তেমন কারও খেয়াল বা স্মরণে ছিল না বরাবরের মতো এবারও আগাম বন্যা হানা দিতে পারে বৃহত্তর সিলেটের কয়েকটি অঞ্চলে। ঠিকই ঈদের পূর্বাপরে কয়েকদিনের টানা ভারী বর্ষণে তলিয়ে গেছে হবিগঞ্জসহ আশপাশের বেশ কিছু গ্রাম।
বানিয়াচং, হবিগঞ্জ আর্মি ক্যাম্প থেকে রান্না করা উন্নতমানের খাবার নিয়ে যাওয়া হয় ৩৪ জন সনাতন ধর্মাবলম্বীসহ ১২০ জন বন্যাদুর্গত মানুষের কাছে। স্থানীয় আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থানরত সবার সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে দিতে ১৭ পদাতিক ডিভিশনের পক্ষ থেকে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়।
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এমন মানবিক উদ্যোগ শুধু একটি তাৎক্ষণিক সহায়তা নয়। বরং দেশের জনগণের প্রতি একটি বার্তা- ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে সুখে-দুঃখে সবসময় পাশে রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে’।
বুঝমানদের জন্য সেনাবাহিনীর এ সফ্ট মেসেজ বোঝা পানির মতো সোজা। আর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিশেষ রূপ-সৌন্দর্য এখানেই। সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সেনাসহ যৌথ বাহিনীর নজরদারি মালুম করতে পেরেছেন এবার ঈদের ছুটিতে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকরা। বন্যায় আশ্রয় কেন্দ্রে উন্নতমানের খাবার বিতরণকালে আশপাশের পর্যটন এলাকায়ও ছিল সেনাবাহিনীর নজরদারি। পাহাড়ি ঢলের স্বচ্ছ জলে ঈদ আনন্দে মাতোয়ারা হয়েছেন পর্যটকরা।
একসময় লোকমুখে এ মৌসুমে ভোলাগঞ্জে সাদা পাথরে ঢল নামার কথা শুনলেও যাওয়ার সাহস হয়নি। এবার যৌথ বাহিনীর নজরদারির খবর জেনে সেখানে নেমেছে দেশের নানান প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকদের ঢল। ঈদের ছুটিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অবকাশ যাপনের জন্য পরিবার-পরিজন নিয়ে সেখানে গিয়ে যারপরনাই মুগ্ধ তারা।
এবারও আগাম বন্যা হানা দিতে পারে বৃহত্তর সিলেটের কয়েকটি অঞ্চলে বন-পাহাড়ের সৌন্দর্যে মাতোয়ারা হয়েছে হাজার হাজার পর্যটক। মাথার ওপরে তুলোর মতো মেঘ, সীমান্তের দিকে ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো সবুজ পাহাড়। নিচে পানি-পাথরের সংমিশ্রণ। পাহাড়ের বুক চিড়ে বয়ে চলেছে ঠান্ডা পানির স্রোত। সে পানিতে দাপিয়ে বেড়িয়েছে শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সি মানুষ। পাহাড়ি ঢলের স্বচ্ছ পানিতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সিলেট কোম্পানীগঞ্জের পর্যটন কেন্দ্র যেন নতুন করে আবিষ্কার হয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা এমন থাকলে বন, পাথুরে নদী, পাহাড়ের বুক চিড়ে নেমে আসা ঝরনা, বিস্তৃত নীল জলধারা, হাওর আর ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর পর্যটকদের কাছে টানতেই থাকবে। পর্যটকদের নিরাপত্তা এবং সেবা নিশ্চিতে স্থানীয় প্রশাসন, সেনাসদস্যসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এবারের তৎপরতায় অভিভূত। কোনো মিডিয়া কাভারেজ বা প্রচারণা ছাড়াই চলেছে কর্মযজ্ঞটি।
এর মাত্র কদিন আগে, সেনাবাহিনীর সতর্কবার্তা তথা হুঁশিয়ারিটা ছিল বেশ লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার। মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার হার্ড মেসেজ ছিল সেনাপ্রধান ও তার বাহিনীর। কিন্তু, তেমন হার্ড অ্যাকশনে যেতে হয়নি। বিভিন্ন এলাকায় কিছু টোকেন অ্যাকশনেই মব পান্ডামি অনেকটা দমে গেছে। জায়গা মতো কয়েকটি অ্যাকশনে ঈদুল আজহায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই, গণপরিবহনে বাড়তি ভাড়া আদায়ও দমেছে। সেনাসদর থেকে ব্রিফিংয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব, জাতীয় নিরাপত্তা, মানবিক করিডর ও সমসাময়িক বিষয়ে সাংবাদিকদের সোজা ভাষায় সেনাবাহিনীর চাওয়া ও ভাবনা খোলাসা করে জানানো হয়েছে।
