রাশিয়ার পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে সামরিক ড্রোন উন্নয়নে কাজ করছেন চীনা বিশেষজ্ঞরা—এমন তথ্য পেয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। ইউরোপের দুই নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও তাদের হাতে থাকা নথির বরাত দিয়ে সংস্থাটি জানিয়েছে, চীনা ড্রোন বিশেষজ্ঞরা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে রাশিয়ার অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আইইএমজেড কুপোলের সঙ্গে সরাসরি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন কাজে যুক্ত আছেন।
নথি ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক থেকে এখন পর্যন্ত কুপোলের কারখানায় অর্ধ ডজনেরও বেশি বার সফর করেছেন চীনা বিশেষজ্ঞরা। এই সময়ের মধ্যেই কুপোল চীনে তৈরি আক্রমণ ও নজরদারি ড্রোনের একাধিক চালান পেয়েছে, যা রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত প্রতিরক্ষা ক্রয় সংস্থা টিএসকে ভেক্টরের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়।
রয়টার্সের হাতে থাকা ব্যবসায়িক চালান ও ব্যাংক নথিতে দেখা গেছে, কুপোল চীনা কোম্পানি সিচুয়ান এইইর তৈরি একাধিক ওয়ান-ওয়ে আক্রমণাত্মক ড্রোন সংগ্রহ করেছে। এসব ড্রোনের মধ্যে ছিল এ১৪০ ও এ৯০০ মডেল, আর পরবর্তী চালানে সরবরাহের জন্য তালিকাভুক্ত ছিল এ৬০, এ১০০ ও এ২০০ মডেলের ড্রোন। কুপোলের নিজস্ব প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে রাশিয়ার চেলিয়াবিনস্ক অঞ্চলের চেবারকুল সামরিক পরীক্ষাকেন্দ্রে এসব ড্রোনের উড্ডয়ন পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে।
কুপোলের নথিতে বলা হয়েছে, চীনা বিশেষজ্ঞরা রাশিয়ার ইজেভস্ক শহরে তাদের স্থাপনায় গিয়ে ড্রোনগুলো সংযোজন করেছেন এবং সংস্থাটির কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। পরে তারা পরীক্ষার জন্য চেবারকুলে গিয়েছিলেন। ফ্লাইট বুকিংয়ের নথি থেকে জানা যায়, পরীক্ষার পরের দিন চীনা বিশেষজ্ঞরা চেলিয়াবিনস্ক থেকে ফেরার টিকিট কেটেছিলেন।
রাশিয়ার নথিতে চীনা বিশেষজ্ঞদের টিএসকে ভেক্টরের কর্মী হিসেবে উল্লেখ করা হলেও ইউরোপীয় কর্মকর্তারা মনে করছেন, তারা আসলে সিচুয়ান এইইর প্রকৌশলী। কারণ, পরীক্ষার প্রতিক্রিয়ায় এইই কোম্পানি যে মন্তব্য পাঠিয়েছে, তাতে সরাসরি নিজেদের টেকনিশিয়ানদের তথ্য ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।
রয়টার্সের দেখা একটি ইনভয়েসে দেখা যায়, ২০২৫ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে এইই টিএসকে ভেক্টরকে অ্যান্টি-জ্যামিং যন্ত্রাংশ-সংযুক্ত কয়েকটি এ২০০ ড্রোন ও অন্যান্য সরঞ্জামের জন্য ৫০ লাখেরও বেশি ইউয়ান (প্রায় ৭ লাখ ডলার) বিল করেছে।
নথিতে আরও উঠে এসেছে চীনের আরেকটি ড্রোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের নাম। কুপোলের এক পরীক্ষণ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে হুনান হাওতিয়ানইর তৈরি এইচডব্লিউ৫২ভি ড্রোনের পরীক্ষাও সম্পন্ন হয়েছে। এটি উল্লম্বভাবে উড্ডয়ন ও অবতরণ করতে সক্ষম (ভিটিওএল) ড্রোন, যা নজরদারি ও আক্রমণ দুই উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা যায়।
রয়টার্সের হাতে থাকা বিমান টিকিটের তথ্যে দেখা যায়, হুনান হাওতিয়ানইর প্রধান নির্বাহী লিউ মিংশিং এবং টিএসকে ভেক্টরের ড্রোন বিভাগের প্রধান আরতেম ভিসোৎসকি একই আসনে পাশাপাশি বসে সাইবেরিয়ার ইরকুৎস্ক বিমানবন্দর থেকে রাশিয়া ছাড়েন। এর আগে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত একটি প্রদর্শনীতে এই কোম্পানির ড্রোন প্রদর্শিত হয়।
কুপোলের আরও কয়েকটি চিঠিতে ২০২৪ ও ২০২৫ জুড়ে চীন ও রাশিয়ার বিশেষজ্ঞদের একাধিক সপ্তাহব্যাপী সফরের উল্লেখ রয়েছে। এসব সফরের উদ্দেশ্য ছিল নতুন ফ্লাইট কন্ট্রোল কম্পিউটার ও ইঞ্জিন সংযোজন, এমনকি নতুন ড্রোন মডেল জিএ-২১ নিয়ে কাজ করা। ইউরোপীয় কর্মকর্তারা মনে করছেন, জিএ-২১ আসলে ইরানি শাহেদ-১০৭ ড্রোনের একটি সংস্করণ।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য এই সহযোগিতার বিষয়ে কোনো জ্ঞাত থাকার কথা অস্বীকার করেছে। এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, চীন সবসময় ইউক্রেন সংকটের বিষয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে। কোনো পক্ষকেই কখনো প্রাণঘাতী অস্ত্র সরবরাহ করেনি এবং দ্বৈত ব্যবহারযোগ্য পণ্যের রপ্তানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।
রাশিয়ার ক্রেমলিন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও কুপোল কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগেই রাশিয়ার অস্ত্রশিল্পকে সহায়তাকারী চীনা কোম্পানিগুলোর ওপর একাধিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর আ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি’র গবেষক স্যামুয়েল বেনডেট বলেন, রাশিয়ার সামরিক সরবরাহ শৃঙ্খলে চীনের অংশগ্রহণ এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে আকাশপথের ড্রোন প্রযুক্তিতে চীনা উপাদান ও যন্ত্রাংশের প্রভাব বিশাল।
এমজে