রাষ্ট্রব্যবস্থার গুণে-মানে নেপালের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাংলাদেশের চেয়ে সমৃদ্ধ নয়। কাঠমাণ্ডুর রাজনৈতিক ক্যায়স, সময়ে অসময়ে সরকার পতন বা বদলের ঘটনা ঢাকার চেয়ে কদাকার।
নেপালে আন্দোলনের ফ্রন্টলাইনার ছাত্ররা এই কয়েক দিনের মধ্যেই পড়ার টেবিলে ফিরে গেছে। ক্ষমতার শরিক হয়নি। লুটপাট, চাঁদাবাজি, মব, খবরদারির শরিক হয়নি। তারা ক্ষমাও চেয়েছে আন্দোলনের কয়েকটা দিন ধ্বংস, আগুন ও জনজীবন বিপন্নের জন্য।
নতুন সরকারপ্রধান জেন-জি শিক্ষার্থীদের এই মনোভাব ও ভূমিকার মর্যাদা দিয়েছেন। রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় তাদের শরিক রেখেছেন। সেখানকার অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি নোবেলজয়ী নন। তবে ক্ষমতা নেওয়ার প্রশ্নে প্রতিক্রিয়া ছিল, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার স্বাদ নেওয়ার ইচ্ছা তাঁর নেই। তারুণ্যের দাবি তিনি ফেলতে পারেননি বলেই দায়িত্বটা নিয়েছেন।
আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বয়ানও এমনই ছিল। তফাত হচ্ছে তিনি মুখ খুলে বলে ফেলেছেন, ছাত্ররা তাঁর নিয়োগকর্তা। শ্রীলঙ্কার সুশীলার নিয়োগকর্তাও আন্দোলনকারী ছাত্ররাই। কিন্তু তারা বাংলাদেশের সমন্বয়কদের মতো সরকারের উপদেষ্টা হননি, রাষ্ট্র পরিচালনার কঠিন জোয়াল কাঁধে নেননি।
বিষয়টির মধ্যে নিয়োগকারী-নিয়োগপ্রাপ্ত উভয়ের জন্যই শিক্ষার বিষয়-আশয় রয়েছে। হয়ে থাকতে পারে, বাংলাদেশের বছরখানেকের নমুনা দৃষ্টে অভিজ্ঞতা নিয়েছে সেখানকার অন্তর্বর্তী সরকার, তার নিয়োগকর্তাসহ রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার অংশীজনরা। সুশীলা শপথ নিয়েই ভোটের তারিখ জানিয়ে দিয়েছেন। ছাত্রদের আয়ত্তে রেখেছেন, কিন্তু ভরসা করেননি। ক্ষমতার পার্টনার করেননি। ছাত্ররাও তা হতে চায়নি। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়নি। মবে নামেনি। শিল্প-কারখানার চাকা বন্ধের ক্রিয়াকর্মও সেখানে হয়নি। চমৎকার বোঝাপড়া ও পরিণতির একটি কেমিস্ট্রি কাজ করেছে তাদের মধ্যে। গুম-খুন, আয়নাঘর, দেশের অর্থ বিদেশে পাচার, বেগমপাড়ার অধিবাসী হওয়া, নির্বাচনী ব্যবস্থা বরবাদ, সর্বত্র দলীয়করণের রোগ বাংলাদেশের মতো না থাকলেও দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির অভিযোগ নেপালের উজির-নাজিরদের বিরুদ্ধেও ছিল।
সংগত নানা কারণেই বাংলাদেশের মতো সংস্কার-বিচারসহ কিছু বিষয় নেপালে আবশ্যক হয়ে ওঠেনি। আয়নাঘর, গুম, ক্রসফায়ার, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর প্রধান কোতোয়ালদের ওপর আমেরিকান নিষেধাজ্ঞা, নিশি ভোট, ডামি ভোট থাকলে হয় তো এগুলো তাদের দেশেও জরুরি হতো। তাই সংস্কার-বিচারকে নির্বাচনের পূর্বশর্ত করে সামনে নিয়ে আসা, ঐকমত্যের নামে সিরিজ দেনদরবার পর্বে তাদের যেতে হয়নি। চর্চাগত দিক থেকে আমরা ভাগ্যাহত।
মন্দ রেওয়াজে বেশি অভ্যস্ততা আমাদের। নেপাল-বাংলাদেশের আগে শ্রীলঙ্কায়ও প্রায় একই ধাঁচের বিপ্লব হয়েছে। তার কয়েক দিনের মধ্যে সেখান থেকে দুর্নীতি অনেকটাই ‘নাই’ হয়ে গেছে। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে দ্রুত। ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের জেরে প্রায় দেউলিয়া হতে বসা দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার সার্বিক পরিস্থিতি এখন অনেকটাই স্থিতিশীল।
খাদ্য ও জ্বালানির সংকট কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও এখন ঊর্ধ্বমুখী। বাংলাদেশে বিপ্লবের কয়েক দিনের মধ্যে বিপ্লবই শুধু ‘নাই’ হয়ে যায়নি। ‘নাই’ হয়ে গেছে সিলেটের সাদা পাথর, জনতার আবেগ, নেতাদের বিবেক, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের অনেকের জবাবদিহি। আর ব্যবসা-বিনিয়োগ রীতিমতো চাঙ্গে।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি কেসস্টাডি হিসেবে এক অর্থে নেপালের ইন্টেরিমের জন্য শিক্ষণীয় হয়েছে। যে কারণে সুশীলার ইন্টেরিম বাংলাদেশের পথে হাঁটছে না। নির্বাচন, রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা শিথিল রাখা, অর্থনীতির গতি সঞ্চারণকে টপ প্রায়োরিটি দিয়েছে তাঁর সরকার।
