ঘটনাটি বেশি দিন আগের নয়, মাত্র ৩১০০ বছর আগের। আল কোরআন ও বাইবেলের এবং ওল্ড টেস্টামেন্টে অসাধারণভাবে কাহিনিটির বর্ণনা রয়েছে।
মজলুমরা ছিল ভীষণ ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত। তারা নদীর টলটলে পানি দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ল এবং পাগলের মতো দৌড়ে নদীর পানে ছুটল তৃষ্ণা নিবারণের জন্য। মজলুমদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্বাচিত নেতা তালুত যাকে হিব্রু বাইবেলে সল বলে ডাকা হয় তিনি মজলুমদের বললেন খবরদার! নদীর পানি পান করবে না। আল্লাহ নিষেধ করেছেন। কিন্তু তৃষ্ণার্তদের বেশির ভাগই আল্লাহর হুকুম অমান্য করল এবং নদীর পানি খেয়ে ঘটনাস্থলে মারা গেল।
উল্লিখিত কাহিনির মধ্যে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি যা নিয়ে আজকের নিবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করব এবং সেই ঘটনার সঙ্গে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট পরবর্তী ঘটনার কী মিল রয়েছে, তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব। তার আগে তালুত ও জালুতের কাহিনি বলে নিই। আমরা সবাই বাদশাহ সুলেমান যার বাইবেলিক নাম সলমন তাঁকে সবাই চিনি। কারণ খ্রিস্টের জন্মের প্রায় এক হাজার বছর আগে আজকের জেরুজালেম-সিরিয়া-লেবাননসহ বিস্তীর্ণ ভূমিতে তিনি যে সাম্রাজ্য পরিচালনা করতেন তার জৌলুস সব রূপকথার গল্পকে হার মানায়। বাদশাহ সুলেমানের পিতা ছিলেন হজরত দাউদ (আ.) বা ডেভিড আর তাঁর শ্বশুরের নাম ছিল তালুত বা সল। আমি যে সময়ের কাহিনি বলছি তার শুরুটা তালুতকে নিয়ে।
বনি ইসরায়েল জাতির লোকেরা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের রাজা জালুত দ্বারা মারাত্মকভাবে নিগৃহীত ও অত্যাচারিত হচ্ছিল কয়েক যুগ অবধি। আর এই সময়টিতে তারা ছিল ভীতসন্তস্ত্র অসংগঠিত এবং নেতৃত্ববিহীন। নিজেদের পাপাচার, অবাধ্যতা এবং কলহবিবাদের কারণে আল্লাহ তাদের প্রতি ছিলেন বিরক্ত। ফলে তাদের মধ্যে থেকে নেতৃত্বের গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ উঠিয়ে নিয়েছিলেন। ফলে জালুতের সৈন্যরা যখন বনি ইসরায়েলিদের আক্রমণ করত তখন তাদের বাধা দেওয়া তো দূরের কথা সহায়সম্পদ, স্ত্রী-কন্যা নিয়ে নিরাপদে পালানোর অবস্থা ছিল না। ফলে জালুত বাহিনী তাদের ইচ্ছামতো খুনজখম-লুটতরাজ, ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি জুলুম-অত্যাচার তো করতই উল্টো যাওয়ার সময় ইচ্ছামতো লোকজনকে দাসদাসীরূপে বন্দি করে নিয়ে যেত।
জালুতের ক্রমাগত অত্যাচারে বনি ইসরায়েলিরা হতদরিদ্র, বিশৃঙ্খলা, অসহায় এবং মজলুম জাতিতে পরিণত হয়ে আল্লাহর দরবারে প্রতিকারের জন্য অনবরত কাঁদতে আরম্ভ করল। তারা সেই যুগের নবী হজরত স্যামুয়েল (আ.)-এর কাছে গেল এবং জালুতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন মনোনীত নেতার জন্য দোয়ার দরখাস্ত পেশ করল। হজরত স্যামুয়েল (আ.) নেতা হিসেবে যখন তালুতের নাম বললেন তখন বনি ইসরায়েলিদের পুরোনো অহংকারী স্বভাব প্রকাশ পেল- তারা বলল এ কেমন নেতা! ও তো গরিব আর লিকলিকে পাতলা। বংশও ভালো না এবং আর্থিকভাবে দুর্বল। ও কী করে আমাদের মতো অভিজাত সম্প্রদায়ের নেতা হবে। নবী জানালেন এটাই আল্লাহর হুকুম।
