ঢাকা, সোমবার, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

ভর্তুকির সার নিয়ে পরিবহন ঠিকাদার-ডিলার সিন্ডিকেটের লুকোচুরি

উত্তম ঘোষ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৪, ২০২২
ভর্তুকির সার নিয়ে পরিবহন ঠিকাদার-ডিলার সিন্ডিকেটের লুকোচুরি ফাইল ছবি

যশোর: চলছে আমনের ভরা মৌসুম। মৌসুমের শুরু থেকেই সবচেয়ে বেশি সংকট তৈরি হয় এমওপি সারে।

সমস্যা নিরসনে কৃষিমন্ত্রী বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়ে বক্তব্য রেখেছেন। বেশি মূল্যে সার বিক্রয় ঠেকাতে এবং গুদামজাত বন্ধ করতে দেশব্যাপী পরিচালনা করা হচ্ছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সারের ওপর নজরদারির বাড়িয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম চালাচ্ছে।  

এতো কিছুর পরেও দেশব্যাপী সরকার নির্ধারিত ৭৫০ টাকার এমওপি এখনো পর্যন্ত ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে কৃষককে। তবে বেশি দাম দিয়েও চাহিদা মতো সার পাচ্ছে না কৃষক।

যশোর, ঝিনাইদহ, ঠাকুরগাও, পঞ্চগড়সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকার জোর তদারকি শুরু করলে প্রান্তিক এলাকার অধিকাংশ সরকারি সারের ডিলার ও খুচরা বিক্রেতা (সাব ডিলার) জরিমানার ভয়ে দোকান বন্ধ রেখেছেন। কোনো কোনো ডিলার পয়েন্ট খোলা থাকলেও কৃষককে সার নেই বলে জানানো হচ্ছে। আবার কোনো কোনো ডিলার সার দিলেও অতিরিক্ত দাম নিয়ে ক্যাশ মেমোতে সরকারি দাম লিখে দিচ্ছেন।

যশোরের মণিরামপুর উপজেলার চালুয়াহাটি গ্রামের কৃষক পলাশ মোড়ল বাংলানিউজকে বলেন, এমওপি সার কিনতে কয়েকটা ডিলার পয়েন্টে গিয়েও সার পাইনি। পরে সাধারণ দোকান থেকে ১৫২০ টাকা দিয়ে একবস্তা এমওপি সার কিনেছি। অথচ, ওই সারের সরকারি দাম ৭৫০ টাকা।  

ঝিনাইদহ জেলার গাংনী উপজেলার কৃষক আব্দুর রহিম সরদার বাংলানিউজকে বলেন, সারের পেছনে ঘুরে সরকারি দামে পাইনি, পরে খোলা বাজার থেকে দ্বিগুন দামে এমওপি কিনেছি। এছাড়াও অন্যান্য সারও বেশি দামে কিনেছি।

এ প্রসঙ্গে মেহেরপুর জেলার গাংনীর সার ডিলার আওকাত হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আমন মৌসুম হওয়ায় এমওপি সারের চাহিদা বেশি ছিলো। আগস্ট মাসে আমার সরকারি বরাদ্ধের এমওপি সার নিতে বিএডিসিতে টাকা টিটি করার পরেও গুদামে সার না থাকায় কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। পরে পর্যায়ক্রমে আমরা সার পেয়েছি, তবে সারের ওই সংকটে কেউ খোলাবাজার থেকে চড়ামূল্যে সার কিনলে তো আমাদের কিছু করার নেই।

ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জের সার ডিলার মতিচাঁন বাংলানিউজকে বলেন, আমনের ভরা মৌসুমে বিএডিসি গুদামে সময়মতো এমওপি সার পাইনি। পরে এক ট্রাকে ৪০০ বস্তা সার আসলে প্রত্যেককে ২০ বস্তা করে পর্যায়ক্রমে ভাগ করে দিয়েছে, আমরা সেভাবেই কৃষকদের মধ্যে বন্টন করেছি। তবে, এটা চাহিদার তুলনায় খুবই কম হওয়ায় সাময়িক সংকট তৈরি হয়। এটা ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাচ্ছে।

