ঢাকা, শুক্রবার, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৬ মে ২০২৫, ১৮ জিলকদ ১৪৪৬

মুক্তমত

ভারতের পানিযুদ্ধ ও ফারাক্কা লং মার্চ

মাহবুব আলম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:৪৮, মে ১৫, ২০২৫
ভারতের পানিযুদ্ধ ও ফারাক্কা লং মার্চ

১৬ মে, ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ দিবস। গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যর দাবিতে মওলানা ভাসানী ১৯৭৬ সালের এই দিনে লাখ লাখ জনতাকে নিয়ে ফারক্কা অভিমুখী এই লং মার্চ করেন।

১৬ মে দুপুরে রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দান থেকে শুরু হয়ে ৬৪ কিলোমিটার লং মার্চ। শেষ হয় পরদিন বিকেলে কানসাটে। ভারত সীমান্তের খুব কাছে কানসাটের একটি হাইস্কুল ময়দানে লং মার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করে মওলানা ভাসানী বলেন, ফারাক্কা সমস্যা ন্যায়সঙ্গত সমাধানে ভারত অস্বীকৃতি জানালে তিনি ১৬ আগস্ট থেকে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলন শুরু করবেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আবারো ফারাক্কা সমস্যা সমাধানের দাবিতে চিঠি দেবেন বলে জানান এবং তিনি তা দিয়েছেন ২৩ জুন। এই চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘অফিসার পর্যায়ে এই সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ফারাক্কা ও সীমান্ত সমস্যার সমধানে আপনি বাংলাদেশে আসুন এবং এর সমাধান খুঁজে বের করুন। অভিন্ন ঐতিহ্যের অধিকারী দু’দেশের মানুষের স্বার্থে সেটা খুব জরুরি। ’

ফারাক্কা লং মার্চের কর্মসূচি ঘোষণা কারার পর এ নিয়ে উত্তেজনা দেখা দিলে তিনি ১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে ইন্দিরা গান্ধীকে চিঠি দেন। চিঠিতে বলেন, ফারাক্কা সমস্যা সমাধানের যদি উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করেন তবে তার লং মার্চ কর্মসূচি অপরিবর্তিত থাকবে। চিঠিতে তিনি ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব কামনা করেন এবং ভারতের কাছ থেকেও একই ধরনের আচরণ আশা করেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভাসানীর চিঠির উত্তর দিলেও ফারাক্কা সমস্যা সমাধানের বিষয়টি এড়িয়ে যান। ফলে মওলানা ভাসানী সীমান্ত পেরিয়ে ফারাক্কা অভিমুখী লং মার্চ কর্মসূচি অব্যাহত রাখেন। এই ঘটনায় ভারত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করে। ফলে সীমান্তে তীব্র উত্তেজনা দেখা দেয়। এই অবস্থায় বাংলাদেশ সরকার মওলানাকে সীমান্ত অতিক্রম না করে বাংলাদেশ সীমান্তের ভিতরই লং মার্চ সমাপ্ত করার আহ্বান জানায়। সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভাসানী সীমান্তের খুব কাছে সমাবেশ করে লং মার্চ শেষ করেন। সীমান্তের ভারতের সৈন্য সমাবেশের তীব্র নিন্দা করে মওলানা ভাসানী বলেন, আমরা শান্তি চাই। আর ওরা যুদ্ধ চায়। বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনতার ভয়ে তারা সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করেছে। আমরা যুদ্ধকে ঘৃণা করি। তিনি আরো বলেন, আমাদের এই মিছিল বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে মজলুমের সংগ্রামের প্রতীক।

ভাসানীর এই প্রতীকী প্রতিবাদ দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পায়। ভাসানীর এই লং মার্চ আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে সাড়া ফেলে দেয়।  আর দেশের ভেতরে পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে আন্দোলন জোরদার হয়।

মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা লং মার্চের ফলে ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলের প্রথম ফারাক্কা চুক্তিতে পানির যে ভাগাভাগি হয় তাতে শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশের জন্য নির্দিষ্ট পরিমান পানি সরবারাহের গ্যারন্টি ক্লজ সংযুক্ত হয়। কিন্তু ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার শাসনামলের দ্বিতীয় চুক্তিতে গঙ্গা নদীর শীতকালীন গড় প্রবাহের অর্ধেক পানি সরিয়ে কলকাতা বন্দরে চালান করার অধিকার দেওয়া হয়। সেই সাথে চুক্তি থেকে গ্যারন্টি ক্লজ তুলে দেওয়া হয়। ফলে এই চুক্তিটি হয় কার্যত শক্তির বলে করে নেওয়া চরম বৈষম্যমূলক একটি অধিনতা চুক্তি, যা আর্ন্তজাতিক রীতি-নীতির পরিপন্থী। তারপরও চুক্তি অনুযায়ী খরা মৌসুমের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশেকে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি দেওয়ার কথা। কিন্তু গ্যারান্টি ক্লজ না থাকায় ভারত চুক্তি অনুযায়ী পানি দেয়নি। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী ২০০১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পানি মিলেছে মাত্র তিন বছর। ফলে বাংলাদেশে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। শুরু হয় দেশের উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ। জীববৈচিত্রের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। মানুষের জীবন জীবিকাও হুমকিতে পড়ে, যা আজো অব্যাহত আছে।

ফারাক্কা চালুর ৫০ বছরে বাংলাদেশে ফারাক্কার প্রভাব শীর্ষক বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিগত পাঁচ দশকে এক সময়ের খরস্রোতা প্রমত্তা পদ্মার বুকে বিশাল বিশাল চর জেগেছে। শুকিয়ে গেছে, মরে গেছে পদ্মার উৎস থেকে সৃষ্ট বেশ কিছু নদ-নদী। অনেক নদীর গতিপথ সংকীর্ণ হয়ে গেছে। ফলে সেই নদীগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। শুকনো মৌসুমে পদ্মার বিস্তৃর্ণ এলাকা জুড়ে দেখা যায় ধু ধু বালুচর। আগে পদ্মা ছিল কয়েক কিলোমিটার প্রশস্ত। এখন তা অনেক সরু হয়ে গেছে। শুকনো মৌসুমে এখন পদ্মায় সরু খালের মত পানি প্রবাহিত হয়।

পদ্মায় পানি কমে যাওয়ার সাথে সাথে মাছও কমে গেছ। অতীতে পদ্মায় যে মাছ ধরা পড়ত এখন তার দশভাগের এক ভাগও ধরা পড়ে না। আর বড় বড় মাছ তো নেই হয়ে গেছে। নেই হয়ে গেছে স্বাদের ইলিশ, পদ্মার ইলিশ। পদ্মার ইলিশ এখন কেবলই ইতিহাস। এখন যে ইলিশ ধরা পড়ে, ধরা হয় তা চাঁদপুরের ইলিশ, বরিশালের ইলিশ, মেঘনার ইলিশ, সাগরের ইলিশ। দলছুট কিছু ইলিশের ঝাঁক পদ্মায় এলেও বড় জোর  গোয়ালন্দ পর্যন্ত। তারপরও এটাই এখন বাস্তবতা যে, গোয়ালন্দ পয়েন্ট এখন আর ইলিশ ধরার কোনো তোড়জোড় নেই। অথচ এক সময় পদ্মার ইলিশের জন্য বিখ্যাত ছিল গোয়ালন্দ। আর তাই তো পদ্মাপাড়ের জেলেরা বেকার হয়ে পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে গেছে।

উল্লেখ্য, ভারত যে শুধু ফারাক্কা পয়েন্ট থেকে পানি প্রত্যহার করছে তা নয়, ভারত উজানে কানপুরে গঙ্গা ব্যারেজ করে, হরিদুয়ারে বাঁধ দিয়ে এবং আরো ৪০০ পয়েন্ট থেকে পানির প্রত্যহার করে, ভাটির দেশ বাংলাদেশকে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করছে বছরে পর বছর ধরে।  

