমাসিক কিস্তির পরিমাণ ঋণগ্রহীতার নগদ প্রবাহ থেকে কম হয়। আমেরিকা-কানাডায় মর্টগেজ ঋণের সর্বোচ্চ মেয়াদ ছিল ২৫ বছর। কিন্তু বছর দুয়েক আগে সুদের হার অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় কিস্তির পরিমাণ দিয়ে ঠিকমতো ডেট সার্ভিসিং হচ্ছিল না। ফলে অধিকাংশ ঋণগ্রহীতা খেলাপি হতে বসেছিল। এই অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে এখানকার ব্যাংকগুলো ঋণ পরিশোধের সর্বোচ্চ মেয়াদ নিয়মবহির্ভূত হওয়া সত্ত্বেও ২৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩৫ বছরে নির্ধারণ করে। এর ফলে ঋণের কিস্তির পরিমাণ কম হওয়ায় ঋণগ্রহীতারা খুব সহজে তা পরিশোধ করে খেলাপি হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়। সাম্প্রতিক সময়ে উন্নত বিশ্বের ব্যাংকের গৃহীত এই পদক্ষেপ নিয়ে কোথাও কোনো রকম উচ্চবাচ্য নেই। এমনকি মানুষ বিষয়টি ভালোভাবে জানেও না। ঋণের মেয়াদ বা টার্ম নির্ধারণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ঋণের মেয়াদ সংক্ষিপ্ত হলে আপাতদৃষ্টিতে ভালো মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে এর মাধ্যমে ঋণগ্রহীতাকে খেলাপির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়। পক্ষান্তরে ঋণের মেয়াদ দীর্ঘ হলে আপাতদৃষ্টিতে খারাপ মনে হলেও ঋণগ্রহীতাকে ঋণ পরিশোধে উৎসাহিত করা হয়। কী কারণে যেন বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের মেয়াদ নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বিবেচনায় নিতে চায় না, তা সে নীতি সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রেই হোক, আর অন্য যেকোনো ঋণের নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রেই হোক না কেন।

নীতি সহায়তা প্রদানের নীতিমালায় নতুন ঋণ প্রদানের কথা বলা হলেও তা পরিষ্কার করা হয়নি। বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট করে উল্লেখ করা প্রয়োজন। কেননা নতুন ঋণ না পেলে ব্যবসা চালু রাখা সম্ভব হবে না। ফলে নগদ প্রবাহ বিঘ্নিত হবে এবং ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। একইভাবে সুদের হারের বিষয়টি একেবারেই উল্লেখ নেই। যত ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হোক না কেন, উচ্চ সুদের হার বহাল থাকলে কোনো ব্যবসায়ীর পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়। যদি সরাসরি স্বল্প সুদের হারে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা না করা যায়, তাহলে বিকল্প ব্যবস্থার আশ্রয় নিতে হবে। সেটি কিভাবে সম্ভব, তা একটি ভিন্ন বিষয় বিধায় এখানে আলোচনার সুযোগ নেই। আরো একটি বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, এই নীতি সহায়তা প্রদানের সময়সীমা, যা ৯ মাস থেকে এক বছর করা হয়েছে। অথচ ব্যবসায়ীদের অবস্থা এতটাই নাজুক যে তাঁরা এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করলে তাঁদের অবস্থা আরো খারাপ হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সহায়তা একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু এর সীমাবদ্ধতা এবং অসংগতিগুলো দূর করে খুব সহজ, স্ট্রেট ফরোয়ার্ড এবং সাধারণভাবে নীতিমালার শর্তগুলো নির্ধারণ করতে না পারলে এ থেকে ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন না। ফলে উদ্যোগটি একটি কাগুজে পদক্ষেপ হয়েই থাকবে। আমাদের প্রত্যাশা, বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়গুলো বিবেচনা করবে।

লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।