ঢাকা, মঙ্গলবার, ২২ বৈশাখ ১৪৩২, ০৬ মে ২০২৫, ০৮ জিলকদ ১৪৪৬

মুক্তমত

মায়ের পাশে ছায়ার মতো তারেক রহমান

মো. জুবাইর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২:২২, মে ৫, ২০২৫
মায়ের পাশে ছায়ার মতো তারেক রহমান

আজ সোমবার, নিজের একমাত্র ঠিকানায় ফেরার উদ্দেশ্যে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে যাত্রা করেছেন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। নিজে গাড়ি চালিয়ে তাকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দিয়েছেন তার জ্যেষ্ঠ সন্তান ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

লন্ডন থেকে মা-ছেলের সেই ছবি ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয়। সেখানে দেখা যাচ্ছে, গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে আছেন তারেক রহমান। আর তার পাশের সিটে নিশ্চিন্ত মনে বসে আছেন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রত্যায়ক বেগম জিয়া। মাকে পাশে নিয়ে তারেকও যেন হয়ে উঠেছেন রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ কবিতার সেই খোকার মতো।

“মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে, মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে…”— রবীন্দ্রনাথের এই কবিতার প্রতিচ্ছবিই যেন ফুটে উঠেছে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের এই ছবিতে। রবির কবিতা যেমন মা ও সন্তানের সম্পর্ক জাদুকরী এক সাহসিকতার গল্পে রূপ নেয়, ঠিক তেমনি বাস্তবতা ও রাজনীতিতে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সম্পর্ক যেন সেই কাব্যিক আবহের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তাদের দুজনের সম্পর্ক শুধু আত্মিক নয়— এক অদম্য লড়াইয়ের গল্প, হার না মানার এক প্রতীক।

স্বামীর মৃত্যুর পর অনিশ্চয়তা আর রাজনৈতিক চক্রান্তের ঘূর্ণিপাকে দাঁড়িয়ে থাকা একজন গৃহিণী কীভাবে হয়ে উঠলেন দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী— সেই গল্প আজ ইতিহাস। জিয়াউর রহমানের শাহাদাত বরণের পর বিএনপির হাল ধরেন খালেদা জিয়া। রাজনীতির নির্মম রণাঙ্গনে পা দিয়েই শুরু হয় তার কঠিন সংগ্রাম। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে রাজপথের লড়াই থেকে এক-এগারোর দুঃসহ দিনগুলো কিংবা দীর্ঘ কারাবাস— সবকিছুতেই খালেদা জিয়া ছিলেন অবিচল, আপসহীন।

তিনি শুধু একজন রাজনৈতিক নেত্রীই নন, বিএনপির অবিভাজ্য সত্তাও। ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নেত্রী’ হয়ে ওঠার এ পথ তার জন্য সহজ ছিল না। কিন্তু ম্যাডাম জিয়া সে পথ পেরিয়েছেন মাথা উঁচু করে।

খালেদা জিয়া যখন বিএনপির হাল ধরেন, তারেক রহমান তখন ছোট। কিন্তু মায়ের সাহচর্য পেয়ে তিনি হয়ে ওঠেন আপাদমস্তক এক রাজনীতিক। রাজনীতির খেলা বা কূটনীতির গাণিতিক হিসাব— দুয়ের মিশেলে হয়ে ওঠেন বিএনপির আস্থার বাতিঘর। এর মধ্যে ছিল হাজারো সংগ্রাম ও সম্পর্ক। তাদের মা-ছেলের বন্ধন যে শুধু রক্তের নয়; জাতীয়তাবাদের, সংগ্রামের এবং সর্বোপরি ভাঙাগড়ার ইতিহাসের, সেটা জানে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ।