বনি ইসরায়েলিরা উপায়ান্তর না দেখে তালুতকেই নেতা মেনে নিল এবং তাঁর নেতৃত্বে জালুতের বাহিনীকে মোকাবিলা করতে গিয়ে নদীর পানি খেয়ে বেশির ভাগ মারা পড়ল। যারা নেতার নির্দেশ মেনে নদীর পানি পান করেনি তারা ছিল সংখ্যায় অল্প এবং এই অল্পসংখ্যক সঙ্গীসাথি নিয়ে তালুত নদী পার হলেন এবং জালুতের বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করে বিশ্বরাজনীতির এক নতুন অধ্যায় সূচনা করলেন।
উল্লিখিত কাহিনি অধ্যয়ন করতে গিয়ে আমার মনে বারবার প্রশ্ন এসেছে মহান আল্লাহ কেন তৃষ্ণা নিবারণে নদীর পানি পান করতে নিষেধ করলেন। হয়তো নদীর পানি বিষাক্ত ছিল কিন্তু এই ধারণা আমার কাছে খুব বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হতো না। অন্যদিকে আল্লাহ কেন বনি ইসরায়েলি সম্প্রদায়ের বাইরে থেকে তালুককে এনে নেতা নির্বাচন করলেন। এসব বিষয় নিয়ে বহুবার চিন্তা করেছি কিন্তু কূলকিনারা করতে পারিনি। কিন্তু বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পরে সংঘটিত অরাজকতা-বিশৃঙ্খলা, চাঁদাবাজি, খুন-ধর্ষণ, সামাজিক অবিচার, কবর থেকে লাশ তুলে অপমান এবং সেই লাশ পুড়িয়ে ফেলার মতো আদিম বর্বরতা দেখার পর আমার মনে বনি ইসরায়েলিদের দুরবস্থা এবং তালুত জালুতের ঐতিহাসিক কাহিনি নতুন করে সামনে চলে এসেছে।
প্রথমত আমরা সবাই যেভাবে নেতা হতে চাই তা ইতিহাসের পথপরিক্রমায় কখনো সঠিক ছিল না। দ্বিতীয়ত আমরা যেভাবে নিজেদের গোত্র বংশ সম্প্রদায় বা দলের মধ্য থেকে নিজেদের পছন্দমতো নেতা বানিয়ে তার হাতে নিজেদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব তুলে দিই তা-ও হাজার বছরের ইতিহাসে কোনো দেশকালে সফলতা পায়নি। বরং মানুষের এহেন প্রবৃত্তির কারণে অনেক সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙেচুরে চুরমার হওয়ার পর জালুতের মতো বিদেশি হানাদারদের লুটপাটের জন্য অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।
মানবজাতির ইতিহাসে নেতা নির্বাচনের দুটি পদ্ধতি রয়েছে। অশান্তির সময় নেতা অলৌকিকভাবে হাজির হন এবং আপন কর্ম দ্বারা জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করেন। আমাদের দেশের শশাঙ্ক, গোপাল, আলাউদ্দিন হোসেন শাহ প্রমুখ এই শ্রেণির নেতা।
ইউরোপে জুলিয়াস সিজার, হানিবল নেপোলিয়ন বোনাপাট যেভাবে জাতির অন্তিমকালে তলোয়ার হাতে তুলে নিয়েছিলেন তা বিশ্বরাজনীতির মাইলফলক হয়ে রয়েছে। সাম্প্রতিক দুনিয়ায় বুরকিনা ফাঁসোর বর্তমান প্রেসিডেন্ট ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম তারোরে অভ্যুদয় উত্থান এবং সফলতা বিশ্লেষণ করলেই আপনারা বুঝতে পারবেন অশান্তির সময়ে কীভাবে নেতা নির্বাচন হয় এবং সেই নেতার প্রধান শক্তি থাকে তলোয়ার এবং দ্বিতীয় শক্তি থাকে জনগণের বিশ্বাস, ভালোবাসা এবং সমর্থন।