এ সময় দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হয় এমন যে কোনো বিষয় কঠোরভাবে প্রতিহত করার কথাও জানিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে কোনো টানাপোড়েন নেই, স্পষ্ট করে তা জানিয়ে বলা হয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় রটানো বানোয়াট তথ্য থেকে সাবধান থাকতে। ঈদুল আজহা উপলক্ষে সাধারণ মানুষের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও সুশৃঙ্খল যানবাহন চলাচল নিশ্চিতে সেনাবাহিনীর দুই সপ্তাহের বিশেষ কার্যক্রমের সুফল এখনো পাচ্ছে মানুষ। তাঁদের প্রচেষ্টায় মব জাস্টিস, চাঁদাবাজি, খুনখারাবির ঘটনা অনেক কমে এসেছে। কিছু হটস্পট চিহ্নিত করে সেগুলোর ওপর নজরদারি ও অ্যাকশন বেশ কাজে দিয়েছে। অবশেষে ঈদের পূর্বাপরে হবিগঞ্জসহ আশপাশের এলাকায় পানিবন্দি গ্রামবাসীর পাশে দাঁড়ানোর সমান্তরালে এলো, শুধু তাৎক্ষণিক নয়, সবার সুখে-দুঃখে পাশে থাকার বার্তা।
সরকার যখন নির্বাচনি প্রক্রিয়া ঠিক রাখতে সচেষ্ট, সেনাবাহিনী রক্তপাত ঠেকাতে বদ্ধপরিকর, তখনো গুজববাজরা দেশে-বিদেশে অপপ্রচারে লিপ্ত। দেশে এবং সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা এ মহলটির খুব কাম্য। নতুন করে বলার অবকাশ নেই যে, বাংলাদেশ ইতিহাসের একটি ক্রান্তিকাল পার করছে। যেখানে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা রক্ষা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জে বাংলাদেশকে জিততেই হবে। এমন সন্ধিক্ষণেও ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের কিছু অপতৎপরতা লক্ষণীয়। সেখানে সেনাবাহিনী জনগণের পাশে থাকার বার্তা দিয়ে জাতিকে আরেকটি সাহস জুগিয়েছে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে গেলে বা জনতার পাশে না থাকলে কার লাভ। বাংলাদেশে সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী থাকা মানে কেবল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়, প্রতিবেশীসহ আশপাশের নিরাপত্তার জন্যও ইতিবাচক। আমাদের সেনাবাহিনী গত জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে পেশাদার ভূমিকা পালন না করলে বাংলাদেশের অবস্থা কী হতো? আশপাশেরই বা কী দশা হতো? কোথায় গিয়ে পড়ত এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া? জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে অভ্যস্ত। নতুন করে সফ্ট মেসেজে সেনাবাহিনী তা আরেকবার মনে করিয়ে দিল। চমৎকার চেইন অব কমান্ড থাকায় শক্তি প্রয়োগ না করেও ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার নিয়ে মাঠে কাজ করার দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে সেনাবাহিনী। তার ওপর এবার কোথাও এক্সট্রা জুডিশিয়াল কর্মকাণ্ডে তাদের জড়িত থাকার তথ্য নেই। দানবীয় লিগেসির দৈত্যের নখদন্ত সহসা যায় না- এমন কঠিন বাস্তবতার মাঝেও সেনা কমান্ড যে পরিপক্বতার পরিচয় দিয়ে চলছে, তা নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের কাছে একটি ব্যতিক্রম ঘটনা। সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাওয়ার সমান্তরালে ঐতিহাসিক সহযোগিতাও করে যাচ্ছে বাহিনীটি। রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ না করার ওয়াদাও রাখছে। বাড়তি হিসেবে ভূমিকা রাখছে দেশের গণতন্ত্রায়নে।
