ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২, ১৩ মে ২০২৫, ১৫ জিলকদ ১৪৪৬

মুক্তমত

নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের ৮০ বছর

মাহবুব আলম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪:৩২, মে ৯, ২০২৫
নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের ৮০ বছর রেড স্কয়ারে সামরিক কুচকাওয়াজ

আজ ৯ মে, ঐতিহাসিক ভিক্টোরি ডে—নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয়ের ৮০তম বার্ষিকী। ১৯৪৫ সালের এই দিনে হিটলারের জার্মান বাহিনী আত্মসমর্পণ করে সোভিয়েত তথা মিত্রশক্তির সর্বাধিনায়ক জোসেফ স্ট্যালিনের কাছে।

এর মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ অধ্যায়ের অবসান ঘটে, যে যুদ্ধ প্রায় ছয় বছর ধরে মানবসভ্যতাকে গ্রাস করেছিল।

এই আত্মসমর্পণের কয়েক দিন আগে, অর্থাৎ ১ মে সোভিয়েত লাল ফৌজ জার্মানির রাজধানীতে ঢুকে পড়ে এবং ২ মে বার্লিনের পতন ঘটায়— আধুনিক যুদ্ধের ইতিহাসে যা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। বার্লিন পতনের পরপরই সোভিয়েত নেতৃত্ব নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে জার্মান বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে, কারণ ততক্ষণে হিটলার আত্মহত্যা করে ফেলেছেন। লাল ফৌজের বার্লিনে প্রবেশের আগের দিন, অর্থাৎ ৩০ এপ্রিল হিটলার প্রথমে প্রেমিকা ইভা ব্রাউনকে বিয়ে করেন, তারপর বাঙ্কারে ঢুকে সায়ানাইড বিষ খেয়ে ও মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর, বিধ্বংসী ও প্রাণঘাতী যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কারণ পূর্ববর্তী কোনো যুদ্ধেই এত মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির নজির ছিল না। এই যুদ্ধে প্রাণ হারান ছয় কোটিরও বেশি মানুষ। এর মধ্যে শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নেই নিহত হন প্রায় ২ কোটি ৭০ লাখ মানুষ। এই বিপুল প্রাণহানির পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল—প্রায় ছয় বছরব্যাপী যুদ্ধের প্রথম দেড়-দুই বছর বাদ দিলে বাকি পুরো সময়টাই এককভাবে নিজেদের মাটিতে যুদ্ধ করতে হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নকে। অন্যদিকে ইউরোপের অধিকাংশ দেশ হিটলারের রণহুঙ্কারে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে রণাঙ্গন ছেড়ে পালিয়ে যায়।

এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ফ্রান্স ও পোল্যান্ড। ফ্রান্স তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সাম্রাজ্যের অধিকারী দেশ ছিল। চারদিকে ছড়িয়ে ছিল তাদের উপনিবেশ। অথচ সেই ফ্রান্সকে মাত্র দুই সপ্তাহের যুদ্ধেই দখল করে নেয় জার্মান সেনারা। পোল্যান্ডও টিকতে পারেনি বেশি দিন—মাত্র ১৭ দিনের যুদ্ধে পরাজিত হয় তারা। যুদ্ধের ১৭তম দিনেই পোল্যান্ডের সরকার রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে যায়। অথচ পোল্যান্ড তখন ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত ছিল।

হিটলারের ইউরোপ দখলের গল্প প্রায় একই রকম ছিল। অস্ট্রিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ তো বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করেছিল জার্মান বাহিনীর কাছে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষেত্রে চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। লাল ফৌজ হঠাৎ করে আক্রমণের মুখে পড়ে কিছুটা হতচকিত হলেও খুব দ্রুতই তারা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। লেলিনগ্রাদ ও স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে শহরের রাস্তায় রাস্তায়, অলিতে-গলিতে, ঘরে ঘরে চলে ভয়াবহ লড়াই। সেখানে প্রতিটি মানুষ যোদ্ধা হয়ে ওঠে।

প্রতিটি রাস্তায়, প্রতিটি বাড়িতে, এমনকি প্রতিটি ঘরেও যুদ্ধ হয়। জনগণ রড, সাবল, ছুরি, গরম পানি, রাইফেল—যা কিছু হাতে পেয়েছে, তাই দিয়েই প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাই দীর্ঘ আড়াই বছর লেলিনগ্রাদ ঘিরে রাখলেও জার্মান সেনারা শহরটি দখল করতে পারেনি।