তারপরও চলুন একটু পেছনে ফিরে তাকাই। দিনটা ছিল ১৯৮১ সালের ৩০ মে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে আততায়ীর হাতে নিহত হলেন। খালেদা জিয়া তখন সাধারণ গৃহিনী। রাজনীতির জটিল জগতের বোঝেন না কিছুই। কিন্তু সেই অবস্থায় চোয়াল শক্ত করে, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেলেন। বিএনপি যখন নেতৃত্বহীন, বিশ্বাসহীনতার ঘূর্ণিপাকে দুলছে, তখন দাঁড়িয়ে যান সবচেয়ে অপ্রস্তুত জায়গায়—নেতৃত্বের কেন্দ্রে। ১৯৮৬-৯০ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে খালেদার নাম ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। তিনি পরিচিত হয়ে ওঠের নতুন পরিচয়ে। তিনি লড়েছেন নির্বাচন বর্জন করে, লড়েছেন রাজপথে, লড়েছেন সংসদে। আর পাশে তখন ছোট্ট তারেক, কৈশোরে বাবাকে হারানো এক ছেলে। এই সময়কালে ধাপে ধাপে খালেদা জিয়া হয়ে ওঠেন ‘গণতন্ত্রের আপসহীন নেত্রী’।

তারেক রহমানও তার মায়ের পাশেই ছিলেন সেই কবিতার বীরপুরুষের মতো। যেন ক্ষণে ক্ষণে মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন, ‘আমি বলছি, ভয় কোরো না মা গো, ওই দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা…। খালেদা জিয়ার রাজনীতির ছায়াসঙ্গী হয়ে ওঠার সময়টায় তাকে চক্রান্ত, মামলা চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছিল। কিন্তু তারেক যেন মাকে বলেছিলেন, ‘আমি যেন তোমায় বলছি ডেকে, আমি আছি, ভয় কেন মা করো?”

তারেক রহমান রাজনীতিতে নেমেছিলেন আওয়ামী শাসনামলে নির্মম বাস্তবতা ও চক্রান্তের মধ্য দিয়ে। একের পর এক মামলা, গ্রেপ্তার, নির্যাতন। এক-এগারোর পর ২০০৮ সালে তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। জেলকক্ষে তাকে পিষে ফেলার মতো নির্যাতন করা হয়। তার কিডনি ও স্নায়ু আক্রান্ত হয়। কিন্তু তিনি হার মনেননি। মাকেও হার মানতে দেননি। বিদেশে থেকে, লন্ডনের মায়ের চিকিৎসা, দলের নীতিনির্ধারণ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সব কিছু চালিয়ে গেছেন সহনশীলতার মধ্য দিয়ে।

খালেদা জিয়াকে যখন কারাগারে বন্দি করা হয় ২০১৮ সালে। তারেক রহমান তখন লন্ডনে। বিচলিত হয়ে তিনি দেশে ফেরার জন্য ছটফট করছিলেন। কিন্তু স্বৈরাচার হয়ে উঠতে থাকা হাসিনা সরকার তা হতে দেবে না, সেটিও জানতেন তিনি। এরমধ্যে খালেদা জিয়া অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাকে নেওয়া হলো হাসপাতালে। হয়তো তখন তারেক রহমানের মন বলে উঠেছিল, ‘এই চেয়ে দেখ আমার তলোয়ার, টুকরো করে দেব তোদের সেরে। ’

সত্যিই, তারেক রহমান লড়াই চালিয়ে গেছেন। দেশের রাজপথে না হলেও কৌশলে, কথায়, তথ্যের মাধ্যমে। ডিজিটাল যুগে দূরত্ব কোনো বাধা নয়। তারেক সেটিকেই সুযোগ হিসেবে নিয়েছেন। কাজে লাগিয়েছেন। দেশে বিএনপির প্রতিটি সিদ্ধান্তের কেন্দ্রে ছিলেন। লন্ডন থেকে মায়ের চিকিৎসা ও দলের কৌশল, দলীয় মনোনয়ন, নির্বাচনী কৌশল গণআন্দোলন— সবই তিনি কৌশলীভাবে সামলেছেন। দলও তার দিকনির্দেশনা মেনে চলেছে। অনেকের চোখে তিনি বিতর্কিত হতে পারেন, কিন্তু খালেদা জিয়ার চোখে তিনি সব সময় ভরসার ‘খোকা’ হিসেবেই উত্তীর্ণ হয়েছেন। যদিও অনেকে প্রশ্ন তোলে, প্রবাসে থেকে তার কিসের রাজনীতি? কিন্তু সত্যি হলো, তারেক রহমান নিজেকে বিএনপির সবচেয়ে সক্রিয় ও গণভিত্তিসম্পন্ন মুখ হিসেবে তৈরি করেছেন। যেভাবে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন খালেদা জিয়া। যাদের ওপর ভর করে এখনও টিকে আছে বিএনপি নামক বৃহত্তর রাজনৈতিক দলটি।

