ইসলামী ছাত্রশিবির হলো জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন। এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেছে তারা।
দেশি-বিদেশি অনেক বিশ্লেষক দ্রুত সতর্ক করে দেন, এসব জয় ছাত্ররাজনীতিতে ইসলামপন্থী আধিপত্যের প্রত্যাবর্তনের ইঙ্গিত বহন করছে। এমনকি জাতীয় রাজনীতিতেও ইসলামপন্থী উত্থানের পূর্বাভাস হতে পারে। রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন্ন নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে ‘শিবির নিয়ন্ত্রিত ক্যাম্পাস’ শিরোনাম দখল করেছে সংবাদমাধ্যম ও রাজনৈতিক আলাপচারিতা। অনলাইন দ্য ডিপ্লোম্যাটে এসব কথা লিখেছেন সাংবাদিক জান্নাতুল নাঈম পিয়াল।
এতে আরো বলা হয়, বাস্তবতা হয়তো আরো জটিল। শিবিরের এ জয়গুলো যতটা নাটকীয়, তা ইসলামপন্থার প্রতি তরুণ ভোটারদের আকস্মিক ঝুঁকে পড়াকে প্রতিফলিত করে না। বরং এটি প্রকাশ করছে আরো সূক্ষ্ম অথচ সমান শক্তিশালী এক প্রবণতাকে। তাহলো জেনারেশন জেডের মধ্যে কৌশলগত ভোট দেওয়ার প্রবণতা।
তারা প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার প্রয়োগকে অর্থবহ করতে বদ্ধপরিকর। এ মনোভাব হঠাৎ কোনো ইসলামপন্থী ঢেউ নয়। সম্ভবত তা নির্ধারণ করবে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত বাংলাদেশের পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল। রাজনৈতিক বিজ্ঞানে কৌশলগত ভোট একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ধারণা। বহুদলীয় ব্যবস্থায় ভোটাররা প্রায়ই তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ছেড়ে দেন যদি মনে হয় তিনি বাস্তবে জিততে পারবেন না।
পরিবর্তে তারা এমন প্রার্থীকে বেছে নেন, যিনি প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারানোর বেশি সম্ভাবনা রাখেন। বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতিতে এ ঘটনাটি চোখে পড়ার মতো স্পষ্ট।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃথক নির্বাচনে অনেক শিক্ষার্থী স্বীকার করেছেন তাঁদের ভোট আদর্শ দিয়ে নয়, বাস্তবতায় প্রভাবিত হয়েছে। যদিও বিএনপির ছাত্রদল, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ এবং বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠন এখনো কিছু সমর্থন ধরে রেখেছে। কিন্তু ভোটবাক্সে তা প্রতিফলিত হয়নি। কারণটা সরল। তা হলো—এসব দল শিবিরকে হারাতে সক্ষম মনে হয়নি, তাই তাদের জন্য ভোট দেওয়া ছিল বৃথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী ফল ঘোষণার পর বলেছিলেন, ‘আমি শিবিরের সব কিছুর সঙ্গে একমত না। কিন্তু ওরাই একমাত্র জিততে পারত। এ জন্য আমার ভোটকে অর্থবহ করেছি। ’
তাঁর যুক্তিও ছিল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট যেদিন শেখ হাসিনা ছাত্র নেতৃত্বাধীন দীর্ঘ আন্দোলনের পর দেশ ছেড়ে পালান, এর পর থেকে ক্যাম্পাসে একমাত্র সক্রিয় শক্তি ছিল শিবির। তারা নেটওয়ার্ক গড়েছে, হলগুলোতে অবস্থান বজায় রেখেছে এবং শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন দুশ্চিন্তাকে কাজে লাগিয়েছে। বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো গত এক বছর ধরে মূলত দিকহীন হয়ে ঘুরেছে। এই যুক্তিই জাতীয় রাজনীতিতেও প্রতিফলিত হচ্ছে। অনেক তরুণের চোখে বিএনপি হয়ে উঠেছে ‘পরবর্তী সরকার’—পুরো দেশ পরিচালনার জন্য যথেষ্ট সংগঠন, সম্পদ ও ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে একমাত্র তাদের। উদাহরণস্বরূপ, সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) পরিচালিত এক জাতীয় জরিপে ৩৮.৮ শতাংশ তরুণ মনে করছেন, বিএনপি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে জিতবে। জামায়াতে ইসলামী দ্বিতীয় স্থানে এসেছে, ২১.৫ শতাংশ উত্তরদাতার পছন্দ হিসেবে। এই ধারণা যথাযথ হোক বা না হোক, প্রথমবারের ভোটারদের সিদ্ধান্তকে এরই মধ্যে প্রভাবিত করছে। ক্যাম্পাস ও জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে সাদৃশ্য স্পষ্ট। যেভাবে শিবিরের সাংগঠনিক শক্তি ও উপস্থিতি শিক্ষার্থীদের চোখে তাদের অবশ্যম্ভাবী বিজয়ী হিসেবে তুলে ধরেছে, বিএনপিও একইভাবে জাতীয় রাজনীতিতে গতিশীলতার সুবিধা পাচ্ছে। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে অনলাইন ফোরাম—সবখানেই একই কথা শোনা যাচ্ছে : বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন যাই হোক, জাতীয় নির্বাচনে অন্তত আগামী মেয়াদে বিএনপিই জিতবে।
এই যুক্তি প্রবল শক্তিতে কাজ করে। অর্থহীন ভোট দেওয়ার ভয় তরুণদের ছোট বামপন্থী দল, স্বতন্ত্র প্রার্থী বা নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে সমর্থন থেকে বিরত রাখছে। যত বেশি ভোটার কৌশলগত কারণে বিএনপির দিকে ঝুঁকছেন, তত বেশি তাঁরা অজেয় মনে হচ্ছে। আর যত অজেয় মনে হচ্ছে, ততই আরো ভোটার তাদের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে।
এটি স্পষ্ট ছিল ক্যাম্পাস নির্বাচনে, যেখানে অনেক বামপন্থী বা মধ্যপন্থী প্রার্থীর প্রতি সহানুভূতি থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা শেষ পর্যন্ত শিবিরকে ভোট দিয়েছেন। খুব শিগগিরই জাতীয় পর্যায়েও একই চিত্র দেখা যেতে পারে, যখন তরুণ ভোটাররা নিজেদের আদর্শকে এক পাশে সরিয়ে রেখে বিজয়ী দলে থাকার আকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দেবেন।
বিএনপির সব বিতর্ক জেতা বা সব ভোটারকে অনুপ্রাণিত করার দরকার নেই। তাদের শুধু এই বিশ্বাস টিকিয়ে রাখতে হবে যে তারাই একমাত্র দল যারা শাসন ক্ষমতায় যেতে পারে। এই বিশ্বাসই যথেষ্ট হতে পারে পাল্লা তাদের পক্ষে ভারী করতে।
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ
আরবি