ঢাকা, মঙ্গলবার, ২২ বৈশাখ ১৪৩২, ০৬ মে ২০২৫, ০৮ জিলকদ ১৪৪৬

মুক্তমত

মন খারাপের দেশে দুঃস্বপ্নের পাহাড়!

গোলাম মাওলা রনি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:৪২, মে ৫, ২০২৫
মন খারাপের দেশে দুঃস্বপ্নের পাহাড়!

ঢাকা: ২০২৫ সালের মে মাসের ৩ তারিখ দুপুরবেলায় যখন এই নিবন্ধ লিখছি তখন মনের ওপর বিশাল এক জগদ্দল পাথর চেপে বসেছে। এমনিতেই গত কয়েকদিন নানামুখী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দুঃসংবাদের কারণে এক ধরনের অস্থিরতায় ভুগছি, তার ওপর আজকে অফিসে আসার পথে হেফাজতে ইসলামের বিশাল মহাসমাবেশ দেখে অস্থির মনে বিষণ্নতার জগদ্দল পাথর চেপে বসল।

অন্তর্বর্তী সরকারের নারীনীতি সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলাম যখন পুরো ঢাকাকে মিছিলের নগরীতে পরিণত করেছে ঠিক সে সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে এমন খবরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড়। এ যেন ইতিহাসের সেই নির্মম সন্ধিক্ষণ যখন রোম নগরীতে আগুন জ্বলছিল তখন সম্রাট ক্লডিয়াস নিরো মনের সুখে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন।

চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে আমার এক ধরনের নস্টালজিয়া রয়েছে। ১৯৯১ সালে আমি ব্যবসা শুরু করি সার্ভে ও ইন্সপেকশন সেবার মাধ্যমে, যার পুরোটাই ছিল চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক। বিদেশি জাহাজের ড্রাফট সার্ভে, কার্গো সার্ভে এবং কনটেইনার সার্ভের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করি। তারপর ফ্রেইট ফরোয়ার্ডিং, মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্টেশন, এমএলও অর্থাৎ মেইন লাইন অপারেটর এজেন্সি এবং সবশেষে কম্পোজিট নিট টেক্সটাইল মিল স্থাপনের মাধ্যমে গত ৩০ বছর যা কিছু করছি তার সঙ্গে বন্দর, কাস্টমস, ভ্যাট ইত্যাদির সঙ্গে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তার ফলে এসব খাতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো কোনো দেশিবিদেশি লুটেরার নজর পড়লে কলিজার মধ্যে প্রচণ্ড বেদনা শুরু হয়ে যায়।

আমার ব্যবসায়িক জীবনের প্রথম ১০ বছরে বেশির ভাগ সময় চট্টগ্রামে কাটিয়েছি। আমার অফিসটিও ছিল বন্দরের জেটির ঠিক উল্টোদিকে ফকিরহাট ওভার ব্রিজের কাছে। কাজের সুবিধার জন্য কর্ণফুলী নদীর তীরে এবং বন্দরের ইয়ার্ডের কোল ঘেঁষে আমার একটি রেস্ট হাউস ছিল, যেখান থেকে বন্দরের সব কার্যক্রম দেখা যেত। নিজে মোটরসাইকেল চালিয়ে অথবা গাড়িতে সারা রাত বন্দরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত, এক জেটি থেকে অন্য জেটি, এক ওয়্যার থেকে অন্য ওয়্যার হাউসে ছুটে বেড়িয়েছি। প্রতি শিফটে আমার কোম্পানির প্রায় ৫০ জন লোক দায়িত্ব পালন করত এবং তাদের তদারক করার জন্য আমাকে প্রায়ই নিদ্রাহীন রাত যাপন করতে হতো। কাজের প্রয়োজনে বন্দরের কর্তা, কাস্টমস কর্তা, শিপিং এজেন্ট, সিএন্ডএফ এজেন্ট, আমদানি-রপ্তানিকারক, বিদেশি ক্রেতা, শ্রমিকনেতা, গোয়েন্দা সংস্থাসহ জাহাজের ক্যাপ্টেন ও ক্রুদের সঙ্গে কতবার যে বৈঠক করেছি তার হিসাব নেই। ব্যবসায়িক বুদ্ধি অর্জন ও বন্দর পরিচালনার অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য পৃথিবীর নামকরা সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দরসহ অনেক ড্রাই ডক ও কনটেইনার ইয়ার্ড পরিদর্শন করেছি। জাহাজ ব্যবসা ও অ্যাভিয়েশন ব্যবসাসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সভা-সমিতি, সেমিনার ও সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছি। আমার জীবনের গত ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা ও সফলতার আলোকে আমি একটি কারণও খুঁজে পাচ্ছি না কেন চট্টগ্রাম বন্দরটি বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে হবে। ফলে মন খারাপ না করে থাকতে পারছি না। ব্যবসায়িক বুদ্ধি

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে এখন যা অনিবার্য হয়ে পড়েছে তার দুর্গন্ধ আমার নাকে এসেছিল সেদিন, যেদিন সাবেক সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলে দিয়েছিল। বাংলাদেশ প্রতিদিনে একটি নিবন্ধ লিখে এবং চ্যানেল আই তৃতীয় মাত্রাসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে গলা ফাটিয়ে বলেছিলাম, রোহিঙ্গারা যাবে না, উল্টো চট্টগ্রাম হারানোর আশঙ্কা তৈরি হবে। আমি যখন ওসব বলছিলাম তখন আওয়ামী লীগ-বিএনপি, জামায়াত-হেফাজতসহ তৌহিদি জনতা একে অপরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রোহিঙ্গাদের মেহমানদারি করার জন্য মার্চ টু কক্সবাজার শুরু করেছিল। আমার চৌদ্দ জনমের ভাগ্য যে ওই জমানায় মব সন্ত্রাস চালু হয়নি- নইলে আমাকে পাড়িয়ে আলুভর্তা বানিয়ে কত মানুষ যে জান্নাতে যাওয়ার টিকিট কনফার্ম করত, তা কেবল আল্লাহই জানেন।