ভারত শুধু গঙ্গা নয়, তিস্তা, ব্রক্ষ্মপুত্রসহ অভিন্ন ৫৪টি নদীর পানির হিস্যা নিয়েও নানান ছলচাতুরি করছে। তিস্তার উজানে গজলডাঙ্গাসহ তিনটি বাঁধ দিয়ে নিয়মিত পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এক দিকে শুকনো মৌসুমে পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশকে বিপদে ফেলছে। অন্যদিকে, বর্ষা মৌসুমে বাঁধ খুলে দিয়ে বাংলাদেশকে বানের জলে ভাসিয়ে দিচ্ছে। রীতিমত একটা পানিযুদ্ধ শুরু করেছে ভারত। সর্বশেষ আগস্ট বিপ্লবের পর ভারত ত্রিপুরার ডাম্বুর জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাঁধ খুলে দিয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলের ৫টি জেলাকে বন্যায় ভাসিয়ে দেয়। এর পর রয়েছে এই অঞ্চলে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের হুমকি। হুমকি রয়েছে ব্রক্ষ্মপুত্র নদের পানি নিয়েও। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ব্রক্ষ্মপুত্র নদ ভারতের আগ্রাধিকার প্রকল্প। এটা করা হলে বাংলাদেশে বিশাল পরিবেশ বিপর্যয় হবে। সমুদ্রের লবনাক্ততা পদ্মার গোয়ালন্দ, মধুমতির কামারখালী, ধলেশ্বরীর মানিকগঞ্জ ও মেঘনার ভৈরব ছাড়িয়ে যাবে। সমগ্র যমুনা নদীর নাব্যতা হারিয়ে যাবে। সারা দেশের নদী ও অভ্যন্তরীণ জলাভূমির প্রায় অর্ধেক এলাকার জীববৈচিত্র ধ্বংস হয়ে যাবে। মিষ্টি পানির অভাবে দেশের অর্ধেক এলাকার ভূতল জীব এবং জনজীবন মহাবিপদের মুখে পড়বে। মোহনা এলাকার জীববৈচিত্র, মৎস্য ও পনিসম্পদ বিপর্যস্ত হবে।  

ভারত শুধু বাংলাদেশ নয়, অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোর বিরুদ্ধেও পনিযুদ্ধ শুরু করেছে। সর্বশেষ কাশ্মিরের পেহেলগাঁও জঙ্গি নাটকের পর ভারত পাকিস্তানের সাথে সম্পাদিত সিন্ধু নদীর পানি চুক্তি স্থগিত করে বলেছে, পাকিস্তানকে এক ফোঁটাও পানি দেওয়া হবে না। শুধু বলেই ক্ষান্ত হয়নি, এই লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। চেনাব নদীর পানি প্রবাহ কমিয়ে দিয়েছে। চেনাব নদীর জম্মু অংশে চন্দ্রভাগা নদীর ওপর নির্মিত বাগলিহার জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পানি আটকে দিয়েছে। সেই সাথে ঘোষণা দিয়েছে, ঝিলাম নদীর পানি প্রবাহও কমিয়ে দেওয়া হবে। উত্তর কাশ্মিরে ঝিলাম নদীর ওপর বিশালগঙ্গা বাঁধ আছে ভারতের। এছাড়া ইরাবতি, বিপাশা ও শতদ্রুর পানি প্রবাহ কমিয়ে দেওয়ার ফন্দি-ফিকির করছে ভারত। সেই সাথে বাঁধের আটকানো পানি ছেড়ে দিয়ে ইতিমধ্যে আজাদ কাশ্মিরের বিপুল এলাকা বন্যায় ডুবিয়ে দিয়েছে। ত্রিপুরার ডাম্বুর বাঁধের পানি ছেড়ে গত বছর যেভাবে বাংলাদেশর কয়েকটি জেলাকে বন্যায় ডুবিয়ে দেয় ঠিক সেইভাবে।

ভারতের এই পানিযুদ্ধ, পানি আগ্রসন এখন কার্যত পানিসন্ত্রাসে রূপ নিয়েছে। এই পনিযুদ্ধ, পানিসন্ত্রাস রুখতে হলে ফারাক্কা লং মার্চের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলতে হবে পানিসন্ত্রাস রুখে দাও। দিতে হবে। ভারতের বিরুদ্ধে সব প্রতিবেশীকে ঐক্যবদ্ধ করে দুনিয়াব্যাপী সোচ্চার হতে হবে। সোচ্চার হতে হবে সন্ত্রাসবাদ রুখে দাও, দিতে হবে। আর্ন্তজাতিক ফারাক্কা কমিটি ইতিমধ্যেই এই কাজ অনেকটা এগিয়ে নিয়েছে। এই কমিটি আমেরিকা, কানাডাসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সভা-সমাবেশ, সেমিনার করে ভারতের পানিযুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলছে। এখন এ বিষয়ে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। সেই সাথে নিতে হবে জনউদ্যোগ।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।