ঢাকা, শুক্রবার, ১১ আশ্বিন ১৪৩২, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৩ রবিউস সানি ১৪৪৭

মুক্তমত

নির্বাচনের আগে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা জানান

আবু তাহের খান, সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ |
আপডেট: ১০:১৭, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৫
নির্বাচনের আগে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা জানান আবু তাহের খান

অন্তর্বর্তী সরকারের দেওয়া ঘোষণা অনুযায়ী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে দেশে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। সে অনুযায়ী যদি ওই সময়ের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে নতুন সরকারকে দায়িত্ব গ্রহণের তিন মাসের মধ্যেই জাতীয় সংসদে ২০২৬-২৭ অর্থবছরের বাজেট পেশ করতে হবে।

কিন্তু বাজেট প্রণয়নের প্রস্তুতিমূলক কাজ অনেক আগেই শুরু করতে হয়, অন্তত চার-পাঁচ মাস আগে থেকেই শুরু করতে হয়। সেই হিসেবে আগামী সরকারের হাতে সময় থাকবে খুবই কম।

তাদের প্রথম বাজেট প্রণয়নের কাজটি পর্যাপ্ত সময় নিয়ে গুছিয়ে প্রণয়নের সুযোগ প্রায় থাকছে না বললেই চলে।

তার মানে কি এই যে আগামী সরকার তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের যাত্রা শুরুই করবে একটি অগোছালো অবস্থার মধ্য দিয়ে? এ প্রশ্নের জবাব হ্যাঁ বা না দুটোই হতে পারে। আসন্ন নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের ব্যাপারে যাঁরা আশাবাদী তাঁরা যদি তাঁদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনাবিহীন বর্তমান অবস্থানেই স্থির হয়ে বসে থাকেন, তাহলে নিশ্চিতভাবেই তাঁদের যাত্রা শুরু হবে এলোমেলো ও অগোছালোভাবে। অন্যদিকে যাঁরা ক্ষমতায় যাবেন বা যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাঁরা যদি এখন থেকেই ২০২৬-২৭ অর্থবছরের বাজেটসহ তাঁদের সম্ভাব্য মেয়াদকালের পুরো অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে ভাবতে শুরু করেন, তাহলে আগামী বাজেটের জন্য মাত্র তিন মাস সময় পেলেও তাঁদের জন্য সেটি সমস্যার কোনো কারণ হবে না।

প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁরা এখন কোন পথে এগোবেন?
অনাস্থা ভোটে পরাজয়, অর্থনৈতিক বিপর্যয় মোকাবেলা করতে না পারা, জোট সরকারের ক্ষেত্রে শরিকি বিবাদ—এমনি নানা কারণে মাঝপথে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘটনা পৃথিবীর প্রায় সব গণতান্ত্রিক দেশেই রয়েছে। আর উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এটি একটি খুবই মামুলি ব্যাপার এবং এতে তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় কখনোই ব্যাহত হয় না। কারণ সেসব দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রায় প্রত্যেকেরই সরকার পরিচালনার লক্ষ্যে আগে থেকেই খাত, দপ্তর বা মন্ত্রণালয়ভিত্তিক প্রস্তুতি থাকে। উদাহরণস্বরূপ কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বাধীন ব্রিটেনের বর্তমান শ্রমিক দলীয় সরকারের যদি কোনো কারণে আকস্মিক পতন ঘটে এবং সে ক্ষেত্রে ঋষি সুনাকের নেতৃত্বাধীন রক্ষণশীল সরকার যদি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসে, তাহলে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় এক মুহূর্তের জন্যও কোনো শূন্যতা সৃষ্টি হবে না (স্টারমার সরকারের পতন কামনা করা হচ্ছে না)।

কারণ বিরোধী দলে থাকা অবস্থায়ও উল্লিখিত উভয় দলেরই ছায়া মন্ত্রিসভা থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে? ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তাদের যতটা ব্যস্ত দেখা যায়, বক্তব্য-বিবৃতি পাওয়া যায় অন্যান্য বিষয়ে ততটা স্পষ্ট বক্তব্য বা চিন্তাভাবনার কথা জানা যায় না।