গত আগস্টের শুরুতে হাসিনার বিরুদ্ধে ছাত্র নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ও সেনাবাহিনী বাধা দেয়নি। এতে শেখ হাসিনার ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যায়। এনে দেয় জাতীয় ঐক্য ও গণতন্ত্রের বাতাবরণ। এর মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনী ও বাহিনীপ্রধান জেনারেল ওয়াকারের ভূমিকা শুধু স্বাধীন বাংলাদেশে নয়, বিশ্ব ইতিহাসেও নতুন পালক যোগ করে। তা অতীত ও বর্তমানের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ ইতিহাসেরও পাঠ-পঠন হয়ে থাকবে। হবে গবেষণাও। তখন সেনাপ্রধান সেই ভূমিকা না নিলে কেবল আরও প্রাণহানিসহ গৃহযুদ্ধ নয়, এর চেয়েও বেশি কিছু হয়ে যেতে পারত। ঘুরছিল স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাতের সমূহ শনির শঙ্কাও। সেই বিবেচনায় দেশ, জাতি, গণতন্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যের পক্ষে কোরামিনের কাজ করেছেন এই সেনাপ্রধান। এখন সেখানে যোগ হলো বর্তমান-ভবিষ্যৎ সব সময় জনগণের পাশে থাকার বার্তা।
রক্তপাত থেকে বাঁচিয়ে দেশকে একটি পথরেখা দেওয়া চৌকশ সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারের ক্ষমতালিপ্সা নেই, তা প্রমাণিত। চাইলে এ লিপ্সা চরিতার্থ করার পর্যাপ্ত সুযোগ ছিল। এখনো আছে। কিন্তু তিনি সেই পথের পথিক নন। প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসও ক্ষমতার মোহমুক্ত। প্রধান উপদেষ্টা পরিচয়ের বাইরেও তাঁর যশ-খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। ক্ষমতার সাধ থাকলে তা সেই ওয়ান-ইলেভেনেই পারতেন। এখনো তিনি যত দ্রুত সম্ভব ক্ষমতার এই ভার থেকে মুক্ত হয়ে আপন জগতে ফিরতে চান বলে বারবার জানাচ্ছেন।
কিন্তু নির্বাচন আয়োজনে দেরির কারণে নানা কথা রটছে। সেনাপ্রধান ও সরকারপ্রধান দুজনকেই এসব কু-কথা হজম করতে হচ্ছে। সামগ্রিক অনিবার্য পরিস্থিতিতে ম্যাজিস্ট্রেসি সক্ষমতা নিয়ে এখনো মাঠে আছে সেনাবাহিনী। আর আছে বলেই সম্ভাব্য অনেক বিপদ থেকে রক্ষা। জননিরাপত্তা, অনাকাঙ্ক্ষিত অরাজকতা প্রতিরোধ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের কারসাজি রুখে দেওয়া, মিল-কারখানা সচল রাখা, রাষ্ট্রের কেপিআই এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনাগুলোকে রক্ষা, সড়ক-মহাসড়ক বাধামুক্ত রাখা, অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার, বিদেশি কূটনীতিক ও দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতের কাজ সেনাবাহিনী যেভাবে করে যাচ্ছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত উপলব্ধি করছেন মর্মে মর্মে। ঘটা করে এসবের কোনো প্রচার নেই। সেনাবাহিনী প্রচারে অভ্যস্তও নয়। মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার, বিভিন্ন চিহ্নিত অপরাধী ও নাশকতামূলক কাজের ইন্ধনদাতা-পরিকল্পনাকারীদের গ্রেপ্তারের পুলিশি কাজও করে চলছে সেনাবাহিনী। ক্ষতবিক্ষত, দুমড়েমুচড়ে যাওয়া পুলিশকে কাজে ফেরানো এখনো কঠিন কাজ। অন্যান্য বাহিনী একটু একটু করে পেশাদার হয়ে উঠছে। তাদের স্বাভাবিক করে তুলতে বাড়তি শ্রম দিতে হচ্ছে সেনাবাহিনীকে।
বিশ্বায়নের যুগে রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি, সমরনীতি, নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্বকে আলাদা করা যায় না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সেনাবাহিনীর ভূমিকা সব সময়ই প্রাসঙ্গিক। কখনো কখনো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতেও। ২০২৪ সালে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সেনাবাহিনী যেভাবে অংশীজন হয়েছে, তা সংগত কারণেই বাহিনীটির ওপর প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিয়েছে। সেনাপ্রধান ওয়াকারের ওপর ভরসার পারদটি তাই উচ্চমুখী। হিরো হয়েও তিনি যে হিরোইজম চর্চা করছেন না, এটিও এক তাৎপর্য। একটি দায়িত্বশীল ও পেশাদার সেনাবাহিনীর গণতন্ত্রের পক্ষে এমন অবস্থান তাঁকে শুধু জীবন্ত কিংবদন্তিই করেনি, বাহিনীর মর্যাদাও বাড়িয়েছে। আর সঠিক সময়ের সঠিক সিদ্ধান্ত জাতীয় ঐক্যের সঙ্গে দেশের গণতন্ত্রের পথকে করেছে প্রশস্ত। জনগণের পাশে অবস্থান জানানোর মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনী নিঃসন্দেহে আরও উচ্চতায় আসীন।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট
ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন