অবশেষে পুরো জাতি যেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যে অনিশ্চয়তা, যে শঙ্কা ছিল কিছুটা হলেও তার অবসান ঘটল।
আমরা এ যৌথ বিবৃতি যদি একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখব যে বিএনপি তার আগের অবস্থান থেকে অনেকখানি ছাড় দিয়েছে। বিশেষ করে বিএনপির সর্বশেষ স্থায়ী কমিটির সভায় ঘোষণা করা হয়েছিল যে নির্বাচন হতে হবে ডিসেম্বরের মধ্যেই। তারেক রহমানও সুস্পষ্টভাবে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছিলেন। সেখান থেকে বিএনপি সরে এসেছে। স্পষ্টতই ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে তারেক রহমান সম্মান দেখিয়েছেন। আমরা এ বৈঠকের যে তথ্য এবং ভিডিওচিত্র দেখেছি তাতে দেখা গেল যে দেশের সবচেয়ে বৃহৎ এবং জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের নেতা তারেক রহমান যেভাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সম্মান এবং শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন তা সবার জন্য অনুকরণীয়। তিনি প্রধান উপদেষ্টার সম্মানে বিএনপির অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। একটি বিষয় পরিষ্কার করেছেন যে বিএনপি দেশে শান্তি চায়, দেশে গণতন্ত্র উত্তরণ চায় এবং ঐক্যবদ্ধভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। ওই আলোচনা অনুষ্ঠানের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী মহামূল্যবান একটি বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সংস্কার এবং বিচার দুটি চলমান প্রক্রিয়া। ’ তিনি সংস্কার প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো যে বিষয়ে একমত হবে সে বিষয় সংস্কারের পথে এগোবে এবং নির্বাচনের পরও সংস্কার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। ’ বিচার সম্পর্কেও তিনি একই মন্তব্য করেছেন। এর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে সংস্কার বা বিচার সম্পন্ন করার সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। দুটি আপন গতিতে চলবে। প্রধান উপদেষ্টা এ বিষয়ে একমত হয়েছেন।
আমরা আশা করি এ বৈঠকের সিদ্ধান্ত এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাস্তবায়িত হবে এবং ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কার্যক্রম অবিলম্বে শুরু হবে। না হলে দেশ আবার বিভক্তি এবং বিশৃঙ্খলার দিকে যেতে পারে। প্রধান উপদেষ্টার এ পরিবর্তিত অবস্থান এবং বিএনপির নমনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্বাচরনকেন্দ্রিক বিতর্কের অবসান হওয়া উচিত বলে সবাই মনে করেন। কিন্তু এখন যদি বাংলাদেশের কোনো কোনো রাজনৈতিক দল গোঁ ধরে যে তারা এপ্রিলেই নির্বাচন চায় কিংবা অযৌক্তিক শর্ত আরোপ করে নির্বাচন বিলম্বিত করতে চায়, তবে তা হবে জন আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থি। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপরীত।
রাজনীতিতে বিভিন্ন দলের মধ্যে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। এটা থাকা স্বাভাবিক। এ মতপার্থক্যই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। নির্বাচন নিয়ে এনসিপি, জামায়াত বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ভিন্নমত থাকতেই পারে। সে ভিন্নমত তারা প্রকাশও করতে পারে। কিন্তু আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্রের প্রধান শর্ত হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত। গণতন্ত্রে সংখ্যালঘিষ্ঠ বা প্রতিটি মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু সেই মতামতটিই গ্রহণ করা হবে, যা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী লালন করে, ধারণ করে। দেশের ৯০ ভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যে চেয়েছিল। সেখান থেকে ৯০ ভাগ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি এবং নেতা হিসেবে তারেক রহমান নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে একমত হয়েছেন। এটি তাঁদের একটা ঐতিহাসিক ছাড়। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটি বড় সুযোগ। আশা করা যায় এখানে আর কোনো অজুহাত বা কে চায় বা কে চায় না সে বিষয়টি নিয়ে কালক্ষেপণ করা হবে না। নতুন করে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি করা হবে না। বল এখন প্রধান উপদেষ্টার কোর্টে। তিনি দেশে ফিরে নিশ্চয়ই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্রুত এ বিষয় নিয়ে কথা বলবেন। বিশেষ করে তাঁর অপত্যস্নেহে লালিত নতুন গঠিত নিবন্ধনহীন রাজনৈতিক দল এনসিপিকে তিনি রাজি করাবেন। কারণ এনসিপি প্রকাশ্যেই ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অভিভাবক হিসেবে মেনেছে। কোনো সমস্যা বা সংকটে ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রথম জাতীয় নাগরিক পার্টিকে ডাকেন, পরামর্শ করেন। কদিন আগেও ড. ইউনূস যখন পদত্যাগের চিন্তা করেছিলেন তখন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তাঁকে পদত্যাগ না করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।
আমরা ৬ জুন ঈদের আগের দিন প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখব যে তাঁর এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণাটি এনসিপির দাবির সঙ্গে মিলিয়ে করা। এমনকি নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণার পর এনসিপি এবং জামায়াত ড. ইউনূসের ঘোষণাকে অভিনন্দন জানিয়েছিল। যদিও অধিকাংশ মানুষ এবং প্রায় সব রাজনৈতিক দল প্রধান উপদেষ্টার এ ঘোষণায় আশাহত এবং বিস্মিত হয়েছিল। এ রকম বাস্তবতায় আমরা সবাই আশা করব যে প্রধান উপদেষ্টা কারও প্রতি অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী না হয়ে, বিশেষ কোনো গোষ্ঠী, দল বা অংশের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষার কথা শুনবেন। সুদূর লন্ডনে তিনি জনগণের অভিব্যক্তি জানতে পেরেছেন। সেই অভিব্যক্তি তাঁকে একটি নতুন সুযোগ দিয়েছে। কারণ আমরা জানি যে ১০ মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থা খুবই নাজুক। এ সরকার কোনো ক্ষেত্রেই সফল হতে পারেনি। রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসাবাণিজ্য, শিল্পকারখানা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সব ক্ষেত্রে নানা রকম সংকটে জর্জরিত সরকার। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়াবহ। ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধপ্রায়। অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। এ রকম পরিস্থিতিতে একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যে প্রয়োজন তা বলার জন্য কোনো বিশ্লেষক-বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন নেই। দেশের জনগণ মনে করে যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি সব জানেন, বোঝেন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের জনপ্রিয়তা এবং বাস্তবতা সম্পর্কেও তিনি ওয়াকিবহাল। তাঁকে ভুলে গেলে চলবে না যে তাঁর ক্ষমতার উৎস হলো দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। সব রাজনৈতিক দল সম্মিলিতভাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান করেছে। ছাত্রদের কয়েকটি সংগঠন বা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দল নয়, বরং তিনি জাতির ঐক্যের প্রতীক। কাজেই তিনি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা শুনবেন। জাতির প্রত্যাশার কথা জানবেন এটি সবাই আশা করে। সেই প্রত্যাশা অনুযায়ী তিনি পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এটাই সবাই প্রত্যাশা করে। দেশ আজ মহাসংকটে। যদি শেষ পর্যন্ত ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর অবস্থানে অনড় থাকতেন, তাহলে দেশে অনিবার্য রাজনৈতিক বিভক্তি এবং সহিংসতার সূত্রপাত হতো। আমরা প্রধান উপদেষ্টাকেও তাঁর বিচক্ষণতা এবং দায়িত্ববোধের জন্য ধন্যবাদ দিতে চাই। কারণ তিনি যথাযথ সময়ে প্রকৃত বাস্তবতা অনুধাবন করতে পেরেছেন। তিনি নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে করা সম্ভব বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। এটিই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এখানে আলাপ-আলোচনা এবং যুক্তিতর্কের মাধ্যমে যে কোনো সংকটের সমাধান হতে পারে। তারেক রহমান এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেই গণতান্ত্রিক চর্চার একটি অনন্য উদাহরণ স্থাপন করলেন লন্ডনে। আমরা আশা করি যে এ চর্চা বাংলাদেশের রাজনীতিতে অব্যাহত থাকবে। যে আশাবাদ এবং সিদ্ধান্ত লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে তৈরি হলো, সেই আশাভঙ্গের বেদনা যেন না ঘটে, আমরা যেন কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক পরিক্রমার যাত্রা দ্রুত শুরু করতে পারি। দেশে যেন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আগামী রোজার আগেই সম্পন্ন হয়, সে পথ পাড়ি দেওয়ার দায়িত্ব প্রধান উপদেষ্টার। কারণ এ মুহূর্তে তিনি গণতন্ত্রের পথযাত্রার কান্ডারি।
অদিতি করিম : নাট্যকার ও কলাম লেখক
Email : [email protected]