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন ব্যাপক রাজস্ব ঘাটতি, অতি উচ্চমাত্রার পরিচালন ব্যয় (রাজস্ব ব্যয়ের প্রায় ৪৩%), অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিরাজমান নিম্ন প্রবৃদ্ধির হার, মূলধনী যন্ত্রপাতির নিম্ন আমদানি, বৈদেশিক ঋণের অসহনীয় মাত্রার কিস্তির বোঝা, কৃষি ও অন্যান্য খাতে বিরাজমান ছদ্ম বেকারত্ব, খেলাপি ঋণের পাহাড়সম উচ্চতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ইত্যাদির মতো নানা জটিল সমস্যায় ভুগছে। এসব সমস্যা মোকাবেলায় দলগুলো আসন্ন বাজেটে বা সামনের দিনগুলোতে কী ব্যবস্থা নেবে, তা নিয়ে তারা কী ভাবছে, তা দেশবাসীর জানার অধিকার আছে। আসন্ন নির্বাচনের নির্বাচনী ইশতেহারে এসব তুলে ধরতে হবে।

বাংলাদেশের সমাজে আয় ও সম্পদবৈষম্য এখন অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় অধিকতর প্রকট এবং ক্রমেই তা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। আর রাষ্ট্রের ভ্রান্ত অর্থনৈতিক নীতির কারণে সৃষ্ট এ বৈষম্য শুধু একক কোনো সরকারের দ্বারা সৃষ্টি হয়নি। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রতিটি সরকারই এর জন্য কমবেশি দায়ী। বস্তুত এই সরকারগুলো তাদের গোষ্ঠীপ্রীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে নিজ নিজ কার্যকালে এমনসব অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেছে, যেগুলো বৈষম্য সৃষ্টির পথ করে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশের করনীতির কথাই ধরা যাক। বিপুল রাজস্ব ঘাটতির কারণে সরকারকে প্রায়শই বাড়তি কর আহরণের পথে হাঁটতে হচ্ছে, যা মোটেও দোষের কিছু নয়। কিন্তু দোষের বিষয় হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে তাঁরা সম্পদশালীদের ওপর প্রত্যক্ষ কর না বাড়িয়ে পরোক্ষ কর আরোপের মাধ্যমে চড়াও হচ্ছেন সাধারণ জনগণের ওপর। আর তাতে একদিকে যেমন তাৎক্ষণিকভাবে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের ওপর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে এবং দিন দিনই তাদের কষ্ট ও দুর্ভোগের পরিসর বাড়ছে, অন্যদিকে তেমনি অতি দ্রুতলয়ে তৈরি হচ্ছে সম্পদের বৈষম্যমুখী মেরুকরণ।

সম্পদ মেরুকরণের উপরোক্ত ধারা অব্যাহত থাকলে কোনো সন্দেহ নেই যে এ রাষ্ট্র অচিরেই গুটিকতক মানুষের একচেটিয়া রাজত্বে পরিণত হবে, যার অধিকাংশ লক্ষণ এরই মধ্যে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। আর সে রাষ্ট্রে সাধারণ মানুষের ভূমিকা হবে বিত্তবানের জন্য সম্পদের জোগানদাতা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী শোষিত প্রজার। বিষয়টি আমাদের রাজনীতিকরা বোঝেন না মোটেও তা নয়। কিন্তু এই চিত্র বদলের ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ তেমন দেখা যায় না। আশা করব যে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচন-পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও কর্মসূচিগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরবেন, যা থেকে বোঝা যাবে, তারা বিদ্যমান ব্যবস্থায় কী ধরনের পরিবর্তন আনতে চান।

দেশের সাধারণ মানুষের চিন্তাভাবনা ও হতাশার স্তর সর্বশেষ পর্যায়ে কোথায় নেমেছে, তা বোঝার জন্য বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (বিইআই) কর্তৃক সর্ব সম্প্রতি পরিচালিত জরিপের ফলাফল থেকে একটিমাত্র অনুষঙ্গ এখানে তুলে ধরছি। দেশে বিরাজমান পরিস্থিতির বিষয়ে ‘নাগরিকদের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি’ শীর্ষক উক্ত জরিপে ‘বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের চাহিদা ও সমস্যার প্রতি কতটা মনোযোগী’—এসংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে ৮৮ শতাংশ উত্তরদাতাই বলেছেন, রাজনীতিকরা এ ব্যাপারে যথেষ্ট মনোযোগী নন। আসন্ন নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় যাঁরা যাবেন, তাঁদের কাছে আমরা ভিন্নধারা বা ইতিবাচক পরিবর্তনের অঙ্গীকার শুনতে চাই। রাজনীতিকরাই এখন বলুন, আপনারা দেশ ও জনগণের ভবিষ্যৎ তথা তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনযাপন নিয়ে কী ভাবছেন।

লেখক: অ্যাডজাংকট ফ্যাকাল্টি, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।