জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বেশ কড়া ভাষায় বলেছেন, ফিলিস্তিনিরা তাদের মাটি ছেড়ে কোথাও যাবে না। তাদের জনগণ নিজেদের শেকড় আঁকড়ে ধরে রাখবে।
বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে ভাষণ দেন মাহমুদ আব্বাস। এসময় তিনি গাজা ও পশ্চিম তীরে দখলদারিত্বের অবসান ও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা কামনা করেন। ইসরায়েলের চলমান আগ্রাসন, অব্যাহত গণহত্যা, পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণ ও দখলদারিত্বের তীব্র নিন্দা জানান। একই সঙ্গে তিনি হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলারও স্পষ্ট প্রত্যাখ্যান করেন।
আব্বাস বলেন, দুই বছর ধরে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী ২ লাখ ২০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা ও আহত করেছে, যাদের বেশিরভাগই নিরস্ত্র শিশু, নারী ও প্রবীণ। এটি যুদ্ধ নয়, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ। এটি ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক ট্র্যাজেডিগুলোর একটি হিসেবে লিপিবদ্ধ হবে।
গাজার পরিস্থিতি তুলে ধরে আব্বাস বলেন, চরমপন্থী ইসরায়েলি সরকার পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি সম্প্রসারণ ও দখলদারিত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ ‘ই-ওয়ান’ বসতি পরিকল্পনা পশ্চিম তীরকে দ্বিখণ্ডিত করবে, জেরুজালেমকে বিচ্ছিন্ন করবে এবং দুই রাষ্ট্র সমাধানের পথ বন্ধ করে দেবে। তিনি এটিকে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলেও উল্লেখ করেন।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ পরিকল্পনা ও কাতারের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়ে আব্বাস বলেন, আমরা এসব বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করি। এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপর ভয়াবহ আঘাত এবং আন্তর্জাতিক আইনের ঘোরতর লঙ্ঘন।
ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট বলেন, ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর ছত্রছায়ায় বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ও ক্ষেত-খামার পুড়িয়ে দিচ্ছে, গাছ উপড়ে ফেলছে, গ্রামে হামলা চালাচ্ছে এবং নিরস্ত্র মানুষকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করছে। জেরুজালেম, হেব্রন ও গাজায় ইসলামিক ও খ্রিস্টান ধর্মীয় স্থাপনাগুলোতেও হামলা চালানো হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক আইন ও ঐতিহাসিক স্থিতাবস্থার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
গাজায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় সত্ত্বেও আব্বাস বলেন, আমরা হামাসের ৭ অক্টোবরের কর্মকাণ্ডকে প্রত্যাখ্যান করছি। ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিকদের টার্গেট করা ও জিম্মি করা ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায্য স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিনিধিত্ব করে না। তিনি স্পষ্ট করেন, গাজা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং সেখানে শাসন ও নিরাপত্তার পূর্ণ দায়িত্ব ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গ্রহণে প্রস্তুত। হামাস বা অন্য কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর অস্ত্র রাখার অনুমতি থাকবে না।
আব্বাস জানান, ১৯৪৮ সালের নাকবা থেকে আজও সাত মিলিয়ন ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুতি ও দখলের শিকার। জাতিসংঘের এক হাজারেরও বেশি প্রস্তাব পাস হলেও একটি পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। আমরা ওসলো চুক্তি মেনে প্রতিষ্ঠান সংস্কার করেছি, সহিংসতা প্রত্যাখ্যান করেছি, কিন্তু ইসরায়েল চুক্তি মানেনি।
বিশ্বজুড়ে ফিলিস্তিনপন্থী আন্দোলনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ফিলিস্তিনের ন্যায্য অধিকারের সঙ্গে ইহুদিবিদ্বেষকে গুলিয়ে ফেলা আমরা প্রত্যাখ্যান করি। এটি আমাদের নীতি ও মূল্যবোধের বিরোধী।
এ সময় কিছু প্রস্তবনা উল্লেখ করেন ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট। সেগুলো হলো- গাজায় তাৎক্ষণিক ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতি; শর্তহীন মানবিক সহায়তা প্রবেশ নিশ্চিতকরণ ও অনাহারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার বন্ধ; উভয় পক্ষের সকল বন্দি ও জিম্মি মুক্তি; গাজা থেকে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার ও অবৈধ বসতি স্থাপন বন্ধ; গাজা ও পশ্চিম তীর পুনর্গঠনের জন্য আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের পূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ; ইসরায়েলের কাছে আটক ফিলিস্তিনি কর রাজস্ব মুক্তি ও অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহার; যুদ্ধ শেষে এক বছরের মধ্যে রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচন এবং অস্থায়ী সংবিধান প্রণয়ন।
আব্বাস বলেন, এসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, সৌদি আরব, ফ্রান্স, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করতে ফিলিস্তিন প্রস্তুত।
বক্তব্যের শেষে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেন, আমরা আমাদের ভূমি ছাড়ব না, ফিলিস্তিনিরা এই মাটি ছেড়ে কোথাও যাবে না। প্রায় দুই বছর ধরে গাজা উপত্যকায় গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, অনাহার ও বাস্তুচ্যুতির ভয়াবহ পরিস্থিতি চললেও ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা দমিয়ে রাখা যাবে না। আমাদের ক্ষত যতই গভীর হোক, যতই এই দুঃসহ সময় দীর্ঘ হোক, তা আমাদের বাঁচার ও টিকে থাকার ইচ্ছা ভাঙতে পারবে না। স্বাধীনতার ভোর আসবেই। ফিলিস্তিনের পতাকা আমাদের আকাশে উড়বে। জেরুজালেম আমাদের হৃদয়ের রত্ন এবং আমাদের চিরন্তন রাজধানী। আমরা আমাদের পবিত্র ভূমি ত্যাগ করব না, আমাদের মানুষ অলিভ গাছের মতো শেকড় গেঁথে থাকবে।
এমজে