নিন্দা-বিবৃতি পর্বে মাথা দিচ্ছে না। আবার প্রশংসায়ও গা ভাসাচ্ছে না। শোনাচ্ছে না উন্নয়ন-বিনিয়োগের চমকিত গল্পও। তারা মবে আশকারা না দেওয়ায় মবই ঘটেনি। তাই মব দমানোর হুংকারও দিতে হচ্ছে না। জাতীয় নির্বাচনের আগে ডাকসু-জাকসুর মতো ছাত্রসংসদ নির্বাচন আয়োজন করে বাড়তি যন্ত্রণাও নিচ্ছে না। নেপালের জেন-জি তরুণরা নতুন প্রধানমন্ত্রীর শপথের দিনই জাতীয় নির্বাচনের তারিখ আদায় করে নিয়েছে। বাংলাদেশের জেন-জি তরুণরা সেদিকে যায়নি। ছোট-বড়-মাঝারি সংস্কার ও বিচার সেখানেও হবে। কিন্তু এখানকার মতো ঘটা আওয়াজ-আয়োজন নেই।
মাত্রাগতভাবে বাংলাদেশের মতো চণ্ডাল দশা না হলেও চরম রাজনৈতিক সংকটের মধ্যেই নেপালের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি। রাজনীতি-অর্থনীতির পালস বুঝে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আগামী বছরের ৫ মার্চ দেশটিতে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ৭৩ বছর বয়সী সুশীলা নেপালের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। এর আগে জেন-জি প্রজন্মের তরুণদের ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে দেশটির প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির পদত্যাগের পর দেশটিতে রাজনৈতিক সংকট আরো ডালপালা ছড়ায়। অনেকটা বাংলাদেশের কার্বন কপির মতো ওই সংকট সমাধানে বিক্ষোভকারী তরুণদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দফারফা হয় সেনাপ্রধান অশোক রাজ সিগদেলসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের।
ৎপ্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহিষ্ণু’ অবস্থান নিয়ে আলোচিত ছিলেন সুশীলা। ওই অবস্থানের কারণেই অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান হিসেবে তাঁর নাম প্রস্তাব করে বিক্ষোভকারী তরুণরা। সুশীলাকে সরকারপ্রধান মনোনয়নে বাংলাদেশের ছায়া থাকলেও তাঁর এগিয়ে চলায় বাংলাদেশের সঙ্গে বৈপরীত্ব।
বাংলাদেশ থেকে বিপরীত শিক্ষাটাই তিনি নিয়েছেন। জাতির উদ্দেশে প্রথম ভাষণে তিনি আন্দোলনে প্রাণ হারানো যুবকদের শহীদের মর্যাদা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। হিংসায় যারা মদদ দিয়েছে, তাদেরও ছাড়া হবে না। ভাঙচুর-লুটপাটে জড়িতদের কোনোভাবেই রেয়াত করা হবে না। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হবে। আইনমাফিক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।
বিক্ষোভকালে ঘটে যাওয়া হত্যা, হিংসা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের ঘোষণা দিয়েছেন। প্রতিবাদের ছদ্মবেশে ৯ সেপ্টেম্বর কাঠমাণ্ডু এবং সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি সম্পত্তির ওপর হামলা একটি বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ বলে অভিমতে পরিষ্কার করেছেন।
বাংলাদেশেরও শিক্ষা নেওয়ার সময় ফুরিয়ে যায়নি। এখানকার সরকার, ফ্যাসিস্ট বিতাড়নের ফ্রন্টলাইনারসহ আরো অনেকের জন্য কাঠমাণ্ডু থেকে শিক্ষা নেওয়ার সময় এখনো অবশিষ্ট আছে। কারো কারো মতে, নেপালে দুর্নীতি কম, টাকা পাচার কম, স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক দখলদারি কম। তাই দ্রুত নির্বাচনের তারিখ দেওয়া সম্ভব হয়েছে সেখানে। বাংলাদেশে ঐতিহ্যগতভাবে বিরোধ বেশি, সত্য। সময়ও তো যথেষ্ট গড়িয়েছে। ফিতনা-ফ্যাসাদ, খুঁটিনাটি কমালে সামনের বাকিটা সময় কাজে লাগানোর যথেষ্ট সুযোগ এখানেও রয়েছে। সে জন্য দরকার প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্তের। যেকোনো মূল্যে বাংলাদেশপন্থী রাজনীতিটা রক্ষা করা। যেমনটি করে চলছে নেপাল।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
এসআই