২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর তারেক রহমান ছিলেন প্রতিহিংসার সহজ নিশানা। সেখান থেকে তার রাজনৈতিক লড়াই, সাংগঠনিক নির্দেশনা ও নেতৃত্ব, ভোটের অধিকার, আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের ডাক তাকে খালেদা জিয়ার মতোই যুগোপযোগী করে তুলছে। কেননা, ২০১৬ সালে যখন তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনীত হন, বেগম জিয়া তখন কারাগারে। ওই অবস্থায় কোনো ভয় না পেয়ে তারেকই মনোনয়ন বোর্ড পরিচালনা করেছেন, সাংগঠনিক পুনর্গঠনের রূপরেখা সাজিয়েছেন, বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। তিনি গড়ে তুলেছেন ইউরোপ, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে বিএনপির প্রবাসী সংগঠনগুলোর সমন্বয় কাঠামো। এই জায়গায় রবি ঠাকুরের কবিতার সেই লাইন মিলে যায়-
‘ঢাল তলোয়ার ঝন্‌ঝনিয়ে বাজে,
কী ভয়ানক লড়াই হল মা যে,
শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা।
কত লোক যে পালিয়ে গেল ভয়ে,
কত লোকের মাথা পড়ল কাটা।
এত লোকের সঙ্গে লড়াই করে
ভাবছ খোকা গেলই বুঝি মরে। ’

কিন্তু না, তারেক বসে যান বিএনপির মূল চালকের ভূমিকায়। লন্ডনে বসে শহীদ জিয়ার মতো অল্প অল্প শব্দে যে বিরাট বিরাট কথাগুলো বলেছেন, দলের নেতাকর্মীরা তা শুনেছেন। প্রতিপালন করেছেন। এভাবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি কেবল মায়ের ছায়া নন—বিএনপির অনিবার্য ভবিষ্যৎ।

গত বছরের শেষ দিকে মা-ছেলের মিলন হয়। সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর নানা মানুষ নানা মন্তব্য করেছেন। সবার মন্তব্যই ছিল প্রায় একই- ‘আহা শান্তি’। বাস্তবে এটি ছিল এক পরম শান্তির মিলন— কারা-নির্যাতনে ক্ষতবিক্ষত এক মা, আর দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া এক ছেলের পুনর্মিলন।

৫ আগস্টের পর নতুন বাংলাদেশে কারামুক্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান খালেদা জিয়া। ছেলের বাসায় ওঠেন। সেখানে পারিবারিক মিলনের পাশাপাশি রাজনৈতিক ভবিষ্যতের পরিকল্পনাও যে হয়েছে তা অনুমেয়। মা ছেলে একসঙ্গে দেশে ফিরবেন, এমন কথা চাউর হয়েছিল। কিন্তু দুই পুত্রবধূকে সঙ্গে করে খালেদা জিয়া দেশে ফিরছেন। চিকিৎসার পর এখন তিনি অনেকটাই সুস্থ। ফলে তার এই ফেরা শুধু ফেরা নয়, এক বিপ্লবের সূচনা।

মা ফিরছেন, ছেলে পাশে না থাকলেও ছায়ার মতো আছেন সবসময়। বীরপুরুষ কবিতার শেষ কয়েকটি লাইনের মতো-
ঠিক যেন এক গল্প হত তবে,
শুনত যারা অবাক হত সবে।
দাদা বলতো, কেমন করে হবে,
খোকার গায়ে এত কি জোর আছে?
পাড়ার লোকে সবাই বলত শুনে,
ভাগ্যে খোকা ছিল মায়ের কাছে।

আমরা যারা এই সময়ের সাক্ষী, তারা জানি—এই সত্য কেবল কবিতার না, রাজনীতিরও।

লেখক: মো. জুবাইর, সাংবাদিক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।