ঢাকা, বুধবার, ১৮ ভাদ্র ১৪৩২, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

আন্তর্জাতিক

না ভারতের, না পাকিস্তানের— কোনো পতাকার নিচেই ঠাঁই নেই দুই বোনের

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০:৫৯, সেপ্টেম্বর ২, ২০২৫
না ভারতের, না পাকিস্তানের— কোনো পতাকার নিচেই ঠাঁই নেই দুই বোনের ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ হলেও দুই দেশের মধ্যে অভিবাসন নতুন কিছু নয়

দুই বোন অনেক আশা নিয়ে ভারতের নাগরিকত্বের জন্য হাত বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের খেলায় আজ তারা রাষ্ট্রহীন—না ভারতের, না পাকিস্তানের।

ইসলামাবাদের নাগরিকত্ব সনদ মেলেনি। এখন জীবনের পথে তারা আটকে গেছেন এক অচলাবস্থার দরজায়।

২০০৮ সাল থেকে ভারতের কেরালা রাজ্যে বসবাস করছেন দুই বোন। তারা ২০১৭ সালে ভারতের পাকিস্তান হাইকমিশনে নিজেদের পাসপোর্ট জমা দেন। তবে তখন তাদের বয়স ছিল ২১ বছরের কম। পাকিস্তানের আইন অনুযায়ী, ২১ বছরের নিচে কেউ স্বাধীনভাবে নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে পারেন না। তাই হাইকমিশন তাদের নাগরিকত্ব ত্যাগের সনদ দেয়নি।

২১ বছর পূর্ণ হওয়ার পরও তারা হাইকমিশনের দ্বারস্থ হলে কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে সনদ দিতে অস্বীকার করা হয়। এসব তথ্য জানান তাদের মা রশিদা বানু। তিনি বলেন, কয়েক বছর ধরে এই অনিশ্চয়তার কারণে মেয়েদের জীবন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নাগরিকত্ব না থাকায় তারা পাসপোর্টের আবেদনও করতে পারছেন না।

বিবিসি পাকিস্তান হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও কোনো জবাব পায়নি।

ভারত ও পাকিস্তান প্রতিবেশী রাষ্ট্র হলেও দুই দেশের সম্পর্কে প্রায়ই উত্তেজনা দেখা দেয়। চলতি বছরের মে মাসেই চার দিনের সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে দুই দেশ।  তবুও অভিবাসন অস্বাভাবিক নয়, বিশেষ করে ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির সময় যেসব পরিবারের সদস্য সীমান্তের ভিন্ন ভিন্ন পাশে আটকে পড়েছিলেন, তাদের মধ্যেই এই যাতায়াত বেশি দেখা যায়।

গত কয়েক দশকে নথিপত্র যাচাইয়ের কঠোরতা বেড়ে যাওয়ায় প্রক্রিয়া আরও জটিল হয়ে উঠেছে। সংসদে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি নাগরিকদের সাত হাজারেরও বেশি ভারতীয় নাগরিকত্বের আবেদন ঝুলে ছিল।

রশিদা বানুর অভিযোগ, পাকিস্তান হাইকমিশন নাগরিকত্ব ত্যাগের সনদ দিতে অস্বীকৃতি জানালে তিনি মেয়েদের পাসপোর্ট ফেরত চান। তবে সেগুলোও আর ফেরত দেওয়া হয়নি।

২০১৮ সালে হাইকমিশনের দেওয়া এক সনদে উল্লেখ রয়েছে—দুই বোন তাদের পাসপোর্ট জমা দিয়েছেন এবং ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ায় পাকিস্তানের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এ সনদকে আনুষ্ঠানিক নাগরিকত্ব ত্যাগের নথি হিসেবে মেনে নেয়নি। ফলে আদালতের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হন তারা।

গত বছর কেরালা হাইকোর্টের একক বেঞ্চ রায়ে বলেন, আবেদনকারীরা যে নথি আদায় করতে সক্ষম নন, তা সংগ্রহে তাদের নির্দেশ দেওয়া মানে অসম্ভবকে সম্ভব করতে বলা। আদালত ভারত সরকারকে দুই বোনকে নাগরিকত্ব দেওয়ার নির্দেশ দেন।

কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। চলতি বছরের ২৩ আগস্ট হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ আগের রায় বাতিল করে জানান, কোনো ব্যক্তিকে ভারতের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে অন্য দেশের নাগরিকত্ব ত্যাগের প্রমাণ থাকা অপরিহার্য। এই প্রক্রিয়াই আইনি স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে। ”

এখন তাদের সামনে উচ্চ আদালতে যাওয়ার পথ খোলা আছে।

পাকিস্তানের আইনে বলা আছে, ২১ বছরের নিচে কেউ স্বাধীনভাবে নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে পারে না। তবে বাবা যদি নাগরিকত্ব ত্যাগের আবেদন করেন, তাহলে সন্তানদের নাম তাতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

দুই বোনের বাবা মোহাম্মদ মারুফের জন্ম কেরালায়। কিন্তু নয় বছর বয়সে অনাথ হওয়ার পর দাদি তাকে দত্তক নেন এবং ১৯৭৭ সালে পাকিস্তানে নিয়ে যান।

রশিদা বানুর পরিবারও মূলত ভারতীয় ছিল। ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে সীমান্ত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আত্মীয়দের দেখতে গিয়ে পাকিস্তানে আটকা পড়ে তাদের পরিবার। এরপর বাধ্য হয়ে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নিতে হয়। সেখানেই জন্ম হয় রশিদা বানুর।

২০০৮ সালে রশিদা বানু চার সন্তানকে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ভিসায় ভারতে চলে আসেন। তবে তার স্বামী ভারতে মানিয়ে নিতে না পেরে কিছুদিন পর পাকিস্তানে ফিরে যান। পরে রশিদা বানু ও তার ছেলে ভারতীয় নাগরিকত্ব পান, কিন্তু দুই মেয়ে এখনও অনিশ্চয়তায় রয়েছেন।

মা রশিদা বানু জানান, পাকিস্তানি পরিচয়পত্র দেখাতে গিয়ে পরিবারকে প্রায়ই সামাজিকভাবে হেয় হতে হয়েছে। আগে অন্তত কোনো একটি পরিচয় তাদের ছিল। কিন্তু এখন দুই বোনের কোনো পরিচয়পত্র নেই। মোবাইল সংযোগ নেওয়া বা সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করানোর মতো বিষয়ে তাদের পড়তে হয়েছে বিপাকে।

কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত তাদের আধার কার্ড দিলেও তা নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। ফলে মৌলিক অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত।

রশিদা বানুর এক মেয়ের স্বামীকে বিদেশের চাকরি ছেড়ে ভারতে ফিরে আসতে হয়েছে, কারণ স্ত্রী তার কাছে যেতে পারেননি। অন্য মেয়ের সন্তানের চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন হলেও নাগরিকত্বের সনদ ও পাসপোর্ট না থাকায় তা সম্ভব হয়নি।

আইনজীবী এম. সসীন্দ্রন বলেন, ২০১৭ সালে তারা নাবালক থাকায় সনদ পাননি। এখন প্রাপ্তবয়স্ক হলেও তাদের হাতে আর পাকিস্তানি পাসপোর্ট নেই। তাহলে সনদ আদায় করবেন কীভাবে? তারা আসলে এখন একেবারেই আটকে গেছেন।

আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আন্তর্জাতিক এর সর্বশেষ