যশোরের কেশবপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের একজন সরকারি নিয়োগকৃত খুচরা সার বিক্রেতা বাংলানিউজকে বলেন, আমরা নামেই সাব-ডিলার। মূলত, মূল ডিলাররা সরকারি বরাদ্ধের সার উত্তোলন করে চড়া দামে আমাদের কাছেই বিক্রি করে। কেশবপুরের বিঞ্চু সিংহ নামের একজন ডিলারের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিগত এক বছরের মধ্যে কোনো সার তিনি দেননি। হঠাৎ, সরকারি চাপাচাপিতে আগস্ট মাসে আমাকে ৩০ বস্তা ইউরিয়া ও তিন দফায় ১০ বস্তা এমওপি সার দিয়েছেন। তবে, এটা কৃষকের চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য।

এসব ঘটনার অনুসন্ধানে জানা গেছে, কৃষকের চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে সার আমদানি করে চট্টগ্রাম পর্যন্ত নিয়ে আসে সরকার। এরপর এসব সার চট্টগ্রাম থেকে খুলনা ও নওয়াপাড়া বন্দরে এনে সারাদেশের বিএডিসি গুদামগুলোতে পৌঁছে দেয় বিএডিসির পরিবহন ঠিকাদাররা। গত কয়েক বছরের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, শুধুমাত্র চট্টগ্রাম থেকে দেশের গুদামে পৌঁছাতে গিয়ে পরিবহন ঠিকাদাররা হাজার কোটি টাকার সার হজম করে ফেলেছেন। এছাড়াও প্রয়োজনের সময় সার পৌঁছে না দিয়ে তারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। কেউ কেউ কালোবাজারে সার বিক্রি করে দেয়। এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নবাব অ্যান্ড কোম্পানি, মেসার্স পোটন ট্রেডার্স, কুষ্টিয়া ট্রেডিং অন্যতম।

সরকারি কর্মকর্তাদের বক্তব্যে সার সংকট নেই, বাস্তবতা ভিন্ন: সম্প্রতি সার নিয়ে কৃষকের হাহাকার নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে সারাদেশে বিএডিসি কর্মকর্তারা কোথাও সার সংকট নেই বলে সাফাই বক্তব্য দেন। তবে দেশের বিভিন্ন এলাকার ডিলারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগস্ট মাসের বরাদ্ধ দেওয়া হলে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী তারা ব্যাংকে টাকা জমা দিয়েও সার পাননি। এরপর অল্প পরিমাণে যে সার এসেছে পর্যায়ক্রমে ডিলারদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। তবে, যখন কৃষকের চাহিদা ছিলো সেই সময়ে সর্বোচ্চ সংকট থাকায় সোনার হরিণে পরিণত হয় এমওপি সার। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ৭৫০ টাকার এমওপি সার ১৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছে খুচরা বিক্রেতারা। এছাড়াও ১১০০ টাকার টিএসপি ১২০০ টাকা, ১১০০ টাকার ইউরিয়া ১২০০ টাকা ও ৮০০ টাকার ডিএপি ৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এমনকি, সরকারি তদারকির কারণে বিভিন্ন এলাকার সার ডিলাররা দোকান বন্ধ রাখছেন, কালোবাজার থেকে সার কিনে গুদামজাত করা ব্যবসায়ীরাও দোকান খুলছেন না। তারা বেশি মূল্যে বিভিন্ন মাধ্যমে এক এলাকার সার অন্য এলাকায় পাচার করছেন। গত কয়েকদিনে সারাদেশে এমন অসংখ্য পাচারকারী আটক হয়েছেন এবং জরিমানা করা হয়েছে।  

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) খুলনার সহকারি পরিচালক মো. শরীফ সফিউল আলম বাংলানিউজকে বলেন, সারের বরাদ্ধ-বন্টনের বিস্তারিত তথ্য আমাদের না দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে, আপনারা ঢাকা থেকে নেন। তবে, এমওপি সারের সংকট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগের চেয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে, এখন তো সব সরকারি গুদামে কম-বেশি সার যাচ্ছে। কয়েকদিনের মধ্যে পুরোপুরি নিরসন হয়ে যবে।

বাংলাদেশ সময়: ১২২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৪, ২০২২
ইউজি/এসএ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।