অন্যদিকে, স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ ছিল হিটলার বাহিনীর জন্য টার্নিং পয়েন্ট। দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী লড়াই শেষে সেখানে পরাজিত হয় জার্মান বাহিনী। এটি ছিল তাদের প্রথম বড় পরাজয়। এই যুদ্ধে প্রায় ৬ লাখ জার্মান সৈন্য মারা যায় বা ধ্বংস হয়ে যায়। এই পরাজয়ের পর শুরু হয় সোভিয়েত বাহিনীর অগ্রযাত্রা। লাল ফৌজ হিটলারের বাহিনীকে সোভিয়েত ভূখণ্ড থেকে হটিয়ে তাড়া করতে করতে পৌঁছে যায় বার্লিন পর্যন্ত।

তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই সোভিয়েতের ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি অনেক বেশি। নিহতের সংখ্যা দুই কোটি ৭০ লাখ। গৃহহারা আড়াই কোটি নরনারী। এক হাজার ৭০০ নগর ও ২৭ হাজার গ্রাম সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়। ৩৮ হাজার ৫০০ মাইল রেলপথ ধ্বংস হয়। আরও ধ্বংস হয় হাজার হাজার শিল্প কলকারখানা, বিধ্বস্ত হয় বিশাল কৃষিক্ষেত্র। সেই সঙ্গে লাখ লাখ গবাদি পশুর মৃত্যু হয়। শুধু তাই নয়, লেলিনগ্রাদসহ বিভিন্ন অবরুদ্ধ শহরে খাদ্য সংকটে অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করে।

১৬ এপ্রিল ১৯৪৫, শুরু হয় চূড়ান্ত লড়াই। এদিন মার্শাল ঝুকভের নেতৃত্বে লাল ফৌজ সাঁড়াশি আক্রমণ করে ৭০ কিলোমিটার দূর থেকে জার্মানির রাজধানী বার্লিন ঘিরে ফেলে। তারপর আসে ২০ এপ্রিল—এদিন ছিল অ্যাডলফ হিটলারের জন্মদিন। সকাল থেকে বার্লিনের কেন্দ্রস্থলে কামানের গোলাবর্ষণ করে হিটলারকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায় ঝুকভ বাহিনী। এ সময় মার্শাল ইভান কোনাভের নেতৃত্বে লাল ফৌজের আরেক বাহিনী বার্লিন শহরতলীর দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে হিটলার সেনা পরিচালনার নেতৃত্বে পরিবর্তন ঘটান। ২৩ এপ্রিল তিনি শেষ রক্ষার দায়িত্ব দেন জেনারেল হেলমুথ উইডলিংকে।

জেনারেল উইডলিং সাত লাখ ৬৬ হাজার ৭৫০ জন সেনা ও ৯ হাজার ৩০৩টি আর্টিলারি নিয়ে বার্লিনের ডিফেন্স লাইন তৈরি করেন। এ সময় তার হাতে ছিল দুই হাজার ২২৪টি এয়ারক্রাফট। তিনি শহরের মুখে ডিফেন্স লাইনে দাঁড় করান ৪৫ হাজার সেনা। সেইসঙ্গে পুলিশ ও হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর যুবকদের শহর রক্ষার দায়িত্ব দেন—যাদের সংখ্যাও ছিল ৪০ হাজারের বেশি।

শুরু হয় মরণপণ যুদ্ধ। মুহুর্মুহু ট্যাংক ও কামানের গোলাবর্ষণ, আর আকাশ থেকে ফাইটার বিমানের বোমাবর্ষণ। ১৬ এপ্রিল থেকে ৩০ এপ্রিল। মাত্র ১৫ দিনে ভেঙে পড়ে বার্লিনের প্রতিরক্ষা ব্যূহ। ১ মে লাল ফৌজ ঢুকে পড়ে শহরে। ২ মে দখল করে নেয় শহরের প্রধান প্রধান কেন্দ্রস্থল। ওইদিন লাল ফৌজ রাইখস্ট্যাগ দখল করে ভবনের শীর্ষে উড়িয়ে দেয় কাস্তে-হাতুড়ি খচিত রক্তলাল পতাকা—বিজয় পতাকা। সোভিয়েত পতাকা। এরপরই বার্লিন রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত জেনারেল হেলমুথ উইডলিং আনুষ্ঠানিকভাবে বার্লিন নগর সমর্পণ করেন লাল ফৌজের হাতে।