অরাজক ও অশান্তির বাইরে রাজনৈতিক শূন্যতার সময় জনগণের নেতা হওয়ার প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল এবং দীর্ঘমেয়াদি। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রব্যবস্থায় শাসনকর্মে নিয়োজিত রাজনৈতিক ব্যক্তির পরিবারে নেতা বেড়ে ওঠে যেমন পণ্ডিত জওহর লাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব-রাহুল, সোনিয়া-প্রিয়াংকা ছাড়াও পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো-বেনজির ভুট্টো বিলাওয়াল ভুট্টো নওয়াজ-শাহবাজ শরিফ- মরিয়ম শরিফের নাম উল্লেখযোগ্য। আর রাজতন্ত্রে যেমন পরিবারের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই তেমনি পশ্চিমা গণতন্ত্রে দলের বাইরে যাওয়ার সুযোগ থাকে না।
দলের কাঠামো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদির মাধ্যমেই বারাক ওবামা, ক্লিনটন, মার্গারেট থেচার কিংবা লি কুয়ানের মতো নেতা বের হয়ে আসে। সুতরাং নেতা নির্বাচন, নেতা তৈরি কিংবা নেতার আগমনের যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে তার কোনোটির সঙ্গেই আমাদের জুলাই বিপ্লবের নেতাদের কোনো মিল আমি খুঁজে পাইনি। ফলে অনিবার্যভাবে যা হওয়ার কথা ছিল তাই হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে নতুন কিছু হওয়ার জন্য বা নতুন কিছু দেখার জন্য ইতিহাসের অমোঘ নিয়মের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
আলোচনার এই পর্যায়ে এবার বনি ইসরায়েলিদের কাহিনি থেকে আবার ঢুঁ মেরে আসি। নদীর পানি পান করার ঘটনাটি যদি রূপক অর্থে ব্যাখ্যা করি তবে এটাকে চেইন অব কমান্ড এবং অবাধ্যতার শাস্তি হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। অর্থাৎ প্রচণ্ড ক্ষুধা-ক্লান্তি ও তৃষ্ণার সময়ে যারা নেতার হুকুমে অবিচল থাকতে পারে কেবল তারাই প্রতিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হতে পারে এবং এ ধরনের অনুগত দৃঢ়চেতা সৈনিক স্বল্পসংখ্যক হলেও তারা জুলুমবাজ বিশাল বাহিনীকে অনায়াসে পরাজিত করতে সক্ষম।
তৃতীয়ত বনি ইসরায়েলিদের যে অংশটি নেতার নির্দেশ অমান্য করে পানি পান করেছিল তাদের মৃত্যুর ঘটনা প্রমাণ করে যুদ্ধকালীন অবাধ্যদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই অথবা তাদের বেঁচে থাকা অনুচিত। এসব লোক যুদ্ধের সময় লড়াই না করে প্রতিপক্ষের সম্পত্তি-সম্পদ লুটপাটে ব্যস্ত থাকে এবং তাদের কুকর্মের কারণে লড়াকু সৈনিকরা ঠিকমতো যুদ্ধ করতে পারে না। এজন্য যুদ্ধের ময়দানের প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো আনুগত্য, শৃঙ্খলা এবং বিশ্বস্ততা।
উল্লিখিত ঘটনার আলোকে আমরা যদি ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট পরবর্তী বিশৃঙ্খলা-অনাচার-লুটপাট-দুর্নীতি, মব সন্ত্রাস, জালজালিয়াতি, টাকা পাচার ইত্যাদি বিশ্লেষণ করি এবং সাবেক সরকারের ১৫ বছরের জুলুম-অত্যাচারে অতিষ্ঠদের আহাজারি বিশ্লেষণ করি তবে দেখতে পাব যে মহান আল্লাহ মজলুমদের ১৫ বছরের আহাজারির পর যে নেয়ামত দিয়েছেন তা ধ্বংস করতে এবং আল্লাহর নেয়ামতের অসম্মান ও অমর্যাদা করতে অনেক মজলুম পনেরো মিনিট সময় ধৈর্য ধরতে পারেনি। বরং তারা আল্লাহকে পনেরো মিনিট সময় না দিয়ে যেসব অপকর্ম করেছে তার দাবানল আজ টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তা রাতারাতি বন্ধ হওয়ার কোনো অলৌকিক ঘটনা কি ঘটবে।
লেখক: সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
এসআই