আমার জীবনের বেশিরভাগ মন খারাপের নেপথ্য কারণ হলো জীবন-জীবিকা, ভূতাত্ত্বিক রাজনীতি এবং মানুষের আচরণ নিয়ে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা। খুব ছোটবেলা থেকে আমি যথাসম্ভব বিদ্যা অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। দেশবিদেশের বহু জ্ঞানী-গুণী, সফল-বিখ্যাত, কুখ্যাত মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ পেয়েছি। বহু দেশ ভ্রমণ করেছি, প্রচণ্ড ব্যস্ত সময় কাটানোর পাশাপাশি নীরবে-নিভৃতে একাকী থেকে জীবন সম্পর্কে চিন্তার সুযোগ পেয়েছি। ফলে চলমান সময়ে যেসব ঘটনা ঘটে তার অনেক কিছুই ঘটনা ঘটার বহু আগে আমার মন-মস্তিষ্কে ধরা পড়ে আর সে কারণে যে মনোবেদনার কবলে পড়ি তা থেকে নিজেকে হেফাজতের উপায় আজও খুঁজে ফিরছি। আমি জানি যে এই মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটছে, তা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কারণে।

আপনি যদি কোয়ান্টাম ফিজিক্স এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্স সম্পর্কে জানেন, তবে খুব সহজেই বুঝবেন কেন বৃহস্পতি গ্রহকে মানবমণ্ডলীসহ পৃথিবী নামক গ্রহটির সৌভাগ্যের প্রতীক বলা হয়। বিজ্ঞানের এই সর্বাধুনিক আবিষ্কারের মূল প্রতিপাদ্য হলো- পৃথিবীর সবকিছু কিছু পূর্বনির্ধারিত, যা কিনা পৃথিবী সৃষ্টির সময়ে প্রথম সেকেন্ডের ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে নির্ধারিত হয়ে গেছে। ফলে এই যে আমি এই মুহূর্তে বসে যা লিখছি এবং ভাবছি তা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সূত্রমতে, পৃথিবী তথা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির সেই প্রথম সেকেন্ডের নগণ্য অংশেই নির্ধারিত হয়েছিল।

উল্লেখিত কারণে মহাকালের জোতির্বিদরা প্রায় নিখুঁতভাবে গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব, পৃথিবীর ভবিষ্যৎ, মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পেরেছিলেন। জ্যোতির্বিদদের বিজ্ঞানকে দার্শনিকরা বহু ভাগে বিভক্ত করে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন, যার অন্যতম শাখা হলো রাজনীতি এবং পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তা আবার বিভিন্ন কাঠামোর ওপর দাঁড় করিয়েছেন স্থান কাল পাত্র ভেদে। ফলে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, উল্কাপিণ্ডের গতিবিধির ওপর নির্ভর করে যেভাবে সমুদ্র স্রোত তৈরি হয়- ভূপৃষ্ঠ গঠন বা ধ্বংস হয় তেমনি মানুষের মন স্থির-অস্থির বিষণ্ন হয়ে পৃথিবীতে একের পর এক লঙ্কাকাণ্ডের জন্ম দেয়।

চলমান সময়ের পাক-ভারত যুদ্ধের ডামাডোল আমাদের বর্তমান সরকারের যুদ্ধ প্রস্তুতির খবর, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে মানবিক করিডর দেওয়ার সিদ্ধান্ত, চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বা পরিকল্পনা, সেন্টমার্টিন নিয়ে গুজব, রোহিঙ্গা ল্যান্ড নামে মুসলিম রাষ্ট্র কিংবা খ্রিষ্টান রাষ্ট্র গঠন, চট্টগ্রাম অঞ্চল হারানোর আতঙ্ক, শিলিগুড়ি করিডর এবং ফেনী চিকেন নিক নিয়ে আতঙ্কের সঙ্গে যদি আপনি আজ থেকে প্রতি ৫০ বছর এবং প্রতি ১০০ বছরের অর্থাৎ ১৯৭৫, ১৯২৫ এবং ১৮৭৫, ১৮২৫, ১৭৭৫, ১৭২৫ এবং ১৬৭৫ সালের ইতিহাস পর্যালোচনা করেন তবে দেখবেন ওই সময়ে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে যা কিছু মন্দ, যা কিছু ধ্বংসাত্মক তাই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সূত্রমতে বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে।

বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক ইবনে খালদুনের মানচিত্র পরিবর্তনের টাইম ফ্রেম এবং টাইম লাইন নিয়ে রাষ্ট্রনায়করা যত সচেতন হয়েছেন ততই নিয়তির খপ্পর থেকে দেশ-জাতিকে তারা নিরাপদ রাখতে পেরেছেন। কিন্তু যারা জ্ঞানের অভাবে বৃহস্পতি গ্রহকে উপেক্ষা করে শনিপুজো করে সুখের সময়ে ভূতের দলকে দাওয়াত করে এনে কিলানোর জন্য নিয়োগ করেন তাদের জন্যই বাংলা প্রবাদ-প্রবচনে সুখে থাকতে ভূতে কিলায় শব্দমালা অনিবার্য হয়ে পড়ে। এসব কাণ্ড দেখে আমার মতো মানুষের মন খারাপ করে দুঃস্বপ্নের পাহাড় মাথায় চাপিয়ে সর্বনাশের শঙ্কায় আতঙ্কিত হওয়া ছাড়া আর কীই-বা করার আছে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক 

সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।