মাত্র ১৭ দিনের যুদ্ধেই বার্লিনের পতন ঘটে। এই যুদ্ধে নিহত হয় এক লাখ ৮০ হাজারেরও বেশি সৈনিক—জার্মানির এক লাখ এবং সোভিয়েতের ৮১ হাজার ১১৬ জন। আহত হন চার লাখ ৮০ হাজার জার্মান সেনা এবং লাল ফৌজের আহতের সংখ্যা ছিল দুই লাখ ৮০ হাজার ২৫১ জন। এ ছাড়া নিখোঁজ হন অনেকে। এই যুদ্ধে ধ্বংস হয় ইউরোপের সেই সময়ের সবচেয়ে সুন্দর ও প্রযুক্তিবিদ্যায় সমৃদ্ধ শহর বার্লিন। এই ধ্বংসাবশেষে পড়ে ন্যূনতম তিন লাখ বার্লিনবাসী ও ৮০ হাজার লাল ফৌজের সদস্য। এর মাঝেই শুরু হয় জার্মান সৈন্যদের দলে দলে আত্মসমর্পণ।

আনুষ্ঠানিকভাবে জার্মান বাহিনী আত্মসমর্পণ করে ৮ মে রাত ১১টা ১ মিনিটে। তখন মস্কোয় ৯ মে শুরু হয়ে গেছে। তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন ৯ তারিখকেই যুদ্ধের সমাপ্তি হিসেবে গণ্য করে। এই আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের বিপদ থেকে বিশ্ব রক্ষা পায়। ধূলিসাৎ হয়ে যায় হিটলারের বিশাল সাম্রাজ্য গঠনের স্বপ্ন। বিশ্বের মানুষ যুদ্ধের বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে মুক্তির নিঃশ্বাস নেয়।

আত্মসমর্পণের আগে জার্মান সেনাপ্রধান জেনারেল আলফ্রেড জোডাল ৭ মে রাত ২টা ৪১ মিনিটে ফ্রান্সের রেইমসে মিত্রবাহিনীর সদর দপ্তরে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। বলা হয়, ৮ মে থেকে জার্মান বাহিনীর সকল কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। এরপর ৮ মে মধ্যরাতের আগমুহূর্তে ফিল্ড মার্শাল উইলহেলম কাইটেল বার্লিনে সদ্য প্রতিষ্ঠিত মার্শাল ঝুকভের সদর দপ্তরে গিয়েও অনুরূপ দলিলে স্বাক্ষর করেন। এই আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে জার্মান বাহিনীর পরাজয় ও মিত্রবাহিনীর বিজয় নিশ্চিত হয়। সেই থেকে ৯ মে তারিখটি এক ঐতিহাসিক গৌরবোজ্জ্বল দিন।  

এই দিনটি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আজকের রাশিয়ার জাতীয় দিবস, বিজয় দিবস হিসাবে গণ্য করা হয়। এই উপলক্ষে ৮ ও ৯ মে দুই দিন সরকারি ছুটি থাকে। এবং মস্কোর রেড স্কয়ারে ৯ মে সেনাবাহিনীর বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। শুধু রাশিয়ায় নয় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলোতে দিনটি সরকারি ছুটির দিন এবং বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এই বিজয় দিবস পালিত হয়।

প্রতিবারের মতো এবারো মস্কোর রেড স্কয়ারে উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। এই উৎসবে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের সঙ্গে অংশ নেবেন চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিং পিং। এই উপলক্ষে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের সঙ্গে তিন দিনের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছেন।  

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি অবশ্য এই যুদ্ধবিরতি প্রত্যাখ্যান করে মস্কোতে ড্রোন হামলা করেছেন। তারপরও আজ রেড স্কয়ারে লাখ লাখ মানুষ সমবেত হবে, মিছিল করবে। মিছিলে শান্তির বার্তা দেওয়া হবে। এটিই হোক আজকের, এবারের বিজয় দিবসের প্রত্যাশা